পাকিস্তানের ক্রিকেট কিংবদন্তি ইমরান খান ছিলেন দুর্দান্ত অলরাউন্ডার। খেলার মাঠ ছেড়ে ১৯৯৬ সালে নামেন রাজপথে। তেহরিক-ই-ইনসাফ নামের একটি দল গঠন করেন তিনি। রাজনীতির কূটকৌশল বুঝতে তার লাগল ২২ বছর। নির্বাচনে জিতে হন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। তার ক্যারিয়ারজুড়েই রয়েছে নারী আর বিয়ে বিতর্ক।
মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান
ইমরান খানের বয়স এখন ৬৯ বছর। পাকিস্তানের লাহোরে জন্ম নেওয়া ইমরান খানের পুরো নাম ইমরান আহমেদ খান নিয়াজি। তবে ক্রিকেট বিশ্বে ইমরান খান নামেই খ্যাতি কুড়ান। যে কারণে পুরো নাম ঢাকা পড়ে গেছে অনেকটাই। তার বাবা ইকরামুল্লাহ খান নিয়াজি। ইমরান খানের বাবা ছিলেন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। মা শাওকাত খানুম গৃহিণী। বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে তিনি। নিয়াজি বংশের এ পরিবার উত্তর পাঞ্জাবের দিকে বসবাস করত। ইমরান খানের চার বোন ছিল। ছোটবেলা থেকেই শান্ত ছেলে ছিলেন তিনি। মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান হিসেবে বেড়ে উঠেছেন তিনি। পড়াশোনায় মনোযোগী না হলেও বাসায় পড়ার চাপ ছিল তার ওপর। যে কারণে পরবর্তীতে লাহোরে ও ইংল্যান্ডে উচ্চশিক্ষা নেন তিনি। পারিবারিকভাবেই ক্রিকেটের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ইমরান। তার বংশের ছেলেরা খেলাধুলায় ভালো ছিল। ইমরান খানের মা ছিলেন বুর্কি পরিবারের মেয়ে। এ পরিবার থেকেই জাভেদ বুখরি, মাজিদ খানের মতো ক্রিকেটাররা এসেছেন। ১৯৭২ সালে কেবেল কলেজ, অক্সফোর্ড থেকে দর্শন, রাজনীতি ও অর্থনীতি নিয়ে তিনি উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন। তিনি অনার্স গ্র্যাজুয়েট শেষ করেন ১৯৭৫ সালের দিকে। ইংল্যান্ডে থাকার সময়েই তিনি কাউন্টি ক্রিকেটে সবার নজর কাড়েন। তার ক্রিকেটযাত্রা সেখান থেকেই।
পাকিস্তানি ক্রিকেট লিজেন্ড
পাকিস্তানের ক্রিকেট লিজেন্ড ইমরান খান। ১৯৬৮ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে লাহোরের হয়ে সারগোদার বিরুদ্ধে প্রথম ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচ খেলেন তিনি। ১৯৭১ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয় তার। তারপর টানা পাকিস্তানের হয়ে খেলেছেন প্রায় দুই যুগ। এ দীর্ঘ ক্রিকেট ক্যারিয়ারে পেয়েছেন সর্বোচ্চ সাফল্য। তার হাত ধরেই পাকিস্তান জয় করে ক্রিকেট বিশ্বকাপ। ব্যাটিং ও বোলিং দুটোতেই ছিলেন মারকুটে ভূমিকায়। অলরাউন্ড নৈপুণ্যে তার সময়ের সেরাদের কাতারে ছিলেন। ৭৫ টেস্টে ৩০০ উইকেট ও তিন হাজার রান নিয়ে তিনি রেকর্ড বুকে নাম লেখান। ফাস্ট বোলার হিসেবে তার জায়গা ইতিহাস সেরাদের তালিকায়। ১৯৭৭ থেকে ১৯৮৩ এ সময়ে তিনি ছিলেন ফর্মের তুঙ্গে। ১৯৮২ সালে মাত্র নয় টেস্টে ৬২ উইকেট নিয়ে তিনি বিস্ময়ের জন্ম দেন। ফাস্ট বোলার হিসেবে তিনি ছিলেন ব্যাটসম্যানদের আতঙ্ক। পাকিস্তান ক্রিকেট দলের অধিনায়ক হিসেবে দুর্দান্ত পারফরমেন্স করেছেন তিনি। পাকিস্তানে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা ও উত্থান- দুটোরই সাক্ষী তিনি। পুরো পাকিস্তান দলের চেহারা বদলে যায় তার নেতৃত্বে। ১৯৮২ সালে অধিনায়কত্বের দায়িত্ব কাঁধে নেন ইমরান। ইংল্যান্ডের সঙ্গে সিরিজ জয় ছাড়াও ভারত, ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে টেস্ট সিরিজ ড্র করে নিজেদের ক্রিকেট পরাশক্তি হিসেবে টেনে তোলেন ইমরান খান। ১৯৮৮ সালে ক্রিকেট বিশ্বকাপের পর অবসর নিতে চাইলেও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে ক্রিকেটে ফিরে আসেন। তার ফলাফল পান ১৯৯২ ক্রিকেট বিশ্বকাপ। ইমরান খানের একক নৈপুণ্যে ১৯৯২ ক্রিকেট বিশ্বকাপ ঘরে তোলে পাকিস্তান। পাকিস্তান ছাড়াও ইংল্যান্ডের সাসেক্সের হয়ে সুনাম কুড়ান ইমরান খান। পাকিস্তানের ক্রিকেটের ভিত গড়ে দিয়েছেন তিনিই। তার হাত ধরেই পাকিস্তান ক্রিকেট দলে আলো ছড়ান ওয়াসিম আকরাম আর ওয়াকার ইউনিসের মতো খ্যাতিমান বোলাররা। বল টেম্পারিং বিতর্ক তার ক্রিকেট ক্যারিয়ারের শেষ দিকে ঘিরে ধরে। ১৯৮২ সালে বলের এক পাশ ঘষে সুইং করানোর চেষ্টা করতেন বলে স্বীকার করেন তিনি। তার এ স্বীকারোক্তির পর ইয়ান বোথাম ও অ্যালান ল্যাম্ব ইন্ডিয়া টুডেতে প্রবন্ধ প্রকাশ করলে ইমরান খানের বল টেম্পারিং বিতর্ক সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। তার ২১ বছরের ক্রিকেট ক্যারিয়ার ছিল নানা অর্জনের। ‘পাকিস্তানের প্রতিভা’, ‘পাকিস্তানের ক্যাপ্টেন’ ও ‘পাকিস্তানের ক্রিকেট জাদুকর’ এমন বিশেষণ তার নামের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। আশির দশকের শুরুতে ইমরান খানকে বিশ্বের সেরা অলরাউন্ডার মানা হতো। ৩৯ বছর বয়সে ক্রিকেটকে বিদায় জানান এ ক্রিকেট লিজেন্ড।
নারীসঙ্গ, তিন বিয়েকান্ড
১৯৮৪ সালে এক সাক্ষাৎকারে ইমরান খান নারীসঙ্গকে অত্যন্ত ভালোবাসেন বলে জানান। তবে এ জন্য যুক্তরাজ্যই উপযুক্ত বলে তিনি স্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানে আপনি কোনো সিঙ্গেল মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে পারবেন না। সেখানে কোনো ডিসকো নেই, কোনো বার (পানশালা) নেই, কোনো দেখা করার স্থানও নেই।’ যুক্তরাজ্যে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ কেবেল কলেজে পড়ার সময়ই ইমরান খানের ‘নারীসঙ্গ’ বিষয়টি জানাজানি হয়। সুদর্শন ইমরান খান লন্ডনের বিভিন্ন ক্লাবে নিয়মিত যাতায়াত করতেন। সেই সূত্রে একের পর এক নারীর সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন তিনি। তার বান্ধবীদের নিয়ে ক্লাবে মাতলামি করা ও নাচের ছবি ইংলিশ মিডিয়াতে প্রকাশ পেলে মুখরোচক খবরের মধ্যমণি হয়ে ওঠেন তিনি। ট্র্যাম্প নামে একটি নাইট ক্লাবে সুন্দরী নারীদের নিয়ে আমোদ-ফুর্তিতে এতটাই মেতে থাকতেন যেন ওটাই ছিল তার বাড়িঘর। এসব ক্লাবে বিভিন্ন মেয়ের সঙ্গে পরিচিত হতেন, নাচতেন, গাইতেন। প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে কদিন পর পর মুখরোচক খবরের জন্ম দিতে থাকেন। ১৯৮৬ সালে ধনী বাবার কন্যা সিতা হোয়াইটকে প্রেমের ফাঁদে ফেলেন ইমরান। তার সঙ্গে গভীর সম্পর্কের ফল ছিল এক কন্যা সন্তান। সেই সন্তানের পিতৃত্ব অস্বীকার করেছিলেন ইমরান। পরে অবশ্য ১৯৯৭ সালে আদালতের এক আদেশে ইমরান খানকেই পিতৃত্বের দায়িত্ব নিতে হয়। এক দশক পর আবার ইমরান খান সম্পর্কে জড়ান জেমিমা গোল্ডস্মিথের সঙ্গে। তাকে বিয়ে করলেও শেষ পর্যন্ত সংসার টেকেনি তার। ২০০৪ সালে দুজনের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। ২০১৪ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের ঘনিষ্ঠ ও পাকিস্তানের শীর্ষ ধনী মিয়া মানশার ২১ বছর বয়সী কন্যার সঙ্গে ‘গোপন প্রেম’-এর খবর চাউর হলে ইমরান অস্বীকার করেন। এক সময় ওই তরুণী সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়েছেন বলে খবর প্রচার পেলে প্রেম প্রেম খেলায় ডুব দিয়ে বসেন ইমরান খান। ওই মেয়েটিকে শেষ পর্যন্ত লন্ডনে পাঠিয়ে দেয় তার পরিবার। ২০১৫ সালে দ্বিতীয় বিয়ে করেন ইমরান। বিয়ে করেন টেলিভিশন উপস্থাপক রেহাম খানকে। ১০ মাসের মাথায় তাদের বিয়ে ভেঙে যায়। তারপরই গোমর ফাঁস হয় ইমরানের। প্রাক্তন স্ত্রী রেহাম খান তার আত্মজীবনীতে লেখেন-‘ইমরান খান একজন ভ- এবং মিথ্যাবাদী। তিনি রোজা রাখেন না এবং নামাজও পড়েন না।’ এ ছাড়াও তিনি অভিযোগ করেন, ‘পাঁচজন বিবাহিত নারীর সঙ্গে সম্পর্কের মাধ্যমে ইমরান খানের ঔরসজাত পাঁচ সন্তান রয়েছে।’ ২০১৮ সালের শুরুর দিকে ইমরানের তৃতীয় বিয়ের গুঞ্জন শোনা যায়। পরে সেটা স্বীকার করে নেন ইমরান খান। ফেব্র“য়ারি মাসে বুশরা মানেকা নামে একজন আধ্যাত্মিক নেত্রীকে বিয়ে করেন তিনি। তবে তার তৃতীয় বিয়ে নিয়েও কানাঘুষা শুরু হয় যে, এ বিয়ে দুই মাসও টিকেনি।
খেলার মাঠ থেকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী
১৯৯৬ সালে তেহরিক-ই-ইনসাফ রাজনৈতিক দল গঠন করে সবাইকে চমকে দেন ইমরান খান। খেলার মাঠ ছেড়ে রাজনীতির মাঠে নামায় তাকে নিয়ে সমালোচনা ও হাস্যরস তৈরি হয়েছিল। ক্রিকেটের অলরাউন্ডার, রাজনীতির কঠিন মারপ্যাঁচের কী জানেন- এ প্রশ্ন নিয়ে তৎকালীন রাজনীতিবিদরা মিডিয়া সরগরম করে তুলেছিলেন। দল গঠনের পরের বছরই পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচনে দুটি আসনে ভোটযুদ্ধে নামেন ইমরান খান। দুই আসনেই খালি হাতে ফেরেন তিনি। দলের ভরাডুবি বলতে যা বুঝায় সেটাই হলো। ১৯৯৯ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত দেশটির ক্ষমতায় থাকা স্বৈরশাসক পারভেজ মোশাররফের কঠোর সমালোচনায় মুখর ছিলেন তিনি। দলের পরিচিতি বাড়াতে ক্রিকেটার ইমেজটাই কাজে লাগান ইমরান খান। এরই মধ্যে দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমের শিরোনামে জায়গা পেয়ে যান তিনি। ২০১৩ সালে দেশটির সাধারণ নির্বাচনে ভোট কারচুপির অভিযোগ এনে ব্যাপক প্রতিবাদের ডাক দেন ইমরান। মাত্র ১৯ শতাংশ ভোট পায় ইমরানের পিটিআই। আবারও ভরাডুবি তার দলের। তবে এ হতাশাজনক ফলাফলের পর রীতিমতো পুনর্জন্ম ঘটে পিটিআই বা তেহরিক-ই-ইনসাফের। ২০১৩ সালে নির্বাচনে নিজ আসনে জয়ের পর সংসদ সদস্য হয়ে রাজনীতিতে নতুন রূপে দেখা যায় ইমরান খানকে। বিরোধী দলের ভূমিকায় নামে তার দল। সরকারের সমালোচনায় সর্বদা মুখর থাকেন তিনি। জঙ্গিবাদের প্রতি তার উদার দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পাওয়ায় তীব্র সমালোচিত হয়েছেন তিনি। সন্ত্রাসী, উগ্রপন্থি দলের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতাও মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে যায়। তাকে নিয়ে সমালোচনার পাহাড় থাকলেও সাধারণ মানুষের কাছে তিনি দিন দিন জনপ্রিয় হতে থাকেন দুটি কারণে। প্রথমত দুর্নীতিবিরোধী অবস্থান এবং দ্বিতীয়ত সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে আমেরিকার ভূমিকা নিয়ে তিনি সোচ্চার হয়ে ওঠেন। পাকিস্তানের তরুণ সমাজের কাছে ইমরান খানের বিপুল জনপ্রিয়তা ধীরে ধীরে গোটা পাকিস্তানে ছড়িয়ে যায়। ২০০২ সালে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে একটি আসন পেয়েছিল ইমরান খানের তেহরিক-ই-ইনসাফ। ২০০৮ সালের নির্বাচন বয়কট করেন। ২০১৩ সালে ইমরান খান মরিয়া ছিলেন জয় নিয়ে কিন্তু অস্বচ্ছতা আর দুর্নীতির কারণে পরাজিত হয়েছেন এমন অভিযোগ ছিল তার। ২০১৮ সালের নির্বাচনে জনমত ও বুথফেরত সমীক্ষায় পাল্লা ভারী ছিল তেহরিক-ই-ইনসাফের পক্ষে। ঘটলও তাই। ছিলেন পাকিস্তান ক্রিকেট দলের মারকুটে খেলোয়াড়, হলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। ক্রিকেট ছেড়ে ২২ বছর সংগ্রাম করার পর পাকিস্তানে নিজের নেতৃত্ব স্থাপন করতে সক্ষম হন তিনি।