মানুষের জীবনমান উন্নয়নের প্রথম শর্তই হচ্ছে কর্মসংস্থান। এ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগের মাধ্যমে ব্যবসাবাণিজ্য, শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠা ও উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে বেসরকারি বিনিয়োগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে বেসরকারি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কয়েক বছর ধরে অত্যন্ত মন্দাবস্থা চলছে। বিনিয়োগ নেই বললেই চলে। বিনিয়োগে উদ্যোক্তারা দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে রয়েছেন। এর কারণ হিসেবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর বিনিয়োগকারীরা দেশের পরিস্থিতি কোন দিকে যায়, এ নিয়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছেন। তারা অপেক্ষা ও পর্যবেক্ষণ নীতি অবলম্বন করছেন। ফলে বিনিয়োগ কমে গেছে। এতে অনেক শ্রমিক-কর্মকর্তা বেকার হয়ে পড়েছেন। এর চাপ অর্থনীতিতে পড়ছে। মূল্যস্ফীতি দারিদ্র্যকে বাড়িয়ে দিয়েছে।
বলাবাহুল্য মূল্যস্ফীতির কারণে জিনিসপত্রের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাওয়ায় তাদের জীবনযাপন দুরূহ হয়ে পড়েছে। আয়ের সঙ্গে ব্যয় সংকুলান করতে পারছে না। এ অবস্থা উত্তরণে কার্যকর কোনো পদক্ষেপও দেখা যাচ্ছে না। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়ে অর্থনীতি পুনর্গঠনে মনোযোগ দিলেও তার সুফল সাধারণ মানুষ পাচ্ছে না। রিজার্ভ, রেমিট্যান্স বৃদ্ধি এবং বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা বাড়াতে পারলেও বেসরকারি বিনিয়োগের পরিবেশ ও নিত্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। এ ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার সংকট রয়েছে।
জিনিসপত্রের দাম কমানো থেকে শুরু করে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করা, বেকারত্ব দূরীকরণে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া যায়, তা সরকারের নীতিনির্ধারকরা ভাবতে হবে। তবে মানুষের অভাব-অনটনের এই সময়ে বেকারত্ব কমাতে সরকারের কিছু উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। প্রয়োজনীয় ও জনগণের উপকারে আসে এমন প্রকল্প নিয়ে বেকারদের কাজে লাগানো যেতে পারে। সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ না থাকলে দেশের অর্থনীতি সচল থাকে না। বিনিয়োগের সঙ্গে কর্মসংস্থান, উৎপাদন ব্যবস্থা গতিশীল হওয়া, মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন ইত্যাদি জড়িয়ে থাকে। অর্থনীতিতে প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়।
বর্তমানে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমেছে। দেশের অবনতিশীল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি, গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকট, সরকারের সিদ্ধান্তের অনিশ্চয়তা প্রভৃতির কারণে ব্যবসায়ীরা হাত গুটিয়ে বসে আছেন। তারা অপেক্ষা করছেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীল পরিস্থিতির জন্য। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা চক্রান্তের মধ্য দিয়ে আমরা গণতন্ত্রের পথে হাঁটছি। গণতন্ত্রের যে আরও শর্ত আছে, অর্থাৎ সুষ্ঠু নির্বাচনের দিকে হাঁটতে হবে। প্রয়োজনীয় যে সংস্কার, আমাদের জাতীয় সংসদ, সংবিধান, জনপ্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন সবকিছুতে সংস্কার দরকার। কিন্তু সংস্কারের নামে কালক্ষেপণ করে এটা নিয়ে তর্কবিতর্ক করলে হবে না। দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশে প্রতিনিয়ত অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে। কখন কোন ঘটনা ঘটবে, তার নিশ্চয়তা নেই। সরকারও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণসহ মানুষের মধ্যকার অনিরাপত্তাবোধ দূর করতে পারছে না। এমন পরিস্থিতিতে দেশিবিদেশি বিনিয়োগকারীদের উৎসাহী হওয়ার কারণ নেই। অর্থনৈতিক সংকট সাধারণ মানুষের মধ্যে তীব্র আকার ধারণ করেছে। অভাব-অনটনে অনেকের সংসার চালানো দায় হয়ে পড়েছে। কর্মসংস্থানের অভাবে যুবসমাজের মধ্যে হতাশার জন্ম নিচ্ছে। হতাশা থেকে অনেকে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানিতে জড়িয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাচ্ছে। এ ধরনের পরিবেশে দেশিবিদেশি বিনিয়োগকারীরা ভরসা পাচ্ছেন না। অনেক কারখানায় শ্রমিক-কর্মকর্তা ছাঁটাই করা হচ্ছে। এতে বেকারত্বের হার বাড়ছে। দেশের আইনশৃঙ্খলার জন্য নতুন আতঙ্ক বেকার হওয়া শ্রমিকরা। তাদের অনেকে চুরি, ছিনতাই ও প্রতারণার মতো অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছেন বলে পুলিশ জানিয়েছে। গত ছয় মাসে শুধু গাজীপুর মেট্রোপলিটন এলাকা থেকে ১ হাজার ৬০০ ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তার মধ্যে ৮ শতাধিক হচ্ছে বন্ধ হয়ে যাওয়া গার্মেন্ট ও অন্যান্য কারখানার বেকার শ্রমিক।
এ মুহূর্তে সরকারের প্রধান কাজ হচ্ছে, যতটা সম্ভব অর্থনীতির উন্নয়নে সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া। যেসব কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, তা খুলে দেওয়ার জন্য যে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন, তা নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, অর্থনীতি সচল থাকলে সচল থাকবে বাংলাদেশ।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও প্রাক্তন প্রিন্সিপাল, এম এইচ খান ডিগ্রি কলেজ, গোপালগঞ্জ
বিডি প্রতিদিন/এমআই