১৭ জানুয়ারি, ২০২০ ২১:৩৮

আমরা দ্বীনি মেহনতের বিভক্তি চাই না

ড. কাজী এরতেজা হাসান

আমরা দ্বীনি মেহনতের বিভক্তি চাই না

ড. কাজী এরতেজা হাসান

শুরু হলো তাবলিগ জামাতের বিশ্ব ইজতেমার মূল পর্ব। তাবলিগ আরবি শব্দ। যার শাব্দিক অর্থ পৌঁছানো, প্রচার করা, প্রসার করা, বয়ান করা, চেষ্টা করা ও দান করা ইত্যাদি। পরিভাষায় একজনের অর্জিত জ্ঞান বা শিক্ষা নিজ ইচ্ছা ও চেষ্টার মাধ্যমে অন্যের কাছে পৌঁছানোকে তাবলিগ বলে। তাবলিগ আদর্শ যিনি পৌঁছান, তাকে মুবাল্লিগ বলে। বিশ্বনবী (স.) এ পরিপ্রেক্ষিতে বলেছেন, ‘আমার পক্ষ হতে একটি বাণী হলেও তা অন্যের কাছে পৌঁছে দাও।’ 

মুবাল্লিগরা সে কাজটিই করে যাচ্ছেন। এই কাজের সূতিকাগার দিল্লির নিজামুদ্দিনের তাবলিগি মারকাজের জিম্মাদার মাওলানা সাদ কান্ধলভীকে নিয়ে মতভেদ দূর না হওয়ায় এবারও দুই পক্ষ দুই পর্বে ইজতেমা করছে। আজ বাদ ফজর শুরু হলো তাবলিগি মেহনতের সূতিকাগার দিল্লির হজরত মাওলানা ইলিয়াস কান্ধলভী (রা.) এর উত্তরসূরি মাওলানা সাদ কান্ধলভী অনুসারীদের মূল পর্ব। 

বর্ণিত আছে যে, আজ থেকে প্রায় ৬ দশক আগে ১৯১০ সালে ভারতের এক জনবিরল অঞ্চল মেওয়াত থেকে হাতেগোনা কজন মানুষ নিয়ে হজরত মাওলানা ইলিয়াস কান্ধলভী (রা.) তাবলিগের মেহনত শুরু করেন। তাবলিগের এ মেহনত এখন সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। বিশ্বব্যাপী সমাদৃত আজকের তাবলিগ জামাতের সার্থক রূপকার হজরত মাওলানা ইলিয়াস কান্ধলভী (রা.) ১৩৫১ হিজরি সনে হজ থেকে ফিরে আসার পর সাধারণ মুসলমানদের দুনিয়া ও সংসারের ঝামেলা থেকে মুক্ত করে ছোট ছোট দলবদ্ধ করে মসজিদের ধর্মীয় পরিবেশে অল্প সময়ের জন্য দ্বীনি শিক্ষা দিতে থাকেন। এরই মাঝে একদা তিনি মহানবী (স.) কে স্বপ্নে দেখেন এবং মহানবী (স.) তাকে দাওয়াত ও তাবলিগের কাজের জন্য নির্দেশ দেন। 

মহানবীর (স.) নির্দেশ মোতাবেক তিনি দাওয়াত ও তাবলিগের কাজের সূচনা করেন। তারপর এ কাজকে আরও বেগবান ও গতিশীল করার জন্য উপমহাদেশের সর্বস্তরের আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখ ও বুজুর্গদের কাছে দোয়া প্রার্থনা করা হয় এবং দিল্লির কাছে মেওয়াতে সর্বস্তরের মুসলমানদের জন্য ইজতেমা বা সম্মেলনের ব্যবস্থা করা হয়।

হজরত মাওলানা ইলিয়াস কান্ধলভী (রা.) এ কর্মপ্রয়াসকে তখন বলতেন ‘ইসালে নফস’ বা আত্মশুদ্ধির প্রাথমিক পাঠ। প্রথমত তিনি টেস্ট কেস হিসেবে ভারতের সাহারানপুর ও মেওয়াত এলাকায় সাধারণ মানুষের মধ্যে তার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য তুলে ধরেন। তিনি ৬টি বিশেষ গুণ অর্জনের মেহনত করেন জনসাধারণে। সেই বিশেষ গুণ হলো- কালেমা, নামাজ, ইলিম ও জিকির, ইকরামুল মুসলেমিন (মুসলমানদের সেবা) সহিহ নিয়ত ও তাবলিগ। এরপরই ক্রমেই তাবলিগের কার্যক্রম বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানের গণ্ডি ছাড়িয়ে পৌঁছে যায় বিশ্বের সর্বত্র।

হজরত মাওলানা আবদুল আজিজ (রা.) এর মাধ্যমে ১৯৪৪ সালে বাংলাদেশে তাবলিগ শুরু হয়। তারপর ১৯৪৬ সলে বিশ্ব ইজতেমা সর্বপ্রথম অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশের তাবলিগের মারকাজ কাকরাইল মসজিদে। পরে ১৯৪৮ সালে চট্টগ্রামের হাজী ক্যাম্পে। এরপর ১৯৫৮ সালে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে। 

এরপর ১৯৬৫ সালে টঙ্গীর পাগারে এবং সর্বশেষ ১৯৬৬ সালে টঙ্গীর ভবেরপাড়া তুরাগ তীরে অনুষ্ঠিত হয়। সেই থেকে এ পর্যন্ত সেখানেই ১৬০ একর জায়গায় তাবলিগের সর্ববৃহৎ ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এখানে বলা প্রয়োজন, তাবলিগ জামাতের সদর দফতর দিল্লিতে থাকা সত্ত্বেও এর বার্ষিক সমাবেশের জন্য বাংলাদেশকে বেছে নেওয়া হয়। ভারতের মুম্বাই ও ভূপালে এবং পাকিস্তানের রায়বেন্ডে বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হলেও জনসমাগমের বিচারে টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমাই বড় এবং বিশ্ব দরবারে বিশ্ব ইজতেমা বলতে বাংলাদেশের টঙ্গীতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ইজতেমাকেই বুঝায়।

যখন বাংলাদেশে তাবলিগ জামাতের প্রচেষ্টা শুরু হয়, তখন এর নাম ছিল শুধুই ইজতেমা, যা অনুষ্ঠিত হতো ঢাকার কাকরাইল মসজিদে। ১৯৬৪ সালে কাকরাইলে সর্বপ্রথম বাংলাদেশের ইজতেমা শুরু হয়। ১৯৫৮ সালে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে, এরপর ১৯৬৫ সালে টঙ্গীর পাগারে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। তখন থেকে ধীরে ধীরে এগোতে এগোতেই আজকের টঙ্গীতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ইজতেমা। যে ইজতেমায় অংশগ্রহণ করে বিশ্বের প্রায় একশটি রাষ্ট্রের তাবলিগ প্রতিনিধিরা। 

শিল্পনগরী টঙ্গীতে ইজতেমাকে স্থানান্তরিত করা হয় ১৯৬৬ সালে। আর সেই বছর থেকেই তাবলিগ জামাতের এই মহাসম্মেলন ‘বিশ্ব ইজতেমা’ নামে খ্যাতি অর্জন করে। মুসলিম উম্মাহর সর্ববৃহৎ সম্মিলন হজে যেমন বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তের মুসলমানদের সম্প্রীতি, সৌহার্দের অভাবনীয় নজির দেখা যায়, বাংলাদেশের বিশ্ব ইজতেমায়ও দেখা যায় মুসলিম ঐক্যের অপূর্ব এক মিলনমেলা। ফলে পুণ্যভূমি মক্কা-মদিনার পর তুরাগতীরে অবস্থিত টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমা পরিচিতি লাভ করে বিশ্ব মুসলিমের দ্বিতীয় বৃহত্তম মিলনকেন্দ্র হিসেবে।

যতটুকু জানা যায়, ইজতেমা নিয়ন্ত্রণকারী তাবলিগ জামাতের কোনো সংবিধান নেই। অলিখিত সংবিধানও নেই। তারপরও এ আন্দোলন মুসলিম বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এবং সুশৃঙ্খল আন্দোলন। তাবলিগ জামাতের একটি কেন্দ্রীয় কমিটি আছে। এটিকে বলা হয় মজলিসে শুরা। এ কমিটির কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় না। তাবলিগে যারা অপেক্ষাকৃত বেশি অবদান রেখেছেন, তারাই এ কমিটির আলোচনায় কথাবার্তা বলেন। তবে কে কত বেশি অবদান রেখেছেন, তা নির্ধারণের কোনো মাপকাঠি নেই। তাবলিগ আন্দোলনে ক্ষমতা বা পদমর্যাদার কোনো প্রতিযোগিতা নেই, প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই। 

নেতৃত্বের কোন্দল নেই। যিনি একবার কেন্দ্রীয় শুরায় আমির নির্বাচিত হন, তিনি আমৃত্যু সে পদ অলঙ্কৃত করেন। তাবলিগ অনুসারীরা তাদের আমিরকে সম্বোধন করেন ‘হজরত জী’ বলে। ঢাকা মহানগরীতে অবস্থিত কাকরাইল মসজিদ বাংলাদেশ তাবলিগ জামাতের কেন্দ্রীয় কার্যালয় বা হেডকোয়ার্টার। তাই আমরা বিশ্বব্যাপী দ্বীনি এই মেহনতের বিভক্তি চাই না। এই আন্দোলনে যেন রাজনীতির আঁচড় না লাগে। সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হযরত মুহম্মদ (স.) সর্বশেষ নবী। দ্বীন প্রচারের এই দায়িত্ব তিনি তার উম্মতের ওপর দিয়ে গেছেন। সেই দায়িত্ব পালনে আসুন, আমরা ঐক্যবদ্ধ হই।

লেখক: সম্পাদক ও প্রকাশক

বিডি প্রতিদিন/আরাফাত

সর্বশেষ খবর