নিজেদের ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) ঐতিহ্যবাহী পণ্য ব্র্যান্ডিং ও রপ্তানি করে বড় অঙ্কের আয় করছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। কিন্তু বৈচিত্র্যময় খাবার, সংস্কৃতি, কৃষিপণ্য ও প্রাকৃতিক সম্পদের অফুরন্ত ভান্ডার হওয়ার পরও পণ্যের জিআই নিবন্ধন ও ব্র্যান্ডিংয়ে পিছিয়ে বাংলাদেশ। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত যেখানে প্রায় সাড়ে ছয় শ পণ্যের জিআই নিবন্ধন নিয়েছে, সেখানে বাংলাদেশের জিআই পণ্য এখনো মাত্র ৪৩টি। এ ছাড়া বাংলাদেশের অনেক প্রসিদ্ধ ও ঐতিহ্যবাহী পণ্য ভারত জিআই তালিকাভুক্ত করে নিয়েছে বলে অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এমনকি বাংলাদেশের টাঙ্গাইলের শাড়িও ভারত নিজেদের জিআই পণ্য হিসেকে দাবি করেছে, যা এখন আদালত পর্যন্ত গড়াচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অসচেতনতা ও সরকারের ধীরে চলো নীতির কারণে বাংলাদেশ অনেক নিজস্ব ঐতিহ্যবাহী পণ্যের জিআই স্বত্ব হারিয়েছে। পরবর্তীতে বিশ্ব মেধাসম্পদ সংস্থার (ডব্লিউআইপিও) আইন মেনে বাংলাদেশও পণ্যগুলোকে জিআই তালিকাভুক্ত করে। তবে আগে তালিকাভুক্ত করায় সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে ভারত। ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাপী তারা পণ্যগুলোকে নিজেদের পণ্য হিসেবে ব্র্যান্ডিং করে ফেলেছে, ব্যবসাও করছে। তারা জিআই পণ্যের সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি এসব পণ্য এক প্ল্যাটফরমে পাওয়ার সহজ ব্যবস্থা করতে ২০১৬ সালে জিআই ট্যাগড নামে একটি কোম্পানি চালু করে। বর্তমানে জিআইট্যাগডডটকম-এ দেশটির স্বীকৃত পণ্যগুলো পাওয়া যাচ্ছে। বাংলাদেশে নেই এমন কোনো উদ্যোগ। সূত্র জানায়, সুন্দরবনের ৬০ ভাগ মধু বাংলাদেশ অংশে উৎপাদিত হলেও চলতি বছরের জানুয়ারিতে ভারত এটিকে তাদের জিআই পণ্য ঘোষণা করে। পরবর্তীতে বিশ্ব মেধাসম্পদ সংস্থার (ডব্লিউআইপিও) এক সম্মেলনে সুন্দরবনের মধুকে ভারতের জিআই পণ্য হিসেবে উপস্থাপন করলে দেশে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়। একপর্যায়ে বাংলাদেশও সুন্দরবনের মধুকে জিআই পণ্য ঘোষণা করে। অথচ বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক সুন্দরবনের মধুকে জিআই পণ্য করার জন্য ঢাকায় আবেদন পাঠান ২০১৭ সালে। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রসিদ্ধ ফজলি আম, রসগোল্লা, নকশিকাঁথা, গোবিন্দভোগ চাল, লক্ষ্মণভোগ আম, হিমসাগর আম, রয়েল বেঙ্গল টাইগার, জামদানি শাড়ি, মোয়াসহ অনেক পণ্যের জিআই নিবন্ধন রয়েছে ভারতের। পরবর্তীতে বাংলাদেশও এসব পণ্যের অনেকগুলোকে জিআই তালিকাভুক্ত করে। তবে এগুলো প্রকৃতপক্ষে কোনো দেশের জিআই পণ্য তা এখনো অমীমাংসিত।
জিআই নিবন্ধন কেন গুরুত্বপূর্ণ : জিআই পণ্যের দাম বেশি হয় এবং পর্যটকরাও এসব পণ্যের ব্যাপারে আগ্রহী থাকেন ও বেশি মূল্যে কিনেন বলে জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মিজানুর রহমান। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, রপ্তানিতে ব্র্যান্ডিংয়ের ক্ষেত্রে জিআই নিবন্ধন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জিআই পণ্যের মূল্য সব সময় বেশি হয় কারণ এটা ব্র্যান্ড। পর্যটকরা কোথাও ঘুরতে গেলেও সেখানকার ঐতিহ্যবাহী পণ্য আদি উৎস থেকে কিনতে চায়। এজন্য তারা বেশি অর্থ খরচ করতেও দ্বিধা করে না। এতে উৎপাদকও বেশি দাম পায়।
উদাহরণস্বরূপ, একই গার্মেন্টে একই কাপড় দিয়ে তৈরি কোনো শার্টের দাম ৫০০ টাকা, আবার কোনোটির দাম ৩ হাজার টাকা। বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ডের ট্যাগ লাগানোয় দাম কয়েক গুণ বেড়ে যায়। জিআই স্বত্ব থাকলে উৎপাদকও লাভবান হয়। যেমন বাংলাদেশে কেউ কোকাকোলা উৎপাদন করে বিক্রি করলে স্বত্বের কারণে আমেরিকান কোম্পানিকে রয়্যালিটি দিতে হয়। জিআই নিবন্ধন করলে আমাদের পণ্য অন্য কেউ দাবি করতে পারবে না। ভারত মধুসহ আমাদের অনেক পণ্যের জিআই নিবন্ধন করেছে। এখন তারা আমাদের এখান থেকে ওই সব পণ্য কিনে তাদের জিআই পণ্য বলে বেশি দামে বিক্রি করলে কিছু করার নেই। আমাদের মালিকানা থাকলে এটা তারা করতে পারত না। জিআই নিবন্ধন যে আগে করতে পারবে, সেই লাভবান হবে। কোনো দেশ নিয়ম ভেঙে অন্য দেশের জিআই পণ্যকে নিজেদের তালিকাভুক্ত করলে আন্তর্জাতিক আদালতে সুরাহার সুযোগ আছে। তবে এ প্রক্রিয়া জটিল। ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি অর্গানাইজেশনের (ডব্লিউআইপিও) তথ্য অনুযায়ী, জিআই কোনো পণ্যের উৎপত্তিস্থল ও স্বকীয়তার নির্দেশক। নাটোর থেকে কাঁচাগোল্লার প্রস্তুত প্রণালি শিখে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী অন্যত্র এই মিষ্টান্ন উৎপাদন করলেও এটা নাটোরের-ই জিআই পণ্য। একই পণ্য অন্য একাধিক দেশ উৎপাদন করলে যে দেশ সবচেয়ে বেশি উৎপাদন করবে, পণ্যটি যে দেশে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় হবে, সেই দেশই ওই পণ্যের স্বত্ব পেতে অগ্রাধিকার পাবে। এ ছাড়া কোনো দেশের একটি বিশেষ এলাকার জলবায়ু, মাটির গুণাগুণ, পানি, কারিগরদের দক্ষতা, ভৌগোলিক গুণাগুণ, জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতিসহ বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য ওই পণ্য উৎপাদনের জন্য বিশেষ সহায়ক হলে ওই পণ্যের জিআই সনদ পাওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে। অনেকে পণ্য কেনার সময় সেগুলোর উৎসের প্রতি বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। তাই বিশ্ববাণিজ্যে জিআই পণ্যের গুরুত্ব অনেক বেশি।
যা বলছে সংশ্লিষ্ট দপ্তর : বিশ্বে মেধাস¦ত্ব ও জিআই সংশ্লিষ্ট বিষয় দেখভাল করে ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি অর্গানাইজেশন (ডব্লিউআইপিও)। সংস্থাটির নিয়ম মেনে বাংলাদেশে জিআই নিবন্ধন দেয় পেটেন্ট, শিল্প-নকশা ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর (ডিপিডিটি)। সংস্থাটির মহাপরিচালক মো. মুনিম হাসান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ২০১৩ সালের আগে আমাদের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (নিবন্ধন ও সুরক্ষা) আইন ছিল না। ভারতে ছিল। তারা আমাদের অনেক পণ্য জিআই তালিকাভুক্ত করেছে। আমাদের প্রথম জিআই পণ্য জামদানি শাড়ি। ভারতেও ‘উপাধা জামদানি’ নামে জিআই আছে। জামদানি শাড়ি আমাদের কমিউনিটির পণ্য। আমরা বিসিককে বলেছি, এটার একক স্বত্ব যাতে আমাদের থাকে এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে। এখনো ফিডব্যাক পাইনি। এ ছাড়া টাঙ্গাইল আমাদের একটা এলাকার নাম। এই শাড়ির জিআই ভারতের হওয়ার সুযোগ নেই। এ ব্যাপারে ভারতের মাদ্রাজ কোর্টে মামলার প্রস্তুতি নিয়েছি। আইনজীবীও নিয়োগ দিয়েছি। আমরা জিআই নিবন্ধন বাড়ানোর জন্য প্রচারণা চালাচ্ছি। জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনারদের চিঠি দিচ্ছি। তাদের মাধ্যমে জিআই নিবন্ধন দেওয়া যায় এমন পাঁচ শতাধিক পণ্যের তালিকা সংগ্রহ করেছি। শিগগিরই আরও পণ্য জিআই নিবন্ধন পাবে বলে আশাবাদী তিনি।
জামদানির জিআই নিয়ে বিতর্ক : কয়েক শতক আগে বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে পরিচিত করেছিল ঢাকাই মসলিন। এই মসলিনের একটি ধরন জামদানি এখনো টিকে রয়েছে। বিশ্বের অনেক দেশে এখনো বাংলাদেশের জামদানির কয়েক শ বছরের পুরনো গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ রয়েছে। ঐতিহ্যগতভাবেই জামদানি বাংলাদেশের নিজস্ব পণ্য। তবে ভারতের অন্ধ্র প্রদেশ ২০০৯ সালে জামদানিকে তাদের জিআই পণ্য হিসেবে নিবন্ধন করে। নাম দেয় উপাধা জামদানি। বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক ইফতেখার ইকবাল। ২০১৪ সালে একটি অনুষ্ঠানে তিনি জানান, জামদানি তৈরি করতে যেসব কাঁচামাল, আবহাওয়া, বুননের দক্ষতা প্রয়োজন তা শুধু বাংলাদেশেই আছে। জামদানিকে মসৃণ করতে যে পানি দরকার তা কেবল বাংলাদেশের শীতলক্ষ্যা নদীতে রয়েছে। সে কারণে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরবর্তী স্থানগুলোতেই জামদানি পল্লী গড়ে উঠেছে। তাই অন্য কোনো দেশের এ পণ্যের মালিকানা দাবির সুযোগ নেই। তিনি জানান, গবেষণা প্রণয়নের সময় তারা ওসমান গণি নামের একজন জামদানি শাড়ি প্রস্তুতকারকের সাক্ষাৎকার নেন। তাকে ভারতের শাড়ি প্রস্তুতকারকেরা সে দেশে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ওই আবহাওয়া ও কাঁচামালে তিনি বাংলাদেশের মানের জামদানি তৈরি করতে পারেননি।
বাংলাদেশে নিবন্ধিত জিআই পণ্য এখন ৪৩টি : ডিপিডিটি এখন পর্যন্ত ৪৩টি পণ্যের জিআই নিবন্ধন দিয়েছে। এগুলো হলো জামদানি শাড়ি, ইলিশ, ক্ষীরসাপাত আম, বিজয়পুরের সাদা মাটি, দিনাজপুরের কাটারীভোগ চাল, কালিজিরা, শতরঞ্জি, রাজশাহীর সিল্ক ও মিষ্টি পান, ঢাকাই মসলিন, চাঁপাইনবাবগঞ্জের ফজলি আম, আশ্বিনা আম ও ল্যাংড়া আম, বাগদা চিংড়ি, শীতল পাটি, বগুড়ার দই, শেরপুরের তুলসীমালা ধান, নাটোরের কাঁচাগোল্লা, ব্ল্যাকবেঙ্গল ছাগল, টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচম, কুমিল্লার রসমালাই ও খাদি, কুষ্টিয়ার তিলের খাজা, রংপুরের হাঁড়িভাঙা আম, মৌলভীবাজারের আগর আতর, মুক্তাগাছার মন্ডা, যশোরের খেজুরের গুড়, নরসিংদীর অমৃত সাগর কলা ও লটকন, গোপালগঞ্জের রসগোল্লা ও ব্রোঞ্জের গহনা, জামালপুরের নকশিকাঁথা, টাঙ্গাইলের শাড়ি, মধুপুরের আনারস, ভোলার মহিষের দুধের কাঁচা দই, মাগুরার হাজরাপুরী লিচু, সিরাজগঞ্জের গামছা, সিলেটের মনিপুরি শাড়ি, মিরপুরের কাতান শাড়ি, ঢাকাই ফুটি কার্পাস তুলা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ছানামুখী মিষ্টি ও সুন্দরবনের মধু।
নিবন্ধনের পথে আরও ৩৪ পণ্য : ডিপিডিটি সূত্র জানায়, শেরপুরের ছানার পায়েস, সিরাজগঞ্জের লুঙ্গি, গাজীপুরের কাঁঠাল, কিশোরগঞ্জের রাতাবোরো ধান, অষ্টগ্রামের পনির, বরিশালের আমড়া, কুমারখালীর বেডশিট ও দিনাজপুরের বেদানা লিচুর জিআই জার্নাল প্রকাশিত হয়েছে। দ্রুতই এগুলোর নিবন্ধন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এর বাইরে আরও ২৬টি পণ্য নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় আছে। সেগুলো হলো মেহেরপুরের সাবিত্রি মিষ্টি, পিরোজপুরের মাল্টা, বরগুনার সোনামুগ ডাল, পার্বত্যাঞ্চলের থামি, মুরং বাঁশি, মৌলভীবাজারের দুছনির দই, গফরগাঁওয়ের লাফা বেগুন, কালো বিন্নি চাল, বম কাঁথা, গোলপাতার গাছের গুড়, পটুয়াখালীর সোনামুগ ডাল, ফুলবাড়িয়ার লাল চিনি, মেহেরপুরের মেহেরসাগর কলা, মেহেরপুরের হিমসাগর আম, বাংলাদেশের মাটির তালি, কুমিল্লার বিজয়পুরের মৃৎশিল্প, নেত্রকোনার বালিশ মিষ্টি ও ফরিদপুরের পাট। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০১৩ সালে দেশে ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (নিবন্ধন ও সুরক্ষা) আইন হয়। ২০১৫ সালে আইনের বিধিমালা তৈরির পর জিআই পণ্যের নিবন্ধন নিতে আহ্বান জানায় পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেড মার্কস অধিদপ্তর (ডিপিডিটি)। তার আগেই বাংলাদেশের প্রসিদ্ধ অনেক পণ্য ভারতে জিআই তালিকাভুক্ত হয়। তবে আইন ও বিধিমালা থাকা সত্ত্বেও এখনো জিআই নিবন্ধনে পিছিয়ে আছি আমরা।