করোনাযোদ্ধা হিসাবে নতুন যোগ দেয়া দুই ডাক্তার অন্যরকম এক লড়াই করেছেন রাতব্যাপী। যে লড়াইয়ে তাদের রাতে ছুটতে হয়েছে হাসপাতাল থেকে হোটেল। আবার কোন বাড়ি। এক সময় নিরব নিস্তব্ধ সড়ক হয় তাদের সঙ্গী। রাজধানীর বেসরকারি রিজেন্ট হাসপাতালের ২ জন চিকিৎসক বুধবার সারারাত থাকার জন্য হন্যে হয়ে ঘুরেন। বেসরকারি রিজেন্ট হাসপাতালটিতে দেয়া হচ্ছে করোনা রোগীর চিকিৎসা। সেখানে নিয়োগ দেয়া হয়েছে ৮ জন সরকারি চিকিৎসক।
সেইসঙ্গে যোগ দিয়েছেন ৩৯ তম বিসিএস থেকে নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত ১৮জন। গত ২৯শে এপ্রিল যোগদান করেছেন ডা. রেজানুর রহমান সোহেল। তিনি বলেন, আমরা প্রথমেই ধাক্কা খাই। রিজেন্টের ম্যানেজারের কাছে আমরা যোগদান করি। আমরা কেন ম্যানেজারের কাছে যোগদান করব? সেখানে স্বভাবতই উর্ধ্বতন কাউকে আশা করেছিলাম। যাক দায়িত্ব পালন করছি। এখন পর্যন্ত থাকার কোন ব্যবস্থা করেননি তারা। বুধবার সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত ডিউটি করি। এরপর হাসপাতাল কর্র্তৃপক্ষকে গাড়ির কথা বলা হলে জানায় গাড়ি আসছে। ঘণ্টা খানেক সময় লাগবে। আমি ও আমার সঙ্গে ছিলেন আরেকজন চিকিৎসক। দুজনে ব্যক্তিগত গাড়িতে করে থাকার জায়গার ঠিকানা নিয়ে চলে যাই উত্তরা ৬ নম্বর সেক্টরের একটি হোটেলে। সেখানে গেলে তারা বলেন, এখানে থাকা যাবে না হোটেলে করোনা রোগী পাওয়া গেছে। এরপর তারা নিয়ে যান তাদের একটি কলেজে এবং জানান সেখানেই তাদের থাকার ব্যবস্থা করা হবে। সেই হোটেলে একজন মহিলা চিকিৎসক ছিলেন, তাকে ফোন দিলে বলেন, হোটেলে করোনা আক্রান্তের কোন তথ্যই জানেন না তিনি। ডা. রেজানুর রহমান সোহেল বলেন, সেখানে গিয়ে দেখা যায় কোন খাট নেই। ফ্লোরিং করে থাকতে হবে। গোসলের ব্যবস্থা সম্পর্কে তারা জানায়, বড় পাতিল আছে তারা বললে গরম করে দিবেন। অব্যবস্থাপনা দেখে আমরা তাদের অভিযোগ জানাই। তারা বলেন, আমরা আপনাদের আসতে বলেছি, আপনারা কেন চলে এসেছেন? আমি বলি, এই কথাটা আমাদের লিখিত আকারে দেন। তারা উল্টো বলেন, আপনি আমাদের এখানে থাকবেন না তার লিখিত দেন। এমন কথা বলে, রাত দেড়টার দিকে আমাদের সড়কে রেখে দরজা লাগিয়ে দেয়।
দেড়টার দিকে আমরা দুজন চিকিৎসক ফিরছিলাম। ওদিকে আমাদের রাতের খাবারের কোন ব্যবস্থাও করা হয়নি। রীতিমতো হাত পা কাপছিলো। এ সময়ফোন দেন রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মো. শাহেদ। তিনি বলেন, আপনাদের জন্য হাসপাতালে একটি রুম ফাঁকা করা হচ্ছে আপনারা সেখানেই থাকতে পারবেন। তখন হোটেলে করোনা আক্রান্ত রোগীর কথা জানতে চাইলে বলেন, আসলে হোটেলেতো যেকেউ যেকোন সময় আক্রান্ত হতে পারে। একথা বলেই ফোন রেখে দেন তিনি।
সোহেল আরও বলেন, হাসপাতালেই যদি থাকতে হয় তবেতো আইসোলেশন হবে না। আর সারাদিন পরিশ্রম শেষে একটু বিশ্রামের প্রয়োজন আছে। তাই রাত ৩ টার দিকে বাধ্য হয়ে বাড়িতে ফিরে যান তারা। এই চিকিৎসক বলেন, আমাদের চাই নানা প্রশিক্ষণ। নতুন চিকিৎসকদের কোন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়নি। তারাওতো নতুন, তাদের শেখাতে হবে। এমনকি পিপিই পরিধান করতেওতো প্রশিক্ষণের প্রয়োজন। আর রিজেন্ট হসপিটালের চেয়ারম্যান কথায় কথায় গানম্যানকে ডেকে নিয়ে আসেন। তার ভয়ে ভীত থাকেন সবাই।
ডা. রেজানুর রহমান সোহেলের সঙ্গে রাতে ছিলেন ডা. শরীফ সাম্মিরুল আলম। তিনি ৩ দিন আগে যোগ দিয়েছেন রিজেন্ট হাসপাতালে। তাকে হৃদরোগ ইন্সটিটিউট থেকে এনে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে রিজেন্টের মিরপুর ও উত্তরা শাখায় আইসিইউ কনসালটেন্ট হিসেবে। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, পরিবহন সুযোগ দিতে পারবেন না তারা। তাই মিরপুরেই শুধু দায়িত্ব পালন করতে হবে। তিনি বলেন, সরকার চাইলে সঙ্কটকালীন মুহুর্তে বেসরকারি হাসপাতালে দিতে পারেন। কিন্তু সেজন্য চাই স্বতন্ত্র পরিচালনা পরিষদ। কিন্তু তার কিছুই নেই। মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছিল, রিজেন্টে ভিআইপি রোগী আছে। কিন্তু আমি যোগ দেবার পর কোন ভিআইপি রোগী পাইনি।
ডা. শরীফ সাম্মিরুল আলম আরও বলেন, আইসিইউ’র জন্য চাই আলাদা অভিজ্ঞ নার্স, ওয়ার্ডবয়। এখানে সেসব নেই। আমি যোগ দেবার পর দেখি কোন কিছুই ঠিক নেই। যেমন অতি গুরুত্বপূর্ণ অক্সিজেনের লাইনটাও ঠিক ছিল না। রাগারাগি করে ঠিক করালাম। একটা ভ্যান্টিলেটর চালু করলাম। কিন্তু তারা আমাদের নিরাপত্তা দিতে পারছে না। আইসিইউ’তে ২ জন রোগী আছে তাদের দেখতে যেতে পারিনি। এন-৯৫ মাস্ক দিতে ব্যর্থ তারা। আজ আমি ২ ঘণ্টা নিচে বসে থেকে চলে এসেছি। এখানে বিকল্প কোন চিকিৎসক নেই আমার অবর্তমানে কাজ করবেন। আবার আলাদা কোন থাকার স্থানটাও দিচ্ছেন না তারা। নিয়ম হচ্ছে আমি ৭ থেকে ৮ দিন কাজ করবার পর কোয়ারেন্টাইনে যাবো, পরীক্ষা করাবো। এক্ষেত্রে তারা আমাদের আলাদা থাকার স্থানও দিতে পারছেন না। আমার বাড়িতে ছোট ২টা বাচ্চা আছে। বৃদ্ধ মা আছে। পরিবারের জন্য ভয় হয়। আমি চাই না আমার জন্য তারা বিপদের মুখে পড়–ক।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে রিজেন্ট হাসপিটালের চেয়ারম্যান মো. শাহেদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু ফোন ধরেন তার গণসংযোগ কর্মকর্তা তরিক শিবলী। বলেন, ওনারা হঠাৎ করে রিজেন্টে এসেছেন। উত্তরায় সব হোটেল বন্ধ। তার থাকার জন্য সব ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রায় সব কেনা হয়েছে শুধুমাত্র খাটটা কেনা হয়নি। আমরা তাদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করে একটাদিন সময় চেয়েছি। আজকে থেকেই তারা সেখানে থাকতে পারবেন। আর বাড়ি নেয়া হয়েছে বাথটব থেকে শুরু করে আলমারি, ব্যক্তিগত ব্যবহারের জিনিসের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
করোনা রোগীর সেবা বিশ্বব্যাপী বিনামূল্যে হচ্ছে? সেখানে রিজেন্ট হাসপাতালে নেয়া হচ্ছে অর্থ। তাদের একজন রোগীর বিলের রশিদ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে একজন রোগী ভর্তির সময় নেয়া হয়েছে ৪০ হাজার ৯৫০ টাকা। জানা যায়, বর্তমানে সেখানে চিকিৎসাধীন আছেন ৪৬জন। এমনকি সরকারিভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত চিকিৎসকদের ভিজিট দেখিয়েও নেয়া হচ্ছে অর্থ। এই বিষয়ে চিকিৎসকরা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যান। অভিযোগ জানান পরিচালক প্রশাসন ডা. বিল্লাল হোসাইনের কাছে। তাকে ফোন দেয়া হলে বলেন, সংকটকালীন মুহুর্তে বেসরকারি হাসপাতালে নিয়োগ দেয়া যেতে পারে। আর অর্থ নেবার বিষয়ে কোন মন্তব্য করেননি তিনি।
বিডি-প্রতিদিন/শফিক