মঙ্গলবার, ২৫ আগস্ট, ২০১৫ ০০:০০ টা

হঠাৎ নীরবতায় বিএনপি

হঠাৎ নীরবতায় বিএনপি

নানা প্রস্তুতির পর হঠাৎ করে আবার নীরব হয়ে গেছে বিএনপি। সরকারের কাছ থেকে নির্বাচন আদায়ের কৌশল নিয়ে বেশ তোড়জোড় ছিল দলটির। সে লক্ষ্যে জোট ও তাদের নেতাদের নিয়ে পরিকল্পনাও চলছিল। তৃণমূলে দল ঢেলে সাজানো থেকে শুরু করে কূটনৈতিক তৎপরতাও চালাচ্ছিল সমানতালে। কিন্তু এরই মাঝে হঠাৎ নীরব হয়ে গেছে দলটি। রহস্যময় এ নীরবতার ব্যাপারে কোনো পরিষ্কার তথ্যও পাওয়া যাচ্ছে না দলের কারও কাছ থেকে।
তবে সংশ্লিষ্ট নির্ভরযোগ্য কয়েকটি সূত্রের ভাষ্যমতে, দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সামনে এখন লক্ষ্য একটিই, আর তা হলো, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করা। আর সে নির্বাচনের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে দলীয় নেতা-কর্মীদেরও প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে একই নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি। এ কৌশলের অংশ হিসেবেই বারবার পরিবর্তন করছেন বিদেশ সফরসহ তার যাবতীয় কর্মসূচি। দীর্ঘ নয় মাস পর ২০-দলীয় জোটের বৈঠক ডেকে দুই ঘণ্টার বেশি সময় আলোচনার পরও জোটের পক্ষ থেকে নতুন কোনো কর্মসূচিও ঘোষণা করা হয়নি। লন্ডন সফরের আগ পর্যন্ত দল বা জোটের বিষয়ে নতুন কোনো সিদ্ধান্ত ঘোষণার সম্ভাবনাও কম। কিন্তু কী কারণে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হওয়ার পরও লন্ডন সফর স্থগিত করা হলো তার পরিষ্কার ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে না। দলের এ নীরবতাকে অনেকের রহস্যময় মনে হলেও অভ্যন্তরীণ কর্মকাণ্ডের চেয়ে এবার কূটনৈতিক তৎপরতার ওপর অধিক গুরুত্বারোপকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন বিএনপি হাইকমান্ড।
এদিকে বিকল্প ধারা ও এলডিপিসহ বেশ কয়েকটি শরিক দলের নেতারা এখন বিএনপিতে যোগ দিতে প্রস্তুত। বেগম খালেদা জিয়ার অনুষ্ঠানিক আহ্বানের অপেক্ষায় আছেন তারা। আগামী ১ সেপ্টেম্বর দলের ৩৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীকে ঘিরে এই যোগদানের কথা থাকলেও এটা কিছুটা পেছাতেও পারে বলে জানা গেছে। প্রক্রিয়াটির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের চিকিৎসার্থে বিদেশে অবস্থানকেও এর একটি কারণ বলে মনে করছেন কেউ কেউ। তার দেশে ফেরা পর্যন্তও অপেক্ষা করা হতে পারে। তবে উল্লিখিত শরিক দলগুলোর বিএনপিতে ফেরার বিষয়ে অত্যন্ত আশাবাদী প্রক্রিয়াটির সঙ্গে জড়িত বিএনপি ঘরানার বুদ্ধিজীবী ও বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রফেসর ড. এমাজউদ্দীন আহমদ। নির্বাচন নিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের বর্তমান চিন্তাভাবনা সম্পর্কে এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, শুধু বিএনপি নয়, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল হিসেবে সব দলেরই লক্ষ্য হওয়া উচিত নির্বাচন। কারণ নির্বাচন ছাড়া জনগণের সরকার যেমন প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়, তেমনি গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারও সম্ভব নয়। গণতান্ত্রিক দল বিএনপির নেত্রী হিসেবে বেগম খালেদা জিয়ার লক্ষ্য একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। আর এ জন্যই দল ও জোটের কলেবর বৃদ্ধিসহ একে সুসংগঠিত করাই লক্ষ্য হওয়া উচিত বিএনপির। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই ভিসির সঙ্গে একমত পোষণ করেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সুপ্রিমকোর্ট বার এসোসিয়েশনের সভাপতি অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন। তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্তটিই গ্রহণ করবেন বলে আশা করেন তিনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিএনপি হাইকমান্ডের বর্তমান সব চিন্তাভাবনাই হচ্ছে একাদশ জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে। ইতিমধ্যে তিনি সারা দেশে নির্বাচনী প্রস্তুতির কথা মাথায় রেখে দল পুনর্গঠনসহ সংগঠনকে যথাসম্ভব শক্তিশালী করার নির্দেশ দিয়েছেন। জেলা-উপজেলায় চিঠিও পাঠানো হয়েছে নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে। যে কোনো মূল্যে তিনি একটি নিরপেক্ষ ব্যবস্থায় গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চাচ্ছেন। এ দাবি আদায়ের লক্ষ্যে সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়াতেও দলের পক্ষে কার্যক্রম চলছে। দেশি-বিদেশি এই চাপের মুখে আগামী বছর প্রথমার্ধেই সরকার নতুন নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে বলে আশা করছে বিএনপি। এ দাবি বাস্তবায়নের নানা কৌশলের মধ্যে চেয়ারপারসনের নীরবতাও একটি কৌশল।
পরবর্তী রাজনৈতিক কর্মকৌশল নির্ধারণের ক্ষেত্রে আন্দোলনের পাশাপাশি নির্বাচনের প্রস্তুতিকেও সমান গুরুত্ব দিচ্ছেন বিএনপি হাইকমান্ড। অপর একটি সূত্র জানায়, কূটনৈতিক তৎপরতার ওপর এবার ব্যাপক গুরুত্ব দিচ্ছে বিএনপি। ইউরোপ-আমেরিকার পাশাপাশি বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতের ওপরও সমধিক গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে। ক্ষমতাসীন বিজেপির সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখা হচ্ছে পরোক্ষভাবে। বিশেষ করে ইউরোপের একটি বিশেষ দেশ হয়ে দলের একটি গ্রুপের কয়েকজন নেতা এ কাজটি করছেন। আর দলের বেশ কয়েকজন নেতা এখন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করে দলের পক্ষে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদারে কাজ করছেন। এসব নেতা আগামী বছরের মধ্যে নতুন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যাপারেও আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকারী দলের একজন প্রভাবশালী ভাইস চেয়ারম্যানের ভাষ্য, আওয়ামী লীগ তার নিজের প্রয়োজনেই নতুন জাতীয় নির্বাচন দিতে বাধ্য হবে। কারণ এভাবে দেশ যে খুব বেশি দিন চলতে পারে না তা আওয়ামী লীগ নেতারাও ভালো করেই জানেন। বিএনপির নীতিনির্ধারক মহল সূত্রে জানা যায়, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংগ্রহণ ও নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থাসহ প্রয়োজনীয় নানা দিক মাথায় রেখেই বিএনপির ভবিষ্যৎ রাজনীতির কর্মকৌশল নির্ধারণ করতে যাচ্ছেন খালেদা জিয়া। দলীয় নেতারা মনে করেন, ৫ জানুয়ারির একতরফা প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলেও তাদের ওপর দেশি-বিদেশি চাপ রয়েছে। বাংলাদেশে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য ইউরোপ-আমেরিকাসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মহলের চাপ বিদ্যমান। বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলো বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে না নামলেও তারাও নতুন নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে। এ অবস্থায় সরকার একটি নতুন বা মধ্যবর্তী নির্বাচন দিতে বাধ্য হতে পারে। তাছাড়া প্রতিবেশী ভারতের কাছ থেকেও পরোক্ষভাবে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। এ কারণে হঠাৎই বিএনপির ভারতমুখী কূটনৈতিক তৎপরতাও বেড়ে গেছে উল্লেখযোগ্য হারে। নতুন একটি সংসদ নির্বাচনের দাবিতে নতুনভাবে রাজপথের আন্দোলন শুরু করতে চায় বিএনপি। তবে অতীতের মতো লাগাতার অবরোধ-হরতালের মতো কর্মসূচির পরিবর্তে নির্বাচনমুখী ভিন্ন ধারার কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামার কথা ভাবছে এখন দলটি।
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, পুনর্গঠনের মাধ্যমে দল ও জোট শক্তিশালী হলে নির্বাচন-আন্দোলন দুই চ্যালেঞ্জই মোকাবিলা সহজ হবে। বিএনপি জনগণের দল। তাদের ভোটাধিকারসহ সব অধিকার প্রতিষ্ঠাই বিএনপির মূল লক্ষ্য। বিএনপি কখনোই প্রতিহিংসার রাজনীতিতে বিশ্বাস করে না। জনগণের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনতে শান্তিপূর্ণ সংগ্রাম চালিয়ে যাবে।

বিএনপি চেয়ারপারসনের আরেক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) রুহুল আলম চৌধুরীর মতে, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের একমাত্র পথ হচ্ছে জনগণ ও সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণমূলক একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। এটি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, ততই মঙ্গল। আর জনগণের এ দাবি আদায় করতে হলে ভুল সময়ে আন্দোলন না করে সঠিক সময়েই সঠিক কর্মসূচি দিতে হবে।

সর্বশেষ খবর