বনানী। রাজধানীর ব্যস্ততম বাণিজ্যিক এলাকার একটি। কর্মস্থলে ছুটছে মানুষ। অফিস-আদালতে কর্মচাঞ্চল্য। চাকা ঘুরছে গাড়ির। ক্রেতা-বিক্রেতাদের হাঁকডাকে জমজমাট আশপাশের শপিং সেন্টার। সকাল গড়িয়ে তখন বেলা পৌনে ১টা। হঠাৎ পাল্টে গেল সব। শুধুই আতঙ্ক। শুরু হয়ে গেল আতঙ্কিত মানুষের ছোটাছুটি। উদ্বিগ্ন মানুষের ভিড় বাড়তে থাকে বনানীর কামাল আতাতুর্ক সড়কে। দিশাহারা আশপাশের ভবনের বাসিন্দারা। হতচকিত হয়ে পড়ে রাস্তায় পথচারীরা। পরের ঘটনাগুলো আরও ভয়াবহ। আসতে থাকে আহত-নিহতের খবর।
বৃহস্পতিবার রাত ৮টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত বনানীর এফআর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডে অন্তত ১৯ জন মারা যায় বলে ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে। আহত অর্ধশতাধিক। তাদের কয়েকজন প্রাণ বাঁচাতে ভবন থেকে পাইপ ও তার বেয়ে নামতে গিয়ে পড়ে আহত হন। মৃত্যুমুখ থেকে ফিরে আসা মানুষের চোখে-মুখে ছিল আতঙ্কের ছাপ। শ্বাসরুদ্ধকর প্রায় ৬ ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে ফায়ার সার্ভিসের ৩১টি ইউনিট। অভিযানে অংশ নেয় ফায়ার সার্ভিসের পাশাপাশি সেনা, নৌ, বিমানবাহিনী ও পুলিশ।
এর আগে আগুন ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় আশপাশের ভবনের বাসিন্দাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে রাস্তায় নেমে আসতে দেখা যায়। তাদের সঙ্গে থাকা শিশুরা বুঝে উঠতে পারছিল না কী হচ্ছে তাদের সামনে। দিনভর নীরবে কারও ঝরেছে চোখের পানি, কারও আহাজারি আর কারও বুকফাটা আর্তচিৎকার। ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার হওয়া মানুষের মুখে ছিল আগুনের রোমহর্ষক বর্ণনা। ৫ ঘণ্টারও বেশি সময় দিনের আলো দেখেনি তারা। বেঁচে থাকার আশাটাও হারিয়ে ফেলেছিলেন। নিরাপদে কিংবা সুস্থভাবে প্রিয়জনের কাছে ফিরতে পারবেন কি, পারবেন নাথ- এ উত্তরও পাওয়ার সুযোগ ছিল না তাদের। অনেকে বাঁচার শেষ আশাটুকু ছেড়ে দিয়ে সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করছিলেন।
কয়েকজন বিভিন্ন ধরনের তার ধরে নামার চেষ্টা করেন। আবার যারা ভবনটির ভিতর আটকা পড়েছিলেন তারা ভাঙা কাচের ভিতর দিয়ে হাত বের করে সাহায্য চাচ্ছিলেন। ফায়ার সার্ভিসের সহায়তায় উদ্ধারের পর মোহাম্মদ আরিফ জানালেন, তিনি এফআর টাওয়ারের একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন। প্রতিদিনের মতো এদিন সকালে কাজে আসেন। আগুন লাগার পর আর বের হতে পারেননি। কয়েক ঘণ্টা আটকে থাকার পর ফায়ার সার্ভিসের ক্রেনে বিকাল পৌনে ৪টার দিকে নিচে নেমে আসেন। তিনি বলেন, বেরিয়ে আসতে পেরেছি, এই বড়। ভিতরে দেখেছি কেবল জীবন আর মৃত্যুর তফাৎ।
তখনও চলছিল ফায়ার সার্ভিসের আগুন নিভানো ও উদ্ধার অভিযান। এ সময় আগুন লাগা ভবনের সামনের রাস্তায়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) ও কুর্মিটোলা হাসপাতালে ভিড় জমায় স্বজনরা। প্রিয়জনের খোঁজ না পেয়ে হাজার মানুষের ভিড়ে আহাজারি করে অসংখ্য মানুষ। কেউ মায়ের খোঁজে, কেউ বাবার, কেউ স্বামীর এবং ভাইয়ের সন্ধান পেতে অপেক্ষা করছিলেন রাত পর্যন্ত।
ঘটনাস্থলে প্রভা হেলথ নামে একটি সংস্থার কর্মীরা অগ্নিদগ্ধদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে ক্যাম্প স্থাপন করে। জানা যায়, সেখানে তারা ৭ জন চিকিৎসক, ১৪ জন নার্স এসেছেন। এ ছাড়া সাপোর্ট স্টাফ ২০ জনের মতো। বিকাল পর্যন্ত তারা ৪০ জনকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেন। তবে এগুলো খুব ক্রিটিক্যাল রোগী নন। ক্রিটিক্যাল রোগীদের অ্যাম্বুলেন্সে করে কুর্মিটোলা হাসপাতাল অথবা ঢামেক হাসপাতালে পাঠানো হয়।
বিকাল ৪টায় ভবনের ১১, ১২ ও ১৩ তলার জানালা ভেঙে কয়েকজনকে উদ্ধার করে আনে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। ভবনের ভিতরে ধোঁয়া থেকে বাঁচতে আটকে পড়া লোকজনের দিকে ভেজা কাপড় নিক্ষেপ করা হয়। ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন অফিসার রাসেল সিকদার জানান, সন্ধ্যা ৭টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক লে. কর্নেল এস এম জুলফিকার রহমান এফআর টাওয়ারের সামনে সাংবাদিকদের বলেন, কীভাবে আগুনের সূত্রপাত তা তদন্ত ছাড়া বলা যাবে না। এ বিষয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
বিডি-প্রতিদিন/আব্দুল্লাহ তাফসীর