২৩ ডিসেম্বর, ২০১৯ ১৪:২৮

আগে সম্পর্ককে সম্মান করতে শেখেন...

বাণী ইয়াসমিন হাসি

আগে সম্পর্ককে সম্মান করতে শেখেন...

বাণী ইয়াসমিন হাসি

একটা ফেসবুক গ্রুপে পরিচয়। সেখানে চলতো সাহিত্য আড্ডা,গান, কবিতা বিনিময়। শুরুতে লাইক কমেন্টে সীমাবদ্ধ থাকলেও অল্প কিছুদিন পরই বেশ ভালো বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। মেয়েটা একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আর ছেলেটা জাপানে। রাতভর কথা চালাচালি।

সম্পর্কটা বন্ধুত্ব থেকে আরেকটু বেশি হতে খুব বেশি সময় নেয়নি। রাতজাগা বাড়তে থাকে।‌ সম্পর্কটা শুধু নিছক কথা আর অনুভূতি বিনিময়ে থেমে থাকে না। ওয়াটসআ্যাপ মেসেঞ্জারে বিনিময় হয় টুকরো টুকরো ব্যক্তিগত মুহূর্ত। মেয়েটা ছেলেটার দেশে ফেরার দিন গুনছিল। এক সকালে বন্ধুর ফোনে ঘুম ভাঙে মেয়েটার। মেসেঞ্জার চেক কর। একটা ভিডিও ক্লিপ পাঠিয়েছি, দেখ, মেয়েটা দেখতে একদম তোর মত। মেসেঞ্জার খুলে ভুত দেখার মত চমকে ওঠে মেয়েটা। একি! এতো পরশু রাতের ভিডিওটা। ওতো শুধু রিয়ানকে পাঠিয়েছে। সাইফ এটা কোথা থেকে পেল! সাইফকে কল দিতেই ওপাশ থেকে জানালো ওদের একটা এডাল্ট গ্রুপ আছে। সেখানেই কেউ একজন আপলোড করেছে!

খুব কেজো একটা সম্পর্ক। অফিস শেষে কখনও কখনও একসঙ্গে গাড়ির জন্য ওয়েট করা হয়। বৃষ্টির দিনে সবাই মিলে একসঙ্গে খিচুড়িও খাওয়া হয়। বাচ্চাদের নিয়ে গল্প হয়। ভালোই চলছিল। একটা অফিস ট্যুরে আরও অনেকের সঙ্গে ওরা দুজনও যায়। রাতে কেউ ক্লাবে কেউ বা বিচে। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে কথা চলছিল। স্কুল, কলেজ, বেড়ে ওঠা আরও কত কি! 

প্রথম সন্তান হার্টবিট মিস করে ৬ সপ্তাহেই পেটের মধ্যে মরে যায়। সেটা বলতে গিয়ে মেয়েটা ডুকরে কেঁদে ওঠে। কাঁধে সান্ত্বনার হাত। হঠাৎই একটু বেশিই কাছে চলে আসা। ট্যুর শেষ করে আবার অফিস শুরু। সেই রাতের অসতর্ক মুহূর্তগুলোকে নিছকই দুর্ঘটনা বলে মেয়েটা মাথা থেকে সরাতে চেষ্টা করে। কিন্তু ছেলেটা নাছোড়বান্দা। সম্পর্কটা কনটিনিউ করতে চায়। মেয়েটা রাজি না হওয়ায় অফিসে বাড়তে থাকে কানাঘুষা। দুর্বিসহ হয়ে ওঠে মেয়েটার জীবন।

চারুকলা থেকে পাশ করে অনেক স্বপ্ন নিয়ে মেয়েটা একটা ফ্যাশন হাউজ শুরু করে। একটা এক্সিবিশনে জনৈক ফ্যাশন আইকন ওর কাজের ভূয়সী প্রশংসা করে। মেয়েটা খুশিতে কেঁদে ফেলে। যাকে দেখে, যার কাজ দেখে অপার মুগ্ধতা ওর। যে ওর কাছে দূর আকাশের তারা। সেই স্যার ওর কাজ হাতে নিয়ে দেখলেন, প্রশংসার জোয়ারে ভাসালেন! নিজের চোখ কানকে এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না ওর। এরপর বিভিন্ন প্রোগ্রাম, সোশ্যাল গেদারিং- এ প্রায়ই দেখা হতে থাকে। সালাম আর কুশল বিনিময়ের বাইরেও টুকটাক কথাবার্তা হতে থাকে।

এক দুপুরে একটা কল আসে মেয়েটার ফোনে। বিজি তুমি? দেখা করতে পারবে আমার সাথে? এ্যাড্রেস টেক্সট করছি, চলে এসো। ফোন হাতে নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকে মেয়েটা। ওর স্যার ওকে নিজে ফোন করে ডেকেছে, সত্যি তো! মেয়েটা সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে হাজির হয় নির্দিষ্ট ঠিকানায়। মেয়েটা তখনও জানে না ওর জন্য আরও কত বিস্ময় অপেক্ষা করছিল! ওর চেয়ারের সামনে এসে দাঁড়ায় স্যার। চেয়ারটা ঘুরিয়ে দেয়। আমার একটা ছেলে আছে আর আমার বয়সটাকে কি কনসিডার করতে পারবে? মেয়েটার মাথার উপর দিয়ে যায় কথাটা, ও স্যারের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

হাত ধরে চেয়ার থেকে দাঁড় করিয়ে স্যার বলেন - আমাকে বিয়ে করবে? কনকনে শীতেও মেয়েটা ঘামতে থাকে। এখনই কিছু বলতে হবে না। বাসায় যাও। আমি অপেক্ষা করব। তুমি ভেবে জানিয়ো আমাকে।

শুরু হয় মেয়েটার নিজের সঙ্গে যুদ্ধ। স্যারকে তো আইডল মানি। দুইজনের বয়স এবং অবস্থানের গ্যাপ। স্যারের সঙ্গে প্রেম বিয়ে কিভাবে সম্ভব! সময় বয়ে যায়। স্যার প্রতিদিনই নিয়ম করে ফোন দিতে থাকেন। মেয়েটার বাবা মা কেউ ছিলেন না। স্যারের ফাদারলি কেয়ারে মেয়েটা একপর্যায়ে সাড়া না দিয়ে পারে না। শুরু হয় বাঁধভাঙা প্রেম। স্যার বাসায় একাই থাকেন। স্যার সেলিব্রেটি, বাইরে দেখা করলে লোক জানাজানি হবে। তাই স্যারের বাসাতেই দেখা হত ওদের। প্রথম কিছুদিন ঘোরের মধ্যে কাটতে থাকে। ঘোর কাটতে খুব বেশি দিন সময় নেয় না। মেয়েটাকে প্রতিদিন তার বাসায় যেতে বাধ্য করতো স্যার। ছোটখাট বিষয় নিয়ে চিল্লাপাল্লা, ঝগড়া। মেয়েটা হাপিয়ে ওঠে। সম্পর্কটা থেকে বেরিয়ে যায়।

বছর তিনেক পরে একটু স্থির হয়ে পুরোনো বন্ধুকে বিয়ে করে। শুরু হয় স্যারের ব্ল্যাকমেইলিং। মেয়েটা এখন প্রায়ই সুইসাইডের কথা ভাবে।

উপরের এই ঘটনাগুলো আমাদের বর্তমান সময়ের হালচিত্র। দুইটা প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের পারস্পরিক সম্মতিতে ঘটে যাওয়া ঘটনাকে পরবর্তীতে ইস্যু করা কোনওভাবেই কাম্য নয়। কারো ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ভঙ্গ করার অধিকার আপনার নেই। আগে সম্পর্ককে সম্মান করতে শেখেন। আজকের ভালো সম্পর্ক কাল বিষিয়ে যেতেই পারে। তাই বলে অতীত হয়ে গেলেই সম্পর্ককে অসম্মান করতে হবে! এটাও এক ধরনের বিকার!

লেখক: সম্পাদক, বিবার্তা২৪.কম

বিডি প্রতিদিন/কালাম

সর্বশেষ খবর