শনিবার, ২৬ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী

শিক্ষায় প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি : করোনাকালীন বাজেট

ড. আ ন ম এহছানুল হক মিলন

শিক্ষায় প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি : করোনাকালীন বাজেট

Education is the most powerful weapon which you can use to change the world. - Nelson Mandala. আজন্ম স্বাধীন, সম্পদবিহীন ব্রিটেন সূর্যাস্তবিহীন রাজ্যশাসন করে সম্পদের পাহাড় গড়েছিল মেধা আর শিক্ষা দিয়ে। ইতিহাস বলে, বিশে^র যে দেশ যত বেশি উন্নতির সোপান গড়েছে সে দেশ তত বেশি শিক্ষায় বিনিয়োগ করেছে। আকাশচুম্বী প্রত্যাশা নিয়ে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ। শতভাগ নিরক্ষরতা দূরীকরণ, নারী শিক্ষা, বৈষম্যবিহীন একমুখী শিক্ষা, মেধার মূল্যায়ন, মেধা পাচার রোধ, শিক্ষকতায় মেধাবীদের সর্বাধিক মূল্যায়ন, উচ্চশিক্ষায় গবেষণা, দলীয় প্রভাবমুক্ত শিক্ষা প্রশাসন, কারিগরি শিক্ষার উন্নয়ন, মাদরাসা শিক্ষায় আধুনিকীকরণ, সর্বোপরি সুশিক্ষিত জাতি গঠন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রেখে জাতি গঠনে শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হবে, এটিই ছিল প্রত্যাশা। এই তো সেদিনের কথা। এসএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। শুরু হয়ে গেল মুক্তিযুদ্ধ। হলাম স্বাধীন, পেলাম লাল-সবুজের পতাকা। পেরিয়ে গেল ৫০টি বছর। সুবর্ণজয়ন্তীতে এসে প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির হিসাব কষছি। ১৯৭২ সালে সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পরীক্ষা হলো, ১৯৭১ ও ’৭২ - এ দুই বছরের সব পরীক্ষা। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা হলো ৩০০ নম্বরের। আর পাবলিক পরীক্ষা ছাড়া সব ক্লাসে অটো প্রমোশন।

যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ। সাড়ে ৭ কোটি মানুষের দেশ, প্রথম বাজেট, মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকা, শিক্ষায় বরাদ্দ ১৭৩ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ২২ শতাংশ, আর এবার ২০২১-২২ সালের বাজেটে শিক্ষায় বরাদ্দ ১১.৯২ শতাংশ! প্রথম বাজেটে শিক্ষা বরাদ্দ ছিল এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ বরাদ্দ। গ্রিক দার্শনিক Diogenes বলেন, The foundation of every state is the education of its youth. সে অর্থে তরুণদের দ্বারা সদ্যস্বাধীন দেশে শিক্ষার শুরুটা ছিল যথার্থ।

আজ ২০২১ সাল। এবারের বাজেট ৬ লাখ ৩ হাজার কোটি টাকার আর শিক্ষায় বরাদ্দ প্রায় ৭১ হাজার কোটি টাকা। আজকের প্রেক্ষাপটে আমাদের দেশের বাজেটে শিক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়ার মতো সুযোগ সৃষ্টি হওয়ার পরও ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে কোনো প্রতিফলন ঘটেনি। এতে জাতীয় প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৭.২% এবং মূল্যস্ফীতি ৫.৩%। যদিও মোট রাজস্ব আয় দেখানো হয়েছে ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা, বিদেশি উৎস থেকে ১ লাখ ১ হাজার ২২৮ কোটি টাকা এবং ঘাটতি ২ লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবাসহ মৌলিক চাহিদা পূরণে বাজেট বিশেষ ভূমিকা রাখবে এটাই ছিল জনগণের আকাক্সক্ষা। ইউনেস্কো কমিশন থেকে শুরু করে বিভিন্ন দেশি শিক্ষাবিদের প্রত্যাশা ছিল এই অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের ২০% শিক্ষায় বরাদ্দ দেওয়ার। কিন্তু গতানুগতিকভাবে এ বছরও শিক্ষায় বরাদ্দ হয়েছে ১১.৯২%। জাতীয় আয়ের (জিডিপি) হিসাবে ২.০৮% অর্থাৎ বড় বাজেটে সীমিত বরাদ্দ। যদিও আমরা বরাবরই শুনি শিক্ষা খাতে প্রায় ১৫% বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে অর্থাৎ মানবসক্ষমতা উন্নয়নের ক্ষেত্রে সরকার বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। এবারও শিক্ষা খাতে বাজেটের বরাদ্দ বেশি দেখানোর জন্য অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের বাজেটকে সম্পৃক্ত করে শিক্ষা ও প্রযুক্তি মিলিয়ে ৯৪ হাজার ৮৭৭ কোটি টাকা, অর্থাৎ মোট বাজেটের ১৫.৭% বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সারসংক্ষেপে বলা চলে, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রাক্কলিত ২৬ হাজার ৩১৪ কোটি টাকা, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষায় প্রাক্কলিত ৩৬ হাজার ৪৮৬ কোটি টাকা, কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগে ৯ হাজার ১৫৩ কোটি টাকা এবং অন্যান্য অপারেটিং, উন্নয়ন সব মিলিয়ে মূলত এককভাবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ মোট জাতীয় বাজেটের ১১.৯২%। যদিও বলা হচ্ছে চলতি অর্থবছরে জাতীয় বাজেটে সর্বোচ্চ বরাদ্দ শিক্ষা খাতে! বাজেটে রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ব্যয়ের কিছু অংশও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সংযুক্ত। অন্যদিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়। সব মিলিয়ে শিক্ষা, বিজ্ঞান, তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের বাজেটে সর্বোচ্চ ব্যয় ৯৪ হাজার ৮৭৭ কোটি টাকা অর্থাৎ ১৫.৭% বরাদ্দ করা হয়েছে। একেই বলা হয় শুভংকরের ফাঁকি।

দেশের প্রথম শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয় বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও বিজ্ঞানী ড. কুদরাত-এ-খুদাকে চেয়ারম্যান করে ১৯৭২ সালের ২৬ জুলাই। কমিশন ১৯৭৪ সালের ৩০ মে দেশের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা এবং সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের ওপর ভিত্তি করে রিপোর্ট পেশ করে। সরকার ১৯৭৮ সালে কুদরাত-এ-খুদা কমিশনের রিপোর্ট পর্যালোচনা করে একটি উপদেষ্টা কমিটি নিয়োগ দেয়। এ কমিটি ১৯৭৯ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি অন্তর্বর্তীকালীন শিক্ষানীতি সুপারিশ শিরোনামে একটি রিপোর্ট পেশ করে। ১৯৮৩ সালে গঠন করা হয় মজিদ খান শিক্ষা কমিশন। যদিও ওই কমিশনের রিপোর্ট ব্যাপক প্রচার লাভ করেনি এবং সুপারিশ বাস্তবায়নের কোনো আনুষ্ঠানিক উদ্যোগও নেওয়া হয়নি। ১৯৮৭ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর মফিজউদ্দীন আহমদকে প্রধান করে শিক্ষা কমিশন নিয়োগ করে তৎকালীন সরকার। এ কমিশনকে দেশে শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার, পুনর্বিন্যাস ও উন্নয়নের উপায় সুপারিশের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কমিশন ১৯৮৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি সরকারের কাছে রিপোর্ট পেশ করে। কমিশন দেশে উচ্চশিক্ষার অগ্রগতি ও উৎকর্ষের ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা-সংবলিত সুপারিশ পেশ করে। ১৯৯৭ সালের ১৪ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর এম শামসুল হককে চেয়ারম্যান করে ৫৬ সদস্যবিশিষ্ট শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়। ওই কমিশনকে দায়িত্ব দেওয়া হয় একটি বাস্তবধর্মী, গণমুখী ও গতিশীল শিক্ষানীতি প্রণয়নের। বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের লক্ষ্যে মেধা ও প্রবণতার ভিত্তিতে শিক্ষা ক্ষেত্রে সমঅধিকার নিশ্চিত করার প্রতি কমিশন বিশেষ গুরুত্বারোপ করে।

শিক্ষা ক্ষেত্রে আশু বাস্তবায়নযোগ্য সংস্কার চিহ্নিত করার লক্ষ্যে ২০০১ সালে ড. এম এ বারীর নেতৃত্বে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটি ২০০২ সালে রিপোর্ট পেশ করে এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে কতিপয় সংস্কার ও পরিবর্তনের সুপারিশ করে। শিক্ষার মানোন্নয়ন এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে সংস্কার সাধনের লক্ষ্যে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় সরকার ২০০৩ সালের জানুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মিয়াকে চেয়ারম্যান করে শিক্ষা কমিশন গঠন করে। কমিশন ২০০৪ সালের মার্চে সরকারের কাছে রিপোর্ট পেশ করে। কমিশন শিক্ষার সার্বিক ক্ষেত্রে মোট ৮৮০টি সুপারিশ প্রণয়ন করে।

বিগত দিনের শিক্ষা কমিশনের অপ্রতিফলিত দিকগুলো বিবেচনায় না নিয়ে আবারও ২০০৯ সালে জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি ১৬ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটি ১৯৭৪ সালের কুদরাত-এ-খুদা কমিশন রিপোর্ট এবং ১৯৯৭ সালের শামসুল হক শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের আলোকে একটি নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে। জাতীয় শিক্ষানীতি, ২০০৯-এর খসড়া সরকারের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে পেশ করা হয় ২০০৯ সালের ৭ সেপ্টেম্বর। কমিটি বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য একটি কমিশন গঠনেরও সুপারিশ করে।

পাঁচ দশকে ভৌত-অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভাগ বাড়ছে, প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ৩৮টি সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত এবং ১৪৮টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। গবেষণায় বরাদ্দ না থাকা, ছাত্র-শিক্ষকের আনুপাতিক হার অত্যধিক হওয়া, মানসম্মত শিক্ষকের অভাব, আন্তর্জাতিক ছাত্র ও শিক্ষকের অনুপস্থিতির কারণে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড-খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আজ কিউএস রেটিংয়ে হারিয়েছে তার ঐতিহ্য। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে দলীয় বিবেচনায়, ভিসি নিয়োগ হচ্ছে সরকারি আনুগত্য বিবেচনা করে। ২০২০ সালের বৈশি^ক জ্ঞানসূচকে ১৩৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১২তম। আরও দুঃখজনক হচ্ছে, দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সবার নিচে। প্রত্যাশা আকাশচুম্বী আর প্রাপ্তিতে তুষ্ট কি না জানি না। তবে স্বল্প আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে পর্দাপণ- এ যেন বিরাট পাওয়া। মূলত ২০০৭ থেকে ২০৪১ সাল পর্যন্ত আমাদের দেশে জনসংখ্যাতাত্তি¡ক লভ্যাংশ পেতে হলে দেশের উপযুক্ত কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগাতে হবে। তারই সিংহভাগ ১৫ বছর বয়স থেকে ৬৫ বছর পর্যন্ত মোট জনসংখ্যার ৬৫ শতাংশ। টেকসই উন্নয়নের জন্য দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই। এদিকে বিশ্বায়নের যুগে শিল্পবিপ্লবের চতুর্থ ধাপে সারা বিশ্ববাসীকে তা মোকাবিলা করতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা Artificial Intelligence, Robotics, Nano Technology-এর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হবে। এমনকি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আয় প্রবাসীদের মাধ্যমে উপার্জিত হলেও প্রশিক্ষিত মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য কারিগরি শিক্ষা অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। অর্থাৎ মানবসম্পদ ও আর্থসামাজিক উন্নয়নে কারিগরি শিক্ষার ভূমিকাও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যদি মানবসম্পদ উন্নয়নে ব্যর্থ হই তাহলে বুমেরাং হবে জনসংখ্যাতাত্তি¡ক লভ্যাংশ; তার পরও বাজেটে এর প্রতিফলন হয়নি। কিন্তু বিধিবাম! এরই মধ্যে মহামারী করোনা। এবার কিন্তু ঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক আক্রমণে আমরা একা নই। ১৯১৮ সালে প্রাণঘাতী স্প্যানিশ ফ্লুর আক্রমণে ধসে পড়েছিল পশ্চিমা বিশ্ব। বলা হয়, ৫ কোটির বেশি আদমসন্তানকে অকালে বিদায় নিতে হয়েছিল বিশ্বপরিমন্ডল থেকে। কিন্তু থেমে থাকেনি শিক্ষা। সেই ভয়াল দুর্যোগের মধ্যেও বীরোচিতভাবে সংকট মোকাবিলা করে শিক্ষাকে এগিয়ে নেওয়া হয়। এ যেন ডাকপিয়নের চিঠি বিতরণের মতো। বৃষ্টি নেই, ঝড়-ঝঞ্ঝা নেই, আলো নেই, লণ্ঠন নিয়ে ছুটছে চিঠি বিতরণ করতে। তেমনিভাবে শিক্ষাকে থামাতে পারেনি ২০১৯ সালের শেষের দিকে চীনের উহান প্রদেশ থেকে জন্ম নেওয়া কভিড-১৯। বিশ্বপরিভ্রমণে বেরিয়ে আহত, ব্যথিত ও হৃদয়ে রক্তক্ষরণ করিয়েছে বিশে^র ২১০টি দেশের প্রায় ৭০০ কোটি মানুষকে। পৃথিবী থেকে ৩৯ লক্ষাধিক এ যাবৎ পরপারে পাড়ি জমিয়েছে, আক্রান্ত প্রায় ১৯ কোটি। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার ভবিতব্য দ্বিতীয় ঢেউয়ে আরও নিষ্ঠুর ভয়াবহতার রূপ নেবে। কিন্তু এর পরও পৃথিবীর কোনো দেশে শিক্ষা থেমে থাকেনি। শুধু আফ্রিকার চারটি, ল্যাটিন আমেরিকার নয়টি ও দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র বাংলাদেশসহ মোট ১৪টি দেশে থেমে আছে শিক্ষার চাকা। বর্তমানে কভিড-১৯ মহামারীর ছোবলে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের পাশাপাশি দ্বিতীয় যে খাতটি সীমাহীন ক্ষতির মুখে পড়েছে তা হলো শিক্ষা। সেভ দ্য চিলড্রেন বলেছে, করোনাভাইরাস হয়তো একদিন চলে যাবে কিন্তু ৯৭ লাখ শিশু আর কখনো স্কুলে ফিরবে না। আর বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, করোনাভাইরাস খুব শিগগিরই আমাদের ছেড়ে যাচ্ছে না। তাহলে করোনাকে সঙ্গী করে ঢেলে সাজাতে হবে শিক্ষাব্যবস্থা। ইতিমধ্যে এ মহামারী আমাদের গতানুগতিক শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার ক্ষেত্রে অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে। শ্রেণিকক্ষে সশরীরে উপস্থিতির পাশাপাশি অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম চালু রাখার গুরুত্ব বুঝিয়ে দিয়েছে। ২০২১-২২ সালের বাজেটে কভিড-১৯-এর ফলে শিক্ষার্থীরা যে নানামুখী ক্ষতির মুখে পড়েছে তার জন্য দু-তিন বছর মেয়াদি একটি শিক্ষা পুনরুদ্ধার কর্মসূচি বাজেটের প্রয়োজনীয়তা ছিল। অন্যদিকে আমরা বিগত দিনের শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট ও সুপারিশমালা যদি পর্যালোচনা করি তাহলে সেগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে সক্রিয় দৃশ্যমান পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে বলে আদৌ প্রতীয়মান হয়নি।

এ উপমহাদেশে পাবলিক পরীক্ষায় অনাকাক্সিক্ষতভাবে ১৯৪৭ সালে পার্টিশন গ্র্যাজুয়েট, ’৬২ সালে অটো গ্র্যাজুয়েট, ’৭২ সালে অটো পাস ও নকলের অনুপ্রবেশ এবং ২০২০ সালে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় অটো পাস করানো হলো ১৪ লাখ ছাত্রছাত্রীকে। সর্বশেষ ২০২১ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান প্রথম বর্ষে অটো প্রমোশন। এ অটো পাস হবে তাদের জন্য অভিশাপ। উচ্চশিক্ষার পরবর্তী ধাপে গিয়ে তারা পড়বে খাদের মধ্যে। এই শিক্ষার্থীরাই আগামী দিনের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রশাসন, কূটনীতিসহ জাতীয় জীবনের সব ক্ষেত্রে হবে সংসদ সদস্য, মন্ত্রী ও রাষ্ট্রদূত, দেশের নীতিনির্ধারক। কেমন করে চালাবে তারা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ? যোগ্যতার কোনো বিকল্প নেই। তাদের যোগ্যতা অর্জনের যে প্রস্তুতি পর্ব তা হয়ে রইল পক্ষাঘাতগ্রস্ত।

ইউনিভার্সিটি অব সাউথ আফ্রিকার সিংহদ্বারে লেখা আছে, ‘কোনো জাতিকে ধ্বংস করার জন্য পারমাণবিক হামলা কিংবা ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের দরকার নেই। বরং সে জাতির শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় প্রতারণার সুযোগ দিলেই হবে। কারণ এভাবে পরীক্ষা দিয়ে তৈরি হওয়া ডাক্তারদের হাতে রোগীর মৃত্যু হবে। ইঞ্জিনিয়ারদের দ্বারা দালানকোঠা, ইমারত ধ্বংস হবে এবং অর্থনীতিবিদদের দ্বারা দেশের আর্থিক খাত দেউলিয়া হবে। এ ছাড়া বিচারকদের হাতে বিচারব্যবস্থার কবর রচনা হবে। সুতরাং শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়ার মানে হলো একটি জাতির বিলুপ্তি।’

লেখক : সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী, চেয়ারম্যান (ইআরআই)।

ইমেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর