গাজীপুরের শ্রীপুরের মো. মানিক মিয়াকে (৫৫) নৃশংসভাবে হত্যার তিন মাস পর হত্যার রহস্য উদঘাটন করেছে পুলিশ। ইতিমধ্যে হত্যা মামলার মূল আসামিসহ ৫ জন গ্রেফতার হয়েছে। মানিক মিয়ার সাথে নানামুখী দ্বন্দ্বের কারণে অভিযুক্তরা তাকে হত্যা করে লাশ গুম করার চেষ্টা করেন। পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃত আসামিরা মানিককে হত্যার সাথে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে।
পুলিশ জানায়, গত ১১ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় মানিক মিয়াকে ডেকে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার গাজীপুর ইউনিয়নের গাজীপুর উত্তরপাড়া গ্রামে হিরোফার বাবার বাড়ীতে ডেকে স্বামী-বাবা-ভাই ও ভাড়াটে খুনির সহায়তায় মানিক মিয়াকে শ্বাসরোধ হত্যা করা হয়। মানিক মিয়া (৫৫) শ্রীপুর পৌর এলাকার কেওয়া পশ্চিম খন্ড গ্রামের মৃত শাহাজ উদ্দিনের ছেলে। হিরোফা আক্তার (৪০) উপজেলার তেলিহাটি ইউনিয়নের মুলাইদ গ্রামের লিটন মিয়ার স্ত্রী। তিনি ওই এলাকায় টেইলারিং কাজ করতেন। হত্যার মিশনে হিরোফার বাবা আনোয়ার, ভাই সোহেল ও ভাড়াটে খুনি রেজাউল করিম অংশ নেয়। রেজাউলকে ৩০ হাজার টাকায় খুনের চুক্তি করেন হিরোফার বাবা।
শ্রীপুর থানার উপ-পরিদর্শক রাজীব কুমার দাস ও মো. আশরাফুল্লাহ্ জানান, গত ১১ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় বাড়ি থেকে বাবার আনোয়ার হোসেনের অসুস্থতার কথা বলে কৌশলে মানিক মিয়াকে স্থানীয় সলিং মোড় ডেকে নেন হিরোফা। সেখান থেকে একটি অটোরিক্সায় করে মানিক মিয়াকে কয়েক কিলোমিটার দূরের গাজীপুর ইউনিয়নের গাজীপুর উত্তরপাড়া গ্রামের হিরোফার বাবা আনোয়ার হোসেনের বাড়িতে নিয়ে যান। সেখানে পূর্ব থেকেই অবস্থান করছিলেন ভাড়াটে খুনি রেজাউল করিম, হিরোফার স্বামী লিটন ও তার বাবা আনোয়ার হোসেন ও তার ভাই সোহেল মিয়া। তাদের মধ্যে বেশ আলাপচারিতার পর রাতে রেজাউল ও সোহেল মিলে প্রথমে মানিকের গলায় গামছা পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন। পরে হিরোফা-লিটন মিলে ধারালো চাকু ও দা দিয়ে প্রথমে গলা পরে দুই হাত-দুই পা কেটে বিচ্ছিন্ন করে বাড়ীর পাশের শৌচাগারের গর্তে ভেতরে মানিক মিয়ার মরদেহ ফেলে দেন। ২/৩ দিন পর মরদেহ পচে গলে সেখান থেকে প্রচুর গন্ধ বের হতে থাকে। গন্ধ ছড়ালে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে আনোয়ার হোসেন খবর দেন ভাড়াটে খুনি রেজাউলকে। রাতের আঁধারে সেই লাশটি শৌচাগারের গর্ত থেকে তুলে কিছুদূরের একটি ধানের জমির কাদাযুক্ত মাটিতে পুঁতে রেখে দেয়া হয়। ১৪/১৫দিন পর শিয়ালে সেই লাশটির আংশিক অংশ তুলে ফেললে আবারও খুনিরা লাশটি সেখান থেকে তুলে নিয়ে পলিথিনে মুড়িয়ে পাশের পুকুরে কাদা চাপা দিয়ে রাখেন। পরদিন পাশের বাড়ির এক মহিলা গরুকে গোসল করাতে গিয়ে মরদেহটি ভেসে থাকতে দেখে স্থানীয়দের খবর দেয়। ৩ এপ্রিল দুপুরে শ্রীপুর থানা পুলিশ মরদেহটি উদ্ধার করে। দেহটি পচে গলে বিকৃত হয়ে যাওয়ায় ও আংশিক দেহটি মানুষ না পশুর এমন ধরনের সন্দেহে পড়েন পুলিশ। বিভিন্ন পরীক্ষার পর মানুষের লাশ নিশ্চিত হওয়ার পর তারা অজ্ঞাত হিসেবে লাশটি উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে প্রেরণ করেন।
এদিকে মানিক মিয়া বাড়ি ফিরে না আসায় তার ছেলে অ্যাডভোকেট মোস্তাফিজুর রহমান মিলন নিখোঁজের পর দিনই ১২ ফেব্রুয়ারি শ্রীপুর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। এ ডায়েরির সূত্র ধরেই তদন্ত শুরু করে শ্রীপুর থানা পুলিশের একটি টিম। নিখোঁজের কয়েকদিন পর ২২ ফেব্রুয়ারি মানিক মিয়ার ছেলের মুঠোফোনে মুক্তিপণের টাকা দাবি করে একটি ক্ষুদেবার্তা আসে। সে বার্তায় খুলে দেয় মানিক মিয়া হত্যার মূল রহস্য।
প্রথমে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় ক্ষুদেবার্তা প্রেরণকারী হিরোফার ভাই সোহেলকে শ্রীপুর থেকে আটক করে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পরে তার দেয়া তথ্য মতে, গত ১৬ মে রাতে পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ ও ঠাকুরগাঁওয়ের সদর থানার বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালান শ্রীপুর থানার উপ-পরিদর্শক রাজিব কুমার সাহা ও আশরাফুল্লাহ। পরে সেখান থেকেই হিরোফা-লিটন দম্পতিকে আটক করা হয়। এছাড়াও গাজীপুর উত্তরপাড়া গ্রাম থেকে হিরোফার বাবা আনোয়ার হোসেন ও একই গ্রামের ভাড়াটে খুনি রেজাউল করিমকে আটক করা হয়। আটকের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের খুনিরা হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা পুলিশের কাছে স্বীকার করেছে।
শ্রীপুর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মনিরুজ্জামান জানান, মানিক মিয়ার সাথে নানামুখী দ্বন্দ্বের কারণে অভিযুক্তরা মানিক মিয়াকে হত্যা করে লাশ গুম করার চেষ্টা করেন। তারা সকলেই পুলিশের কাছে হত্যার বর্ণনা দিয়ে দোষ স্বীকার করেছেন। তাদের জবানবন্দির আলোকে অনেকটা নিশ্চিত হওয়া গেছে উদ্ধারকৃত মরদেহের অংশবিশেষ মানিক মিয়ার। আর মানিক মিয়ার ছেলে মোস্তাফিজুর রহমান মিলনের সাথে ওই দেহের ডিএনএ টেস্টের জন্য পাঠানো হবে। ডিএনএ টেস্টের ফল হাতে পেলে ওই দেহের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যাবে।
তিনি আরও জানান, ইতিমধ্যে আসামি হিরোফা, হিরোফার বাবা আনোয়ার এবং ভাড়াটিয়া খুনি রেজাউল বিজ্ঞ আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে মানিক হত্যার রোমহর্ষক ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দেন।
কালিয়াকৈর সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার আল-মামুন জানান, পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃত সকল আসামি মানিককে হত্যার দায় স্বীকার করেছে। হিরোফা তার পরিবারের অন্য সদস্যদের রক্ষা করতে প্রথমে অন্যলোকদের ও পরে শুধু নিজের সংশ্লিষ্টতার কথা বলে তদন্ত কর্মকর্তাদের বিভ্রান্ত করার পরিকল্পনা করে। কিন্তু পুলিশ বিভিন্ন কৌশলে একের পর এক প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্নিত করে এবং একাধিক অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করে।
বিডি প্রতিদিন/ফারজানা