৩ ডিসেম্বর, ২০২১ ১১:১৮

যুব রাজনীতির আইকন শহীদ শেখ ফজলুল হক মণি

মানিক লাল ঘোষ

যুব রাজনীতির আইকন শহীদ শেখ ফজলুল হক মণি

শেখ ফজলুল হক মণি

শেখ ফজলুল হক মণি বাংলাদেশের মহান ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা সংগ্রাম পর্যন্ত প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে জড়িয়ে থাকা এক সংগ্রামী মানুষের নাম। তাঁর হাত ধরেই রোপিত হয়েছিল এই দেশে যুব রাজনীতির বীজ। এই প্রজন্মের অনেকের কাছেই তাঁর নামটি আজ অজানা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ইতিহাস থেকে যেভাবে মুছে ফেলার ষড়যন্ত্র হয়েছিল বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে, তারই ধারাবাহিকতার শিকার যুব রাজনীতির অহংকার শেখ মণি।

যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনে যুব সমাজকে কর্মক্ষম সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে যুব সমাজের ওপরই সবচেয়ে ভরসা বেশি ছিলো বঙ্গবন্ধুর। তাঁর সেই স্বপ্ন পূরণে মণির মাঝে তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন এমন সম্ভাবনাকে, যা সমাজের আশা-আকাঙ্খা বাস্তবায়ন করতে পারবে এবং তাদের মুখের ও চোখের ভাষা বুঝতে পারবে। ১৯৭২ সালে ১১ নভেম্বর বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায় বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ প্রতিষ্ঠা করেন শেখ ফজলুল হক মণি। দায়িত্ব গ্রহণ করেন সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যানের।

যুব সমাজকে সুসংগঠিত করে আদর্শিক নেতৃত্ব প্রদানে বঙ্গবন্ধুর আস্থা ও বিশ্বাসের পরিপূর্ণ মর্যাদা রাখেন শেখ ফজলুল হক মণি। দক্ষতা, সততা, আন্তরিকতা, রাজনৈতিক বিচক্ষণতায় খুব অল্প দিনের মধ্যেই তিনি পরিণত হন যুব সমাজের আইকনে, আর তাঁর হাতে গড়া আওয়ামী যুবলীগ পরিণত হয় এদেশের  যুব সমাজের ভালোবাসা ও প্রাণের সংগঠনে।

বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতি ও অধিকার আন্দোলনের নক্ষত্র, অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাঙালি, জাতীয়তাবাদ আন্দোলনের সৃজনশীল যুবনেতা, বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী শেখ ফজলুল হক মণি ১৯৩৯ সালের ৪ ডিসেম্বর টুঙ্গিপাড়ার ঐতিহাসিক শেখ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা মরহুম শেখ নুরুল হক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভগ্নিপতি। মা শেখ আছিয়া বেগম বঙ্গবন্ধুর বড় বোন।

ঢাকার নবকুমার ইনিস্টিটিউট থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষার পাশ করেন শেখ ফজলুল হক মণি। ১৯৫৮ সালে জগন্নাথ কলেজ থেকে উত্তীর্ণ হন উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায়। ১৯৬০ সালে বরিশাল বিএম কলেজ থেকে লাভ করেন বিএ ডিগ্রী। ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন প্রতিভাবান এই তরুণ। ষাটের দশকে সামরিক শাসন বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন শেখ ফজলুল হক মণি। ১৯৬০-৬৩ সাাল পর্যন্ত ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ১৯৬২ সালে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের বিরূদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ায় গ্রেফতার হন এবং ৬ মাস কারাভোগ করেন। ১৯৬৪ সালের এপ্রিল মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর ও পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর আবদুল মোনেম খানের কাছ থেকে সনদ গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান এবং সরকারের গণবিরোধী শিক্ষানীতির প্রতিবাদে, সমাবর্তন বর্জন আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। এ কারণে তাঁর ডিগ্রী প্রত্যাহার করে নেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। পরে মামলায় জিতে ডিগ্রী ফেরত পান শেখ ফজুলল হক মণি। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তানে নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার হন এবং দেড় বছর কারাভোগ করেন এই সাহসী তরুণ। শেখ মণির জীবনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ও অর্জন ১৯৬৬ সালের ৭ জুন ৬ দফার পক্ষে হরতাল সফল করা। বঙ্গবন্ধু তখন কারাগারে। আন্দোলনকে বেগবান ও মুক্তি সংগ্রামকে ত্বরান্বিত করতে হরতাল সফলের আর কোনো বিকল্প ছিল না মুক্তিকামী বাঙালির কাছে। তখন ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের শ্রমিকদের হরতালের সমর্থনে ঐক্যবদ্ধ করেন তরুণ সমাজের এই আইকন। এই হরতাল পালনের মধ্য দিয়ে নতুন করে জাগরণ ও প্রেরণার সৃষ্টি হয় বাঙালির মনে। ১৯৬৬ সালে ছয় দফা আন্দোলনে সাহসী ও অগ্রণী ভূমিকা পালনের দায়ে তাঁর বিরূদ্ধে হুলিয়া জারি হয় এবং তিনি গ্রেফতার হন। একই সময়ে নানা অভিযোগে আরো ৮ টি মামলার আসামি করা হয় শেখ ফজলুল হক মণিকে। ১৯৬৯ সালে গণআন্দোলনের সময় মুক্তি দেয়া হয় তাঁকে।

রাজনীতিতে অত্যন্ত নির্লোভ ছিলেন তিনি। নিজে নির্বাচনে অংশ না নিয়ে ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের কর্মসূচি প্রণয়নের অন্যতম প্রণেতা ছিলেন শেখ ফজলুল হক মণি। সমাজতান্ত্রিক চিন্তা চেতনায় বিশ্বাসী শেখ মণি সত্তরের নির্বাচনী কর্মসূচিতে পাকিস্তানের প্রতিটি প্রদেশকে ৬ দফাভিত্তিক স্বায়ত্বশাসন, ব্যাংক বীমা ও ভারী শিল্প, বৈদেশিক বাণিজ্য, পাট ও তুলা ব্যবসা জাতীয়করণ, পূর্ব পাকিস্তানের জায়গিরদারি, জমিদারী ও সর্দারী প্রথার উচ্ছেদ, ২৫ বিঘা পর্যন্ত কৃষি জমির খাজনা মওকুফ, শ্রমিকদের ভারী শিল্পের শতকরা ২৫ ভাগ শেয়ার ও বাস্তুহারাদের পুনর্বাসন সাধারণ জনগণের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকার দেন। নিষ্পেষিত, অধিকার বঞ্চিত মুক্তিকামী বাঙালিকে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ করতে বঙ্গবন্ধু যে দূরদর্শী নেতৃত্ব দিয়েছেন তার ধারাবাহিক আন্দোলন-সংগ্রামে অন্যন্য ভূমিকা রেখেছেন শেখ ফজলুল হক মণি। তিনি ছিলেন মুজিববাহিনীর অধিনায়ক, মুুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। শেখ ফজলুল হক মণি শুধু রাজনীতিতে নয়, তাঁর সুনাম জড়িয়ে আছে এদেশের সাহিত্য জগতে। গণসচেতনতার আলো ছড়িয়েছেন তিনি সাংবাদিকতার মহান পেশাতেও। বহুল প্রচারিত ও পাঠক সমাদৃত দৈনিক বাংলার বাণী, ইংরেজী দৈনিক বাংলাদেশ টাইমস ও বিনোদন ম্যাগাজিন সিনেমার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। শেখ ফজলুল হক মণির লেখা "অবাঞ্ছিতা" উপন্যাস ব্যাপক পাঠক সমাদৃত তৎকালীন সময়ে।
 
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যার রাতে ঘাতকদের নিষ্ঠুরতার শিকার হন  স্ত্রীসহ বাঙালির যুব সমাজের আইকন। মহান স্রষ্টার অশেষ কৃপায় প্রাণে বেঁচে যান তাঁর দুই শিশুপুত্র শেখ ফজলে শামস পরশ ও শেখ ফজলে নূর তাপস। শেখ মণির সুযোগ্য সন্তান শেখ পরশ আজ তাঁর পিতার হাতে গড়া যুব সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের চেয়ারম্যান। আরেক ছেলে শেখ তাপস নান্দনিক ঢাকা নগরী গড়ে নতোলার স্বপ্নচারী ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র।

পিতার মতোই নির্লোভ, সাহসী ও কর্মদক্ষতার সাক্ষর রেখে চলেছেনে শেখ মণির দুই পুত্র। সততার পথে, চেতনার পথে অবিচল থেকে এগিয়ে চলছেন তাঁরা। শেখ পরশ ও শেখ তাপসের মাঝে এদেশের যুব সমাজ খুঁজে পায় তাদের আইকন শেখ ফজলুল হক মণিকে। তিনি বেঁচে থাকুক তারুণ্য, মেধা ও মননে দেশপ্রেমের আইকন হিসেবে যুব সমাজের মণিকোঠায়। বিনম্র শ্রদ্ধা তাঁর স্মৃতির প্রতি।

বিডি প্রতিদিন/ সালাহ উদ্দীন

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর