ছোট্ট আবির কান্না করতে করতে হয়রান। কারণ, সে বৈশাখী মেলায় যাবেই যাবে। আচ্ছা যাবেই বা না কেন? শুনি এই মেলা তো আর বহুদূরে নয়! পা ফেললেই ঘরের দুয়ারে জমেছে মেলা। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে সে এ মেলা দেখে দেখে বড় হয়। মেলার বাঁশির সুরে ঘুম ভাঙে আবিরের। এ যেন ছোট-বড় সবার ঘুম তাড়ানোর মেলা। আবির চোখ কচলাতে কচলাতে বারান্দায় দাঁড়ায়। সেখানে বাঁশির সুরের সঙ্গে যুক্ত হয় আরও নানান সুর। টমটমের কড়মড় শব্দ। ডুগডুগির আওয়াজ। বেলুন দেখে বেলুনওয়ালাকে বলে, ও বেলুনওয়ালা একটা বেলুন দাও না! বেলুনওয়ালা বলে, বাসায় গিয়ে মাকে বলো টাকা দিতে-এক হালি বেলুন তোমার হবে বাবু সোনা।
আচ্ছা এই মেলা কি ঘর থেকে দেখে মন ভরে? আবির তখন কেঁদে কেঁদে কান্নায় লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। বাবা বিরক্ত হলে দাদি বাবাকে দেয় বকুনি। বলে বিরক্ত হচ্ছিস কেন? এই মেলা কি দেখতে তোরাও কি কম জ্বালাতন করেছিস? ঘরের দুয়ারে মেলা রোজ নিয়ে যাবি তাকে। এই মেলা আর বলীখেলা দেখতে দূরদূরান্ত থেকে সবাই ছুটে আসে। এমনকি বিদেশ থেকেও আসে। এই মেলার সুনাম এখন পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে গেছে। তোদের বাপ-দাদাদের গর্ব এই মেলা। কী আর করা মায়ের বকুনি খেয়ে আবিরকে কাঁধে চড়িয়ে মেলায় রওনা দিলেন আবিরের বাবা। আবির মেলা দেখে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে। রাস্তার দুই পাশে হরেক রকম দোকান সাজানো। সেখানে আছে নানান রকম খেলনা, ঘর সাজানোর মাটির জিনিস, হরেক রকম খাবার মন্ডা-মিঠাই, আন্ডা, মিঠাই শরবত আরও কত কী! অনেকে বসে থাকে এই মেলা কবে শুরু হবে আর কবে ঘরের দরকারি জিনিসপত্তর কিনবে। এই মেলায় এমন এমন জিনিসপত্তর আর খেলনা পাওয়া যায়, যা অনেক জায়গায় পাওয়া যায় না। তাই এই মেলার গুরুত্ব বেশি চট্টগ্রামের আর বাইরের মানুষের কাছে।
প্রতি বছর হয় চট্টগ্রামে এই বৈশাখী মেলা আর বলীখেলা। যদিও মেলা চলে চার দিন ইংরেজি ২৩ থেকে ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত।
কিন্তু তার আগেই দূরদূরান্ত থেকে দোকানদাররা দুই পাশে দোকান সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। আর বলীখেলা হয় ১২ বৈশাখে। আবির মেলা যতই দেখে ততই আনন্দ পায়। শুধু কি মেলা দেখলে হবে? নাগরদোলা না চড়লে কি হয়? তাই তারা জেলখানা ফেলে সামনে লালদীঘিতে এগোল। বিশাল একটা মাঠ। এই মাঠ হলো চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক লালদীঘির ময়দান নামে খ্যাত। এই মাঠ অনেক সাজানো গোছানো। এই মাঠেই হবে ঐতিহ্যবাহী আবদুল জব্বারের বলীখেলা। এই খেলা নিয়েই কথা বলেছিলেন আবিরের দাদি। এই খেলায় দুজন মল্লযুদ্ধ করবে অর্থাৎ কুস্তি লড়বে। এই লড়াইয়ে যে জিতবে সে পাবে পুরস্কার।
বাবা বলেন, জানো আবির সোনা- এই খেলা আয়োজন করেছিল তোমাদের বড় দাদু জমিদার আবদুল জব্বার সওদাগর (১৯০৯ ইংরেজি) ১২ বৈশাখ। ব্রিটিশ আমলে ইংরেজদের প্রতিহত করতে এবং বাঙালিদের শক্তি প্রদর্শনের জন্য তিনি এই খেলা চালু করেছিলেন। অর্থাৎ তার লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে দেশের তরুণ, যুবসমাজকে একত্রে সংগঠিত করা, প্রেরণা দেওয়া, সাহসী ও সংগ্রামী করে গড়ে তোলা। আর তোমার সেই দাদুর নাম আবদুল জব্বার। তাই তাঁর নামেই এ খেলার নামকরণ করা হয়।
আবদুল জব্বারের বলীখেলা নামেই এখন বিশ্বে পরিচিত। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, এই মেলার আশপাশে যত ঘরবাড়ি আছে তাদের সব আত্মীয়স্বজন বিশেষ করে বাড়ির বিবাহিত মেয়েরা নাইওর আসে মানে বেড়াতে আসে।
আবির সারা মেলা ঘুরে ঘুরে খেলনা কিনল। মন্ডা-মিঠাই কিনল। নাগরদোলায় চড়ল। বলীখেলা দেখল। গল্প শুনল। খুব হেসে হেসে আনন্দে আবার বাবার কাঁধে চড়ে বাসায় ফিরে এলো।