গৃহকর্মী, পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও নার্সিং পেশাসহ সংযুক্ত আরব আমিরাতে প্রায় লক্ষাধিক নারী শ্রমিক কাজ করছেন। প্রতিদিন প্রায় ৫০০ নারী শ্রমিক নতুন ভিসা নিয়ে পাড়ি জমান মধ্যপ্রাচ্যের এ দেশটিতে। বাড়িঘর, গয়নাসহ শেষ সম্বলটুকু বিক্রি করে উন্নত জীবনযাপনের আশায় এ দেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। কিন্তু আশানরুপ কাজ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তারা। কাজ এবং থাকা পরিবেশ প্রতিকূল হওয়ায় অনেকেই পালিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। প্রতি মুহূর্তেই তাদের মধ্যে গ্রেফতার হওয়ার ভয় কাজ করছে। অথচ দেশেও ফিরতে পারছেন না দেনাদারের ভয়ে।
তেমনই একজন আছিয়া বেগম। উত্তর আমিরাতের একটি দ্বিতল ভবনের থাকেন তিনি। কলিংবেল চাপতেই রুমের দরজা খুলে দেন একজন ভদ্রমহিলা। ভেতরে তিনটি রুম। একটি গোছানো, বাকিগুলোতে এলোমেলো আসবাবপত্র। কোনো কোনো রুমে তিন-চারটি চকি। এখানেই ভাড়া থাকেন ঝিনাইদহের আছিয়া। শুধু আছিয়াই নয়, বাড়িটির অন্য রুমগুলোতেও আছিয়ার মতো শ্রমিকরা ভাড়ায় থাকেন।
পুরো নাম আছিয়া বেগম হলেও পাসপোর্টে তারা নাম শারমিন। প্রথম পাসপোর্ট বাতিল হয়ে যাওয়ায় নাম পরিবর্তন করতে হয় তাকে। আমিরাতের ভিসা পান ২০১৫ সালে। গৃহকর্মী হিসেবে আমিরাতে আসলেও সেখানে কাজের সুযোগ হয়েছে মাত্র নয় দিন। এরপর শুরু হয় পালিয়ে বাঁচিয়ে থাকার জীবন। বর্ণনা দিতে গিয়ে মাঝে মাঝে থমকে যান আছিয়া। বললেন, '১২ লাখ টাকা ঋণ হয়ে গেছে। স্বামী বিদেশ পাঠাইছে। এত টাকা কিভাবে শোধ করবো? বাড়ি বিক্রি করে দিছি। যশোর থেকে পাসপোর্ট করছি প্রথমে, সেটা বাবা-মা আটকে দিলে ঢাকায় চলে আসি। ঢাকায় ছয়মাস থেকে নতুন পাসপোর্ট করি। এক লাখ ২০ হাজার টাকায় পাই আমিরাতের ভিসা। একা একা আসি ঢাকা বিমানবন্দর, সেখান থেকে আমিরাত। কাজে গিয়ে ছিলাম মাত্র সাত দিন। দেখি সেখানে অনেক কষ্ট। থাকতে দিতো বেলকনিতে। প্রচণ্ড রোদ, গরমে কি থাকা যায়! খাবার দেয় না। মালিকও খুব খারাপ! তাই পলাইছি! অনেক কান্নাকাটি করেও দেশে যাই নাই। অনেক টাকা ঋণ। দেশে গেলে, ঋণওয়ালারা আটকাবে। বলবো ঋণ শোধ করে যাও।' বলতে বলতে মলিন হয়ে যায় আছিয়ার মুখ। থেমে থেমে আবার বলতে শুরু করেন, 'ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিছি, এখন পার্টটাইম করি। ধরা খাইলে দেশে যাবো! আস্তে আস্তে ঋণ শোধ করতেছি। দুইটা মেয়ে আছে, তাদের দিকেও তো তাকাতে হয়!'
আছিয়ার মতো সতমেহের আমিরাতে আছেন প্রায় আড়াই বছর। বাড়ি নারায়ণগঞ্জ। আমিরাতে আছেন একটি ম্যানপাওয়ার কোম্পানিতে। কাজ পান গৃহকর্মীর। বেতন ছয়শত দিরহাম। বাংলাদেশি টাকায় মূল্য ১২ হাজার। অথচ ভিসার খরচ পড়েছে প্রায় এক লাখ টাকা। তার ভাষ্য মতে, 'এখন অফিসের ভিসায় আসছি, তার জন্য এত পরিমাণ খরচ হয় নাই। তারপরও এক লাখ টাকা উপরে চলিয়া গেছে। ছাগল পালছি, মুরগি পালছি, হাঁস পালছি, সবই বিক্রি করলাম। লাভের উপর টাকা ওঠাইলাম, সামান্য গয়নার জিনিস ছিল তাও বন্ধক দিলাম। সব মিলাই এক লাখ টাকা দিয়া বিদেশ আইলাম। ছয়শ দিরহাম বেতন। তাকি মোবাইলে খচ্চ করবো না বাড়িতে পাঠাবো, না ঋণ শোধ করবো! আর খাওয়া-থাকার তো খুবই কষ্ট! এমন পরিস্থিতি থেকে বাঁচার জন্য পালাতে হলো। পলাই আসার পরে অনেক কষ্ট, কাম পাওয়া যায় না, রুম পাইতে কষ্ট! পরে কাম মিললো, রুমও মিললো। সবটাই কষ্ট, কষ্ট ছাড়া কি আর বিদেশ হয়! এখন বাসায় বাসায় পার্ট টাইম করি আর জেল খাটা ছাড়া দেশে যাবার চিন্তা করি।’
আছিয়া, সতমেহেরদের মতো একই বাসায় থাকেন ঢাকার আঁখি, যশোরের আসমা, দোহার হোসনেয়ারা, শিল্পি ও ঢাকার বকুল। শুধু এরা নয়, এমন হাজারও নারী শ্রমিকের ভাগ্য এমনই। এরা সবাই কোনো না কোনোভাবে পালিয়েছেন কর্মস্থল থেকে। এখন সারাদিন এ বাসা ও বাসা খুঁজে খুঁজে কাজ করেন আর অজানা এক শঙ্কা-আতঙ্কে কাটান বাকিটা সময়। নিজের পরিবার-পরিজনের মুখে একটুখানি হাসি দেখতেই এরা দিনের পর দিন শ্রম-ঘাম বিলিয়ে যাচ্ছেন আমিরাতে।
জানতে চেয়ে দুবাই কনস্যুলেটের কনসাল জেনারেল এস. বদিরুজ্জামানের সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎ করলে তিনি পূর্বে এপয়েন্টমেন্ট না থাকার অজুহাতে কথা বলতে রাজি হননি। তবে এসব নারী শ্রমিকদের নিয়ে কথা হলে দুবাই বাংলাদেশ কনস্যুলেটের উর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, ‘নারী শ্রমিকদের এসব ব্যাপারগুলো আমরা জানি। তারা অর্থনৈতিক চিন্তা করেই কর্মস্থল থেকে পালিয়ে যায়। আনঅফিসিয়ালি এদের অনেক তথ্যই আমাদের কাছে আছে, যা স্বাভাবিকভাবে সবাই জানে। তবে শেষ মুহূর্তে আউটপাসের মাধ্যমে এরা দেশে যাবার সুযোগ পায়। আপাতত যতো টাকা আয় করতে পারে, সেটি দেশের ও তার পরিবারের জন্যেই মঙ্গল।’
বিডি প্রতিদিন/৩ মে, ২০১৭/ফারজানা