দুই দলের কোথাও উচ্চবাচ্য নেই। দু পক্ষই নীরব। দূর থেকে সতর্ক চোখে পরস্পরকে মেপে নেওয়ার জোর চেষ্টা চলছে। কেউ জোর গলায় বলছে না, ওদের হারিয়েই দেব। ভারত-অস্ট্রেলিয়া সেমিফাইনাল নিয়ে যেমন 'মাইন্ড গেম' শুরু হয়েছে, তেমন কিছুই নেই। কিন্তু দুই দলের ক্রিকেটার এবং সমর্থকরা জানেন, ম্যাচ কতটা কঠিন হবে। একদিকে অতীতের সব ব্যর্থতা মুছে বিশ্বকাপ জয়ের অঙ্গীকার করা নিউজিল্যান্ড অন্যদিকে 'চোকার্স' শব্দের লেবেলটা ধ্বংস্তূপে নিক্ষেপ করতে বদ্ধপরিকর দক্ষিণ আফ্রিকা। শক্তির তুল্যমূল্যে সঠিক মাপ ক্রিকেটের সেরা বিশেষজ্ঞের পক্ষেও বর্ণনা করা সম্ভব নয়। তবে বহুদিনের পুরনো কথনে আজই যোগ হবে নতুনত্ব। নিউজিল্যান্ড আর দক্ষিণ আফ্রিকার যে কোনো একটা 'সেমিফাইনালিস্ট' দলের বদনাম ঘুচিয়ে 'ফাইনালিস্ট' দলে পরিণত হবে।
অকল্যান্ডের ইডেন পার্ক আকারে বেশ ছোট। ব্যাটিংটা এখানে দারুণ হয়। দলে যদি রানের চাকায় মুহূর্তে 'সাইক্লোন' গতি এনে দেওয়ার মতো ব্যাটসম্যান থাকে তবে তো কথাই নেই। প্রতিপক্ষ বোলারদের ওপর এমন তাণ্ডব চালানোর মতো দুয়েক জন করে ব্যাটসম্যান তো নিউজিল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকা দু দলেরই আছে। নিউজিল্যান্ডে যেমন অধিনায়ক ব্রেন্ডন ম্যাককালাম এবং গাপটিল দক্ষিণ আফ্রিকায় এবি ডি ভিলিয়ার্স এবং আমলা। তাদের ব্যাটিং তাণ্ডব মাঝেমধ্যেই বদলে দেয় ক্রিকেট ইতিহাসের গতিপথ। এইতো সেদিন কোয়ার্টার ফাইনালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ২৩৭ রানের এক বিধ্বংসী ইনিংস খেললেন মার্টিন গাপটিল। যে ইনিংসের মোহ থেকে এখনো বের হতে পারেনি ব্ল্যাক ক্যাপসরা। ঝড়ো-গতির ইনিংসের একটা নমুনা স্থাপন করেছেন এবি ডি ভিলিয়ার্সও। গ্রুপ পর্বে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ১০৩ বলে ১৬২ রানের এক দুরন্ত ইনিংস খেলেছিলেন প্রোটিয়া দলপতি।
ব্যাটিংয়ে দুই দলই ভালো করার ক্ষমতা রাখে। ফিল্ডিংয়েও দুই দলের ভুলচুক তেমন একটা হয় না। নিউজিল্যান্ড-দক্ষিণ আফ্রিকার মধ্যে ভেদ রেখা টানার একমাত্র উপকরণ বোলিং। অকল্যান্ডের ইডেন পার্কে যেমন বাউন্স থাকবে তেমনই থাকবে স্পিন। বোলিং লাইনে দুই দলেরই রয়েছে বিশ্বসেরা পেসার এবং স্পিনার। ডেল স্টেইন, অ্যাবোট কিংবা মরকেল যেমন গতির ঝড় তুলে ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে পারেন ব্ল্যাক ক্যাপস ব্যাটিং লাইনে তেমনি ট্রেন্ট বোল্ট এবং সাউদির একটা স্পেলই ধ্বংস্তূপে পরিণত করতে পারে দক্ষিণ আফ্রিকার বিশ্বসেরা ব্যাটিং লাইনকে। স্পিন আক্রমণেও দুই দলেরই রয়েছে বিশ্বসেরা দুই বোলার। আজ জয়-পরাজয়ের হিসেবে এই বোলাররাই হবেন চূড়ান্ত ফায়সালাকারী।
অতীত বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ড এবং দক্ষিণ আফ্রিকা সেমিফাইনাল রেখা পাড়ি দিতে পারেনি। এখানেই থামতে হয়েছিল তাদের পূর্বসূরিদের। এবার কারা স্পর্শ করতে যাচ্ছে ফাইনালের রেখা! নিউজিল্যান্ড দলের কোচ মাইক হেসন বলছেন, এবারের দলটা নাকি স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে ক্রিকেট খেলছে। কেবলই দেশের জন্য। এই ভাবনা যে একটা দলের কত বড় সম্পদ আর শক্তির অফুরান অাঁধার তা কেবল সম্মুখ সমরের একজন সৈনিকই অনুধাবন করতে পারেন। বিশ্বকাপের শুরু থেকেই ব্রেন্ডন ম্যাককালামের নিউজিল্যান্ডের পিছনে দাঁড়িয়েছিল পুরো জাতি। প্রতিটা জয়ের পর ব্ল্যাক ক্যাপস সৈনিকদের ওপর তাদের আস্থা আরও বেড়েছে। বেড়ে গেছে প্রত্যাশাও। অন্যদিকে এবি ডি ভিলিয়ার্সের দক্ষিণ আফ্রিকাকে নিয়ে ভক্তরা স্বপ্ন দেখছে, এই বছরটা কেবলই আমাদের। ভাবছে, অন্য দলগুলোর সঙ্গে এদের কোথাও একটা পার্থক্য আছে। কে জানে, আজ অকল্যান্ডের ইডেন পার্কে কাদের স্বপ্ন পূরণ হবে!
'সেমিফাইনাল' নামক জ্বলন্ত উনুনে বসে আছে দুটি দল। এর প্রচণ্ড উত্তাপ অসহনীয়, অথচ এ উনুন থেকে নেমে যাওয়ার উপায় নেই। সহ্য করে যেতে হবে জয় কিংবা পরাজয়ের পূর্ব পর্যন্ত!