শুক্রবার, ২২ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা

কুমিল্লার ঘটনা দুঃখজনক, বিচার হবে অপরাধীর : প্রধানমন্ত্রী

নিজস্ব প্রতিবেদক

কুমিল্লার ঘটনা দুঃখজনক, বিচার হবে অপরাধীর : প্রধানমন্ত্রী

আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক দেশ। এখানে সব ধর্মের মানুষ সম্মানের সঙ্গে যুগের পর যুগ বসবাস করছে। মহান মুক্তিযুদ্ধে সব ধর্মের মানুষ রক্ত দিয়েছে। পবিত্র কোরআন অবমাননাকে কেন্দ্র করে কুমিল্লায় যে ঘটনা ঘটেছে তা খুবই দুঃখজনক। এ ঘটনায় অপরাধী যে-ই হোক না কেন তার বিচার করা হবে। গতকাল সকালে কুমিল্লা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হন। কুমিল্লায় আওয়ামী লীগের কার্যালয় উদ্বোধন করে দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, যেহেতু এটা কুমিল্লা শহরে, মহানগর অফিস বললে হবে না। এটা কুমিল্লা আওয়ামী লীগ অফিসই বলতে হবে।

কুমিল্লা প্রান্ত থেকে ভিডিও কনফারেন্সে গণভবনের সঙ্গে সংযুক্ত ছিলেন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন, কুমিল্লা সদর আসনের সংসদ সদস্য ও কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারসহ স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা।

শেখ হাসিনা বলেন, মানবধর্মকে সম্মান করা ইসলাম আমাদের শেখায়। নিজের ধর্ম পালনের অধিকার যেমন সবার আছে। অন্যের ধর্মকে কেউ হেয় করতে পারে না। নিজের ধর্মকে সম্মান করার সঙ্গে সঙ্গে অন্যের ধর্মকেও সম্মান করতে হয়। তিনি বলেন, অন্যের ধর্মকে হেয় করলে নিজের ধর্মকেই অসম্মান করা হয়। নিজের ধর্মের সম্মান নিজেকেই রক্ষা করতে হবে।

এলাকায় নজরদারি বাড়ান : সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে প্রতিটি এলাকায় আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের নজরদারি বাড়ানোর নির্দেশ দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে হবে। প্রত্যেকটা এলাকায় আমাদের নেতা-কর্মীদের নজরদারি বাড়াতে হবে। শান্তি-সম্মেলন, শান্তি-মিছিল, শান্তি-সভা করতে হবে। সম্প্রীতির ব্যবস্থা নিতে হবে, যেন কোনো রকমের সংঘাত দেখা না দেয়। তিনি বলেন, এই মাটিতে প্রত্যেকটা ধর্মের মানুষ সে মুসলমান হোক, খ্রিস্টান হোক, হিন্দু হোক, বৌদ্ধ হোক সবাই যেন ভালোভাবে বাঁচতে পারে। মানুষকে মানুষ হিসেবে আমি দেখি। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদেরও মানুষকে মানুষ হিসেবেই দেখতে হবে। আর সেভাবে মানুষের সেবা করতে হবে।  অপরাধীদের বিচার সরকার করবে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আইন কেউ হাতে তুলে নেবেন না। কেউ যদি অপরাধ করে, সে যেই হোক অপরাধীদের বিচার হবে। আমাদের সরকার সেই বিচার করবে। শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের নবী বলেছেন ধর্ম নিয়ে কেউ বাড়াবাড়ি করবে না। আমাদের সবারই সে কথাটা মেনে চলতে হবে। সে কথাটা স্মরণ করতে হবে। তাহলে আমরা ইসলামের সঠিক শিক্ষাটা পাব। প্রত্যেকটা ধর্মই শান্তির কথা বলে। সবাই শান্তি চায়।

ক্ষতিগ্রস্তদের ঘরবাড়ি তৈরি করে দেওয়া হবে : সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের ষড়যন্ত্রে ক্ষতিগ্রস্তদের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কুমিল্লার ঘটনার পর পীরগঞ্জসহ বিভিন্ন জায়গায় ঘটনা ঘটেছে। যাদের ঘরবাড়ি পুড়েছে, তাঁবু করে তাদের থাকার ব্যবস্থা, প্রথমে শুকনো খাবারের ব্যবস্থা, রান্না করা খাবার দেওয়া হচ্ছে। তাদের কাপড়চোপড় সব রকম ব্যবস্থা করা হচ্ছে। চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হচ্ছে, যাদের এভাবে ক্ষতি হয়েছে, ক্ষতিগ্রস্ত সবাইকে আমরা ঘরবাড়ি তৈরি করে দেব এবং ইতিমধ্যে সে ব্যবস্থা আমরা নিয়েছি। শেখ হাসিনা বলেন, যেখানেই এভাবে মানুষের ওপর নির্যাতন হয়, আওয়ামী লীগ মানুষের পাশে থাকে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় আওয়ামী লীগ মানুষের পাশে থাকে। বিএনপি-জামায়াত তাদের কাজই হলো ধ্বংস করা। তিনি বলেন, সার্বিকভাবে আমরা উন্নয়ন করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। প্রকৃতপক্ষে দেশটা যখন উন্নত হচ্ছে, একটা শ্রেণি আছে, তারা এটা কখনো মানতে পারে না। বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে চলবে, সম্মান নিয়ে চলবে, এটা বোধ হয় এদের পছন্দই হয় না। আর বিশেষ করে বিএনপি-জামায়াত এদের তো হবেই না। কারণ খালেদা জিয়ার নিজেরেই অন্তরে সব সময় ছিল পেয়ারে পাকিস্তান। সে তো সব সময় পেয়ারে পাকিস্তান নিয়েই থাকত। এটা হলো বাস্তব কথা। আওয়ামী লীগের প্রতিটি নেতা-কর্মীকে জাতির পিতার আদর্শ নিয়ে চলার নির্দেশ দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, করোনা এমন একটা শিক্ষা দিল যতই সম্পদ হোক, এই সম্পদ কিছুই না। মানুষ জন্মালে মরতে হবে আর মরলে সবকিছু পড়ে থাকবে। শুধু এই সম্পদের জন্য কাড়াকাড়ি করে নিজের সম্মান, পরিবারের সম্মান নষ্ট করা। মানুষের জীবনটা সুন্দরভাবে চলার জন্য যেটুকু, সেটুকু থাকলেই যথেষ্ট।

মেঘনা নামে কুমিল্লা এবং পদ্মা নামে ফরিদপুর বিভাগ : কুমিল্লা বিভাগ করার দাবি প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, মেঘনা নামে কুমিল্লা এবং পদ্মা নামে ফরিদপুর বিভাগ করা হবে। কু নাম দিয়ে আমি কোনো বিভাগ দেব না।  তিনি বলেন, বিভাগের ব্যাপারে আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি দুটো বিভাগ বানাব দুটো নদীর নামে। একটা পদ্মা, আরেকটা মেঘনা। এই দুই নামে দুটো বিভাগ করতে চাই। এ সময় কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার দাবি জানিয়ে বলেন, আপা কুমিল্লার নামে। সারা কুমিল্লার মানুষ কুমিল্লা নামে চায়। জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই ‘কু’ নাম দেব না আমি। আমি কুমিল্লা নামে দেব না। কারণ তোমার এই কুমিল্লা নামের সঙ্গে মোশতাকের নাম জড়িত। সে জন্য দেব না। না, আমি দেব না তো বললাম। তোমরা যদি রাজি থাকো ওই কুমিল্লা নাম নিলেই মোশতাকের কথা মনে আসে। এ সময় বাহাউদ্দিন বাহার বলেন, আপা, পৃথিবীর কোনো কুলাঙ্গারের ওপর দেশের পরিচয় হয় না। বাংলাদেশের পরিচয় বঙ্গবন্ধুর ওপর। মোনায়েম খানের ওপর না। বঙ্গবন্ধুকেই চেনে বাংলাদেশ, সারা বিশ্ব। যখন বাংলাদেশ চিনত বলত শেখ মুজিবের দেশ। কুমিল্লা নামে অন্য জেলাগুলো আসতে চায় না জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই নামে অন্য জেলাগুলো আসতে চায় না। আমরা চেষ্টা করেছি তো। নোয়াখালী আসবে না, ফেনী আসবে না, চাঁদপুর আসবে না, লক্ষ্মীপুর আসবে না, ব্রাহ্মণবাড়িয়া আসবে না। তিনি বলেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া চায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া নাম হোক, ফেনী চায় ফেনী নাম হোক, চাঁদপুর নাম তো আরও সুন্দর, চাঁদপুর চায় চাঁদপুর হোক। বাহাউদ্দিন বলেন, আপা আপনি দিলেই সবাই মানবে। তখন প্রধানমন্ত্রী বলেন, তুমি (বাহাউদ্দিন) সবার কাছ থেকে লেখায় আনো। তোমাকে দায়িত্ব দিলাম সবার কাছ থেকে মানায় নিয়ে আসো। যাও। শেখ হাসিনা বলেন, যদি বিভাগ চাও আমি মেঘনা নামে করে দিতে পারি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি ফরিদপুর বিভাগ করব পদ্মা নামে। ফরিদপুর নামও দিচ্ছি না। ফরিদপুর সেটা হবে পদ্মা আর কুমিল্লা হবে মেঘনা নামে। কারণ পদ্মা মেঘনা যমুনা তোমার আমার ঠিকানা। এই স্লোগান দিয়ে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন করেছে। তিনি বলেন, কুমিল্লার আসল নাম ছিল ত্রিপুরা। এটা ভুলে যেও না। এখনো পুরনো কাগজে ত্রিপুরা লেখা আছে। পুরনো দলিলে ত্রিপুরা লেখা আছে। বিভাগের নামকরণ বিষয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ঠিক আছে আমার প্রস্তাব রাখলাম, যদি পছন্দ হয় ভালো, না হলে হবে না। আমি কী করব। আমাদের দুইটা বড় নদী, নদীর নামটা আমি সম্মান দিয়ে রাখতে চাই। যে স্লোগান দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছি, সেই স্লোগান দিচ্ছি।

ব্যবসায়ীরা বিদেশে বিনিয়োগ করবেন, সেই সুযোগটাও সৃষ্টি করব : এর আগে সকালে গণভবন থেকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আয়োজিত অনুষ্ঠানে পূর্বাচল প্রান্তে ‘বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ-চায়না ফ্রেন্ডশিপ এক্সিবিশন সেন্টার’ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি ও ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিংসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন। এ সময় ব্যবসায়ীদের নতুন নতুন বাজার খোঁজার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেন আমরা বিনিয়োগ করতে পারি, সে বিষয়ে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমাদের ব্যবসায়ীরা যেন বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ করতে পারেন, ভবিষ্যতে সেই সুযোগটা সৃষ্টি করব। আমাদের দেশে যেমন বিনিয়োগ হবে, তেমনি আমরা অন্য দেশেও যেন বিনিয়োগ করতে পারি, সে জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। কারণ আমরা উন্নয়নশীল দেশ হয়ে গেছি। কাজেই আমাদের শিল্পোদ্যোক্তারা বিদেশে বিনিয়োগ করবে, সেই সুযোগটাও আমরা সৃষ্টি করতে চাই। প্রধানমন্ত্রী ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে বলেন, আমাদের রপ্তানি আয় বাড়ানোর জন্য যেটা সবচেয়ে বড় প্রয়োজন, সেটা হলো আমাদের পণ্য বহুমুখীকরণ করা। আমরা এখন একমুখী, একটা কিছুর ওপরেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। যেমন আমাদের পোশাকশিল্প।

 তিনি বলেন, আমাদের রপ্তানি টিকে রাখতে হলে নিজস্ব প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াতে হবে। আমি আমাদের ব্যবসায়ীদের বলব, যখন আপনারা পণ্য উৎপাদন করবেন সেটা সময়ের চাহিদার সঙ্গে মিলিয়ে উন্নত মানের পণ্য উৎপাদন করতে হবে। সেখানে কিন্তু কৃপণতা করলে চলবে না। সেটা যদি আপনারা করতে পারেন, তাহলে বাজারে টিকে থাকতে পারবেন। আর আমাদের যত শিল্প খাত আছে তাদের এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। সেই বিষয়ে আমি আপনাদের বলতে পারি, আমাদের সরকারের পক্ষ থেকে যত ধরনের সহযোগিতা প্রয়োজন, তা আপনারা পাবেন। কিন্তু আপনাদের নিজস্ব উদ্যোগটাও থাকতে হবে। আর আমাদের দেশের পণ্যের বৈচিত্র্যকরণটাও সম্ভব। যেমন এখন আমরা আইসিটি অর্থাৎ ডিজিটাল ডিভাইস প্রস্তুত করছি এবং এই ক্ষেত্রে বিনিয়োগও আসছে। আমি মনে করি এই ডিজিটাল ডিভাইসগুলো হবে এক সময় সবচেয়ে বড় রপ্তানি পণ্য। কাজেই সেখানে আমাদের একটা বড় সুযোগ রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ব্যবসায়ীদের নতুন নতুন বাজার খোঁজার আহ্বান জানিয়ে বলেন, আমাদের শুধু একমুখী হলে হবে না। কোন দেশে কোন পণ্যের চাহিদা বেশি সেটাও ঠিক করতে হবে। তিনি বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্য দিয়েই কিন্তু উন্নতি হয়। কাজেই সেই ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগটা সৃষ্টি করার জন্য আমরা এই সেন্টারটি তৈরি করেছি। ‘বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ-চায়না ফ্রেন্ডশিপ এক্সিবিশন সেন্টার’ উদ্বোধনের মাধ্যমে একটা স্থায়ী জায়গা আপনাদের হলো। কাজেই সংশ্লিষ্ট সবাইকে আহ্বান জানাব, এ জায়গাটি যেন সুরক্ষিত থাকে এবং ভালো থাকে সেদিকে সবাই দৃষ্টি দেবেন। এটা এখন আমাদের নিজস্ব সম্পদ হলো। স্থায়ী সম্পদ হলো। কাজেই আপনারা একে যথাযথভাবে ব্যবহার করবেন এবং রক্ষা করবেন। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের প্রসঙ্গ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৫২ সালে জাতির পিতা প্রথম চীন ভ্রমণ করেন। তার নয়াচীন ভ্রমণ বইটা যদি আপনারা পড়েন তাহলে জানতে পারবেন চীন সম্পর্কে। তখনকার সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশটি কীভাবে উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছিল, সেই বিষয়গুলো চমৎকারভাবে তিনি লিখে গেছেন। এরপর তিনি যখন মন্ত্রী ছিলেন ১৯৫৭ সালে, আবার চীন ভ্রমণ করেন। কাজেই চীনের সঙ্গে আমাদের সব সময় একটা ভালো সম্পর্ক রয়েছে।

সর্বশেষ খবর