নিম্ন আদালতের অধিকাংশ কর্মচারী নিয়োগে জনপ্রতি ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা ঘুষ গ্রহণ করতেন সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তার সব দুর্নীতির সঙ্গে তৌফিকা করিমের সংশ্লিষ্টতা ছিল বলে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে জানা গেছে। এরই মধ্যে সংস্থাটি আনিসুল হক এবং সিটিজেন ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান তৌফিকা করিমের অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থ পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সংস্থাটির উপপরিচালক (জনসংযোগ) মো. আকতারুল ইসলাম গতকাল জানান, আনিসুল হক মন্ত্রী থাকাকালে ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রচুর পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন। নিজ নামে কসবা, ত্রিশাল এবং পূর্বাচলে ৬ দশমিক ৮০ একর জমি কিনেছেন। সিটিজেন ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংকে তার শেয়ারের পরিমাণ ৪০ দশমিক ১০ কোটি। এ ছাড়া সঞ্চয়পত্র, বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা এবং অন্যান্য বিনিয়োগ ২৩ কোটি ২৬ লাখ ৭৯ হাজার ৮৮৪ টাকা। তার চারটি গাড়ি ও একটি মোটরসাইকেল রয়েছে। আর অ্যাডভোকেট তৌফিকা করিমের নামে-বেনামে দেশে-বিদেশে অঢেল সম্পদ রয়েছে। দুদক সূত্র জানায়, তৌফিকা করিম সিটিজেন চার্টার ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন। তার মাধ্যমে আনিসুল হক কানাডাসহ বিভিন্ন দেশে কোটি কোটি টাকা পাচার করতেন। তার সব দুর্নীতির সঙ্গে তৌফিকা করিমের সংশ্লিষ্টতা ছিল। আনিসুল হক ও তৌফিকা করিম তাদের অন্যান্য আত্মীয়স্বজনের নামে-বেনামে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে প্রচুর জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের মালিক হয়েছেন। ক্ষমতার পটপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গেই গ্রেপ্তার হয়েছেন আনিসুল হক। আর তৌফিকা করিম চলে গেছেন আত্মগোপনে। তবে এই নারী দেশ ছেড়ে কানাডায় তার ছেলের কাছে পালিয়েছেন বলে গুঞ্জন রয়েছে। যেখানে তার বিপুল সম্পদ। তবে পালাবদলের পর সাবেক মন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টও জব্দ করেছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। দুদক সূত্র জানায়, আনিসুল হকের বাবা অ্যাডভোকেট সিরাজুল হকের চেম্বারে জুনিয়র হিসেবে কাজ করতেন তৌফিকা করিম। সিরাজুল হক মারা যাওয়ার পর তৌফিকা হয়ে যান আনিসুল হকের জুনিয়র। ২০১৪ সালে আইনমন্ত্রী হন আনিসুল হক। এরপর দীর্ঘ প্রায় এক দশক তিনি মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। এ সময়ে বিচারাঙ্গনে মন্ত্রী ও তার ঘনিষ্ঠজনদের বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ ছিল না। ২০১৪ সাল থেকে বিভিন্ন জেলা ও মহানগরীর অধস্তন আদালতে যত নিয়োগ হয়েছে তার অধিকাংশেই খাতা পরিবর্তন, জালিয়াতি, পরীক্ষা না দিয়েও চাকরি হওয়ার নানা অনিয়ম, দুর্নীতি, ঘুষ-বাণিজ্যসহ নানা অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। বিনিময়ে প্রতিটি নিয়োগের বিপরীতে ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা নেওয়া হয়েছে। দেশের প্রতিটি আদালতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার লোক নিয়োগ পেয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ডিআইজি (প্রিজন) পার্থ গোপালের বাসায় ৮০ লাখ টাকা পাওয়ায় দুর্নীতির মামলা হয়। সুপ্রিম কোর্টের হাই কোর্ট ও আপিল বিভাগ তার জামিন নামঞ্জুর করে। মামলার বিচার নির্দিষ্ট সময়ে শেষ করার নির্দেশ দেয় উচ্চ আদালত। ঢাকার ৫ নম্বর বিশেষ জজ আদালতের বিচারক ইকবাল হোসেনকে মন্ত্রণালয়ে ডেকে এনে পার্থ গোপালকে জামিন দিতে বলা হয়। পরে আদালত গোপনে খাসকামরা থেকে পার্থ গোপালকে জামিন দেন। এ ঘটনা ফাঁস হলে হাই কোর্ট কৈফিয়ত চেয়ে রুলও জারি করে। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জের সেজান ফুড কোম্পানির কারখানায় ৫২ জন লোক পুড়ে মারা যান। আরও ৫০ জন পুড়ে গুরুতর জখম হন। শ্রমিকদের মধ্যে ক্ষোভ চলাকালে ২০২১ সালের ১০ জুলাই অভিযুক্তদের চার দিনের রিমান্ডে পাঠান আদালত। পরে রিমান্ড শেষে ১৪ জুলাই দুই আসামির জামিন হয়। ১৯ জুলাই আরও তিন আসামির জামিন হয়। আইনমন্ত্রী এবং তৌফিকা করিমের মাধ্যমেই সেই জামিনের ব্যবস্থা করা হয়। ফারমার্স ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারির দুর্নীতির মামলায় চিশতি পরিবারের জামিনের আবেদন আপিল বিভাগেও নামঞ্জুর হয়। অথচ বিপুল অঙ্কের টাকার বিনিময়ে পরে ঢাকার মহানগর দায়রা জজ থেকে জামিনের ব্যবস্থা করানো হয়। জানা গেছে, দশ বছরের ব্যবধানে আনিসুল হকের নগদ টাকা বৃদ্ধি পায় ২১৮ গুণ। ১০ বছর আগে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় তিনি তার কাছে ৫ লাখ টাকা রয়েছে বলে উল্লেখ করেন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় তিনি উল্লেখ করেন- তার কাছে নগদ আছে ১০ কোটি ৯২ লাখ ৯৪ হাজার ১৯৯ টাকা, যা ১০ বছর আগের তুলনায় ২১৮ গুণ বেশি। পাশাপাশি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা করা অর্থের পরিমাণও ১০ বছরের ব্যবধানে ২ কোটি ৫৪ লাখ ৬০ হাজার ৭৮৭ টাকা বৃদ্ধি পায়।