সাফারি পার্কে জেব্রা মৃত্যুর কারণ তদন্ত করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। অনুসন্ধানে এসব মৃত্যুর যেসব কারণ বেরিয়ে এসেছে তাতে প্রাণী ছাড়াও মানুষের মৃত্যুর আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
সিআইডি কর্মকর্তারা বলছেন, খাবারে প্রাণী ও মানুষ কী পরিমাণ কেমিক্যাল নিচ্ছে তা পরিমাপ করার যন্ত্র দেশের কোনো ল্যাব বা প্রতিষ্ঠানে নেই। আর প্রাণীদের ঘাসে রাসায়নিক সারও দেওয়া হয় অনুমানে নির্ভর করে। সে ঘাস প্রাণীকে খেতে দেওয়ার আগে তাতে কী পরিমাণ কেমিক্যাল আছে তা জানার কোনো উপায় নেই।
গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে ১১টি জেব্রা মৃত্যুর কারণ নির্ণয়ে সিআইডি যে প্রতিবেদন তৈরি করেছে তা থেকে জানা যায়, ২ জানুয়ারি থেকে ৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১১টি জেব্রা, একটি সিংহ ও একটি বাঘ মারা যায়। ২ জানুয়ারি মারা যাওয়া দুটি জেব্রার পেটে লম্বা ছিদ্র ছিল। ৩ জানুয়ারি মারা যাওয়া একটি জেব্রার পেটে লম্বা ছিদ্র ছিল। ৮ জানুয়ারি মারা যাওয়া একটি জেব্রার মুখে লালা ছিল, পেশি শক্ত ছিল। ৯ জানুয়ারি মারা যাওয়া একটি জেব্রার মুখেও লালা ছিল, পেশি শক্ত ছিল। ১১ জানুয়ারি মারা যাওয়া দুটি জেব্রার মুখে লালা ছিল, পেশি শক্ত ছিল। ১২ জানুয়ারি মারা যাওয়া বাঘটি দেড় মাস অসুস্থ ছিল। ২১ ও ২৪ জানুয়ারি মারা যাওয়া দুটি জেব্রার মুখেও লালা ছিল, পেশি শক্ত ছিল। ২৯ জানুয়ারি মারা যাওয়া আরও দুটি জেব্রার মুখেও লালা ছিল, পেশি শক্ত ছিল। ৩ ফেব্রুয়ারি মারা যাওয়া সিংহটি পাঁচ মাস অসুস্থ ছিল।
ওই প্রতিবেদনে মৃত্যুর যেসব কারণ উল্লেখ করা হয়েছে তার মধ্যে আছে- জেব্রার খাদ্য ঘাসে নাইট্রেট নাইট্রোজেনের আধিক্য।
জেব্রার শুকনা ফিডে কবুতরের বিষ্ঠাসহ নানা ক্ষতিকারক উপাদান থাকা। এ ছাড়া ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগেও মৃত্যু হয়েছে।
প্রাণীগুলোর মৃত্যুর কারণ খুঁজতে সিআইডি ৯ ও ১৬ ফেব্রুয়ারি জাতীয় পর্যায়ের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে দুটি পরামর্শ সভার আয়োজন করে। এসব সভায় ছিলেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক ড. ফিরোজ জামান, আইসিডিডিআরবির গবেষক ড. আশরাফুল ইসলাম, সিডিআইএলের প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক গোলাম আযম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের অধ্যাপক আনোয়ারা বেগম, বায়ো-কেমিস্ট্রি বিভাগের অধ্যাপক ইয়ারুল কবির, সাফারি পার্কের ভেটেরিনারি সার্জন হাতেম সাযযাদ, ঢাকা চিড়িয়াখানার পরিচালক আবদুল লতিফ, সিডিআইএলের ভেটেরিনারি সার্জন বযলুর রহমান, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সাইফুল ইসলাম, চট্টগ্রামের সিভিএএসইউর প্যাথলজিস্ট ডা. মাসুদুজ্জামান ও আইসিডিডিআরবির অ্যানিমল বিভাগের হেড সুমন কুমার পাল।
সাফারি পার্কের নতুন ও পুরনো খাবার ঘাস, জেব্রার পুরনো ও নতুন বিষ্ঠা, চারণভূমির মাটি, শুকনা ফিড, কবুতরের বিষ্ঠাসহ শুকনা ফিড, জেব্রার পান করা পানি, জেব্রা পানি পান করে এমন জলাশয় এবং জেব্রা খায় এমন ঘাস থেকে নমুনা সংগ্রহ করে সিআইডির কেমিক্যাল ল্যাবে পরীক্ষা করা হয়।
ল্যাবে পাওয়া নমুনার ফল ওই তদন্ত প্রতিবেদনেও তুলে ধরা হয়েছে। কেমিক্যাল ল্যাবের নমুনা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, নতুন ও পুরনো ঘাস, লিভার ও ইনজেস্টা; এর মধ্যে নাইট্রেট নাইট্রোজেনের আধিক্য পাওয়া যায়। সাতটি জেব্রা মারা গেছে নাইট্রেট নাইট্রোজেনের বিষক্রিয়ায়। তিনটি জেব্রার মৃত্যু হয়েছে এন্ডোটক্সেমিয়া জটিলতায় এবং একটি মারা গেছে করোনায়।
তদন্তে প্রাণীগুলোর মৃত্যুর কারণ বিষয়ে সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি ইমাম হোসেন এই প্রতিবেদককে জানান, চাষ করা ঘাসে ইউরিয়া দেওয়া হয়। ইউরিয়ায় বিভিন্ন মাত্রার কেমিক্যাল থাকে। সেখান থেকে ঘাস কিংবা ওই জমিতে জন্মানো অন্যান্য উদ্ভিদেও কেমিক্যালের উপস্থিতি পাওয়া যায়। প্রতিটি প্রাণী কিংবা মানুষ নির্দিষ্ট একটি মাত্রার কেমিক্যাল গ্রহণ করতে পারে। সেটি খাবারসহ নানাভাবে গ্রহণ করতে পারে কিংবা শরীরে ঢুকে যেতে পারে। এ কেমিক্যাল প্রবেশ পরিমাপ করার কোনো যন্ত্র বাংলাদেশের কোনো ল্যাবরেটরিতে নেই। বিদেশে এ যন্ত্র আছে। এর মূল্য ২ কোটির কিছু বেশি। অথচ এত বছরেও কেন্দ্রীয় পশু হাসপাতাল, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিক্যাল ল্যাব, সিআইডির কেমিক্যালসহ কোথাও নেই। এ যন্ত্র দ্রুত কেনার জন্য তাঁরা সুপারিশ করেছেন। কেননা সাফারি পার্ক ও চিড়িয়াখানায় প্রাণীগুলোর খাবারে কী পরিমাণ কেমিক্যাল যাচ্ছে তা জানা যাচ্ছে না। মানুষ শাকসবজিতেও কী পরিমাণ কেমিক্যাল নিচ্ছে তা-ও জানা যাচ্ছে না। এতে শুধু প্রাণী নয়, মানুষেরও ফ্যাটি লিভারে মৃত্যুর আশঙ্কা রয়েছে।
তিনটি জেব্রার পেটে লম্বা ছিদ্রের বিষয়ে সিআইডির তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জেব্রাগুলো দেখভালে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জেব্রার মৃত্যুতে হতচকিত হয়ে এ ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য আঘাতও করতে পারেন।
বিডি প্রতিদিন/হিমেল