সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাতের ধারা পরিবর্তিত হয়েছে। ২০২০ সালে করোনা মহামারির পর সবকিছু পাল্টে গেছে। ওই সময় দেশের ব্যাংকব্যবস্থায় ইন্টারনেট ব্যবহারের হার বেড়েছে। এরপর ধারাবাহিকভাবে মোবাইল অ্যাপভিত্তিক এবং ইন্টারনেট ব্যাংকিং লেনদেনের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের জুনে দেশের অনলাইন ব্যাংকিং ব্যবহারকারী গ্রাহক ছিলেন ১ কোটি ১৩ লাখ ৬৬ হাজার ৫৬৩ জন। জুলাইয়ে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ১৬ লাখ ৪২ হাজার ৫৯৪-এ। এক মাসের ব্যবধানে গ্রাহক বেড়েছে ২ লাখ ৭৬ হাজার ৩১ জন। একই সময়ে লেনদেনের পরিমাণ জুনে ১ লাখ ৪ হাজার ৯৩৫ কোটি থেকে জুলাইয়ে বৃদ্ধি পেয়ে ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৭০ কোটি টাকায় পৌঁছেছে।
দেশের ব্যাংকগুলোর মধ্যে অ্যাপভিত্তিক লেনদেনে সবচেয়ে জনপ্রিয় হলো ইসলামী ব্যাংকের সেলফিন অ্যাপ। সেলফিনের গ্রাহকসংখ্যা বর্তমানে ৫৫ লাখের বেশি। প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২ লাখ লেনদেন সম্পন্ন হচ্ছে, যার আর্থিক মূল্য প্রায় ৬০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া ব্র্যাক ব্যাংকের ‘আস্থা অ্যাপ’ ১০ লাখ গ্রাহক অতিক্রম করেছে। চলতি বছরের জুলাইয়ে এ অ্যাপের মাধ্যমে লেনদেনের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২০ হাজার কোটি টাকা, যা দেশের ব্যাংকিং খাতে অ্যাপভিত্তিক মাসিক লেনদেনের নতুন রেকর্ড। চালুর পর থেকে এখন পর্যন্ত ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি লেনদেন সম্পন্ন হয়েছে, যা ১ কোটি ১২ লক্ষাধিক ট্রান্সঅ্যাকশনের সমান। বর্তমানে প্রায় ৩ লাখ গ্রাহক নিয়মিত এ অ্যাপ ব্যবহার করছেন।
সিটি ব্যাংকের ‘সিটিটাচ অ্যাপ’ বর্তমানে ৯ লাখের বেশি গ্রাহক ব্যবহার করছেন। প্রতিদিন এ অ্যাপের মাধ্যমে প্রায় ১ লাখ লেনদেন সম্পন্ন হয়, যার মোট পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ৪০০ কোটির বেশি টাকা। অ্যাপ ও ইন্টারনেট ব্যাংকিং ব্যবহারকারীরা ঘরে বসেই সুবিধাজনকভাবে টাকা স্থানান্তর, হিসাব যাচাই, বিল পরিশোধ, মোবাইল রিচার্জ, টিকিট কেনা, কার্ডের বিল পরিশোধ এবং সঞ্চয়ী হিসাব পরিচালনা করতে পারছেন। বিকাশ, নগদ, রকেট এবং অন্যান্য এমএফএসের পাশাপাশি অ্যাপভিত্তিক ব্যাংকিং এখন শহর ও গ্রাম উভয় এলাকার মানুষের দৈনন্দিন আর্থিক প্রয়োজন মেটাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানান, ‘তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশ এবং অনলাইনের প্রতি গ্রাহকের আস্থা বৃদ্ধির কারণে ইন্টারনেট ব্যাংকিং এবং অ্যাপভিত্তিক লেনদেনের সংখ্যা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেক গ্রাহক শারীরিকভাবে ব্যাংকে না গিয়ে অনলাইনের মাধ্যম বেছে নিচ্ছেন। এ ধারা ভবিষ্যতে আরও প্রসারিত হবে।’
দেশের ব্যাংকিং খাতে অ্যাপভিত্তিক সেবার বিস্তার একদিকে গ্রাহকের সময় ও খরচ বাঁচাচ্ছে, অন্যদিকে নগদ ব্যবহারের চাপও কমাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডিজিটাল ব্যাংকিং কেবল শহুরে বিলাসিতা নয়, এটি লাখো মানুষের দৈনন্দিন আর্থিক চাহিদার অপরিহার্য অংশে পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, দেশের ব্যাংকগুলোয় বর্তমানে প্রায় ৮০ লাখ গ্রাহক ইন্টারনেট ব্যাংকিং ও অ্যাপ ব্যবহার করছেন। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংকের সেলফিন, ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের নেক্সাস পে, সিটি ব্যাংকের সিটিটাচ, ব্র্যাক ব্যাংকের আস্থা, ইস্টার্ন ব্যাংকের স্কাই ব্যাংকিং, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের ইন্টারনেট ব্যাংকিং, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমটিবি নিও স্মার্ট এবং ঢাকা ব্যাংকের অ্যাপ উল্লেখযোগ্য জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে অ্যাপভিত্তিক ব্যাংকিং বাংলাদেশের আর্থিক খাত আরও স্বচ্ছ, নিরাপদ এবং জনবান্ধব করবে। গ্রাহক ও লেনদেনের বৃদ্ধি প্রমাণ করছে ডিজিটাল ব্যাংকিং এখন শুধু বিকল্প নয়, বরং বাংলাদেশের মানুষের প্রতিদিনের প্রয়োজনীয়তা হয়ে উঠেছে। কারণ অ্যাপের মাধ্যমে গ্রাহক এনপিএসবি, বিইএফটিএন, ভিসা ডিরেক্ট ও আরটিজিএস ব্যবহার করে সহজেই ফান্ড ট্রান্সফার করতে পারছেন। একই সঙ্গে কার্ডবিহীন এটিএম উত্তোলন, ইউটিলিটি বিল পরিশোধ, মোবাইল রিচার্জ, এফডিআর ও ডিপিএস খোলা কিংবা ভাঙানো এবং শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের সুযোগ থাকছে। এ বিষয়ে ব্র্যাক ব্যাংকের চিফ ডিজিটাল অফিসার মো. মোকাররবীন মান্নান বলেন, ‘গ্রাহক শাখায় না গিয়ে ঘরে বসেই ২৪/৭ ব্যাংকিং করতে পারছেন। এতে শাখার চাপ কমছে, খরচও কমছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো গ্রাহককে ক্ষমতায়ন করা যাচ্ছে। তিনি যখন যেভাবে চাইছেন, তখনই লেনদেন করতে পারছেন।’
তিনি আরও বলেন, শুধু আর্থিক লেনদেন নয়, অ্যাপ এখন একটি পূর্ণাঙ্গ লাইফস্টাইল প্ল্যাটফর্ম। অ্যাপের মাধ্যমে বাসের টিকিট বুকিং, ই-পেপার পড়া, কনটেন্ট স্ট্রিমিং, অডিও বুক, সংগীত শোনা ও বিভিন্ন ইসলামি কনটেন্ট পাওয়া যাচ্ছে।