আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) মো. রাফাত উল্লাহ খান বলেছেন, দেশের ব্যাংকিং খাতে গত কয়েক বছরে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এসেছে অ্যাপ ও অনলাইনভিত্তিক লেনদেনের মাধ্যমে। গ্রাহকরা এখন আর শাখা বা এটিএমনির্ভর নন; তারা যে কোনো সময়, যে কোনো স্থান থেকে নিরাপদে লেনদেন করতে পারছেন। বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকও এ পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শরিয়াহসম্মত ডিজিটাল সেবা চালু করেছে। ব্যাংকের ইন্টারনেট ব্যাংকিং অ্যাপ ও ইসলামিক ওয়ালেটের মাধ্যমে গ্রাহকরা সহজে টাকা স্থানান্তর, বিল প্রদান, মোবাইল রিচার্জসহ নানান সেবা পাচ্ছেন। এতে গ্রাহকরা শাখানির্ভরতা কমিয়ে সময় ও খরচ সাশ্রয় করছেন এবং ব্যাংক কর্মকর্তারা এখন রিলেশনশিপ ব্যাংকিং ও পরামর্শমূলক সেবায় বেশি মনোযোগ দিতে পারছেন।
রাফাত উল্লাহ খান বলেন, স্মার্টফোন, ৫জি প্রযুক্তি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (অও) এবং ফিনটেক খাতের অগ্রগতির কারণে সেলফ সার্ভিস ব্যাংকিংয়ের ভবিষ্যৎ অত্যন্ত উজ্জ্বল। গবেষণা অনুযায়ী, ২০২৮ সালের মধ্যে ডিজিটাল ব্যাংকিং প্রচলিত ব্যাংকিংয়ের তুলনায় তিন গুণ দ্রুত বৃদ্ধি পাবে।
তিনি বলেন, গ্রাহকরা এখন ই-কেওয়াইসির মাধ্যমে নিজের অ্যাকাউন্ট খুলছেন, ডিজিটালি বিনিয়োগ নিচ্ছেন, ক্রেডিট কার্ডের জন্য আবেদন করছেন। আগামী দিনে অ্যাপ কেবল লেনদেনের মাধ্যম নয়, বরং গ্রাহকের ব্যক্তিগত ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাডভাইজর হিসেবে কাজ করবে। বায়োমেট্রিক ও ভয়েস ব্যাংকিং চালু হলে কেবল কণ্ঠস্বর বা আঙুলের ছোঁয়ায় লেনদেন সম্ভব হবে।
তিনি আরও বলেন, বিশ্বব্যাপী সুপার অ্যাপের প্রবণতা অনুসারে বাংলাদেশেও অ্যাপের মাধ্যমে ব্যাংকিং, ই-কমার্স, ফুড অর্ডার, রাইড শেয়ারিং, স্বাস্থ্যসেবা সবই সম্ভব হবে। সেলফ সার্ভিস ব্যাংকিং তাই উজ্জ্বল ও অবশ্যম্ভাবী। যেমনটি অন্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে হয়, ব্যাংকিং অ্যাপেও কিছু ঝুঁকি রয়েছে। তবে নিরাপত্তা ও সচেতনতা বৃদ্ধি করার জন্য ব্যাংকগুলো ইতোমধ্যে মাল্টিলেভেল অথেনটিকেশন, এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপশন, এআই-ভিত্তিক ফ্রড ডিটেকশন চালু করেছে।
আল-আরাফাহ্ ব্যাংকের এমডি বলেন, কিছু গ্রাহক এখনো ওটিপি, কার্ড নম্বর, সিভিভি বা এক্সপায়ারি ডেট শেয়ার করার মাধ্যমে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। এ ছাড়া সহজ বা অনুমানযোগ্য পাসওয়ার্ড ব্যবহার ও একই পাসওয়ার্ড বিভিন্ন জায়গায় প্রয়োগও ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। ব্যাংক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য এসএমস, ইমেইল, সমাজমাধ্যমে ভিডিও ও পোস্ট প্রচার, শাখা পর্যায়ে প্রশিক্ষণ চালাচ্ছে। পাশাপাশি প্রতিটি লেনদেনের সঙ্গে এসএমস পুশ নোটিফিকেশন, এআই ফ্রড মনিটরিং, দৈনিক ও মাসিক লেনদেনসীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। ফলে প্রযুক্তি ও সচেতনতাকে সমন্বিত করে গ্রাহকের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ে আস্থা আরও সুদৃঢ় হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে দেশে ইন্টারনেট ব্যাংকিং গ্রাহকসংখ্যা প্রায় ২ কোটি। মাসিক লেনদেনের পরিমাণ প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা। মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) গ্রাহক সংখ্যা প্রায় ১৫ কোটি এবং প্রতিদিন প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা লেনদেন সম্পন্ন হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের দৈনিক ডিজিটাল লেনদেন পৌঁছাবে ২০ থেকে ২৫ হাজার কোটি টাকায়, যা পুরো অর্থনীতির জন্য বৈপ্লবিক পরিবর্তন বয়ে আনবে।
ব্যাংকিং অ্যাপের মাধ্যমে গ্রাহকরা এখন পাচ্ছেন : ই-কেওয়াইসির মাধ্যমে ৫ মিনিটে অ্যাকাউন্ট খোলা। ব্যালান্স ইনকোয়ারি, মিনি স্টেটমেন্ট দেখা, স্টেটমেন্ট ডাউনলোড। ব্যাংক স্থানান্তর (ইএফটি, আরটিজিএস, এনপিএসবি)। মোবাইল ওয়ালেটে টাকা পাঠানো। বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি, ইন্টারনেট বিল পরিশোধ। মোবাইল রিচার্জ ও ডেটা প্যাক কেনা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ফি, পরীক্ষা ও ভর্তি ফি প্রদান। চেক বুক অর্ডার, চেক বাতিল। ঋণের মাসিক কিস্তি ও ক্রেডিট কার্ডের বিল পরিশোধ। ইসলামি টার্ম ডিপোজিট ও সঞ্চয়ী স্কিম, ডিজিটাল দানবক্স, কিউআর কোড পেমেন্ট। ফলে অ্যাপ কেবল লেনদেনের মাধ্যম নয়, বরং শরিয়াহসম্মত পূর্ণাঙ্গ আর্থিক ও লাইফস্টাইল প্ল্যাটফর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
তিনি বলেন, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক গ্রাহককেন্দ্রিক ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম গড়তে যাচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে : ই-টিকেটিং ও হোটেল বুকিং, জাকাত ও ট্যাক্স ক্যালকুলেটর। টেলিমেডিসিন ও ইসলামি শিক্ষা। অডিও বুক ও বিমা পলিসি কেনা। সুদমুক্ত ডিজিটাল বিনিয়োগ। এনএফসি বা কনট্যাক্টলেস পেমেন্ট চালু। এ উদ্যোগ কেবল ব্যাংকিং সহজ করবে না, বরং গ্রাহকের দৈনন্দিন জীবনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এ ছাড়া এটি ক্যাশলেস সমাজ ও স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনে জাতীয় অর্থনীতিকে আরও স্বচ্ছ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করবে।