শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

প্রতিযোগিতায় কে এগিয়ে জনসংখ্যা না দুর্নীতি?

লে. জে. মাহবুবুর রহমান (অব.)

প্রতিযোগিতায় কে এগিয়ে জনসংখ্যা না দুর্নীতি?

কি ভয়ঙ্কর একটা তাজা শক্তিশালী বোমা আমার ঘরের দোরগোড়ায়। বোমাটি ঠায় পড়ে আছে নিশ্চল। আমি এতটুকুও আতঙ্কিত হচ্ছি না। ওটা চুপচাপ স্থির পড়ে আছে। ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করে বেজে চলেছে। সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। বোমাটি প্রতি ক্ষণে প্রতি মুহূর্তে শক্তিশালী থেকে আরও শক্তিশালী হচ্ছে। হয়েই চলেছে। ওটা যে কোনো মুহূর্তে গোটা বিশ্ব কাঁপিয়ে ফেটে পড়তে পারে। মহাসর্বনাশ ডেকে আনতে পারে। মৃত্যুর ধ্বংসলীলা রচনা করতে পারে। বিরাট ক্ষতিসাধন করতে পারে রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার। আমি বাংলাদেশের বিস্ফোরণোন্মুখ জনসংখ্যার মারাত্মক অবস্থানের কথাই বলছি। সীমিত ৫৬ হাজার বর্গমাইলের আমার এই দেশ জনসংখ্যা হাজারে নয় অযুতে নয় লক্ষেও নয় কোটি কোটিতে। ধরাছোঁয়ার বাইরে এ সংখ্যা। অনেকের আশঙ্কা, ইতিমধ্যে ২০ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। জনগণও আতঙ্কিত মনে হয় না।

দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঘটে চলেছে। এটাকে অনুপ্রবেশ বলা ভুল হবে, এটা বিশাল এক হিউম্যান মাইগ্রেশন। লাখ লাখ মানুষ বন্যার স্রোতধারার মতো বাংলাদেশে ধেয়ে আসছে। বিরামহীন শ্রান্তিহীন। সীমিত আয়তনের সীমিত সম্পদের বাংলাদেশের এ এক বিশাল চাপ। এত মানুষের অন্ন বস্ত্র বাসস্থান স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার বিষয়টি চাট্টিখানি কথা নয়। অনেক সম্পদশালী বড় দেশও এ চাপে হাঁপিয়ে উঠত। ভারত, চীন কেউ তো এগিয়ে আসেনি। মিয়ানমার তার ১০ লক্ষাধিক নাগরিককে অমানবিকভাবে নির্যাতন করে বাংলাদেশে বিতাড়ন করেছে। এখনো করেই চলেছে। সরকার দুর্বল। প্রতিবাদের ভাষা আরও দুর্বল। বিশ্ব উদাসীন। কারও কোনো মাথাব্যথা নেই। আশপাশের দেশ যেমন ভারত ও চীন সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত।

সরকারের উচিত ছিল এত বড় একটা জনসংখ্যার অতিরিক্ত অযাচিত অন্যায় চাপের বিষয়টি বিশ্বদরবারে নিয়ে যাওয়া। জাতিসংঘের করিডোরকে অশান্ত করা, কম্পিত করা। না, সরকার উদার নীতি গ্রহণ করেছে। দুই হাত বাড়িয়ে আহ্বান জানিয়েছে, বুকে জড়িয়ে ধরেছে। নিজের যা কিছু আছে তাই এগিয়ে দিয়েছে। বিশ্ব সাধুবাদ জানিয়েছে। ধন্য ধন্য করেছে, সরকার কৃতার্থ হয়েছে।

আসামে বাঙালি খেদাও অভিযান চলছে। ১৯ লাখ আসামবাসীকে বিতাড়ন করছে। পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়েছে। বাংলা ভাষাভাষী পশ্চিম বাংলা সরকার বলছে তারা পশ্চিম বাংলার নাগরিক নয়। তারা বাংলাভাষী বাংলাদেশের নাগরিক। আসাম ও বাংলাদেশ পাশাপাশি দেশ। এক ভাষায়ই কথা বলে। তা দিয়ে প্রমাণিত হয় না আসামিরা বাঙালি। আসামিরা আসামিই। কখনো বাঙালি নয়। ব্রিটিশরা ইংরেজিতে কথা বলে আমেরিকানরাও ইংরেজিতে কথা বলে তেমনি ইংরেজিতে কথা বলে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, কানাডার অধিবাসীরাও কিন্তু ভাষার কমনালিটি তাদের এক জাতি এক রাষ্ট্র করে দেয়নি। তারা আপন আপন রাষ্ট্র পরিচয়ে ধন্য এবং গর্বিত। গত ১৫ আগস্ট ছিল বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস। জাতিসংঘ ঘোষিত এ দিনটি নিয়ে বিশ্বজুড়ে অনেক কর্মকান্ডে গণমানুষের সচেতনতা বৃদ্ধিতে অনেক বড় ভূমিকা পালন করেছে। আমাদের ছোট্ট এই পৃথিবী অগণিত মানুষের নিম্নচাপ আর নিতে পারছে না। ধরিত্রী পিষ্ট হচ্ছে। চাপে চাপে সংকুচিত হচ্ছে। আর বাংলাদেশ সে তো বহু আগেই দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম। প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় দেড় হাজার। এত জনসংখ্যার ঘনত্ব বিশ্বের আর কোনো দেশে নেই। চীন, ভারত হলো জনসংখ্যার দেশ। চীনের জনসংখ্যা ১৪১ কোটি। ভারতের ১৩৪ কোটি। কিন্তু দুটিই বিশাল দেশ আয়তনে ও সম্পদে। চীন পৃথিবীর সবচেয়ে সম্পদশালী ও অর্থনৈতিকভাবে উন্নত। ভারতও সম্পদশালী। তাই জনসংখ্যা তাদের এখনো বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে ওঠেনি।

কিছুদিন আগে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমিতির উদ্যোগে ঢাকায় ‘বাংলাদেশ আয় ও ধন বৈষম্য’ শীর্ষক এক জাতীয় সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। এই সেমিনারে বাংলাদেশের শীর্ষ অর্থনীতিবিদরা দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ওপর বিস্তারিত আলোচনা করেন (যুগান্তর, ০৮-০৯-২০১৯)। এই সেমিনারে বক্তারা যে আলোচনা করেন তার সারমর্ম হলো- ‘ব্যাংক ঋণ লুটপাট বিত্তবান হওয়ার লোভনীয় ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। প্রতি বছর ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা লুট হয়ে যাচ্ছে। লুট হওয়া অর্থের সিংহভাগই পাচার হচ্ছে বিদেশে। বিভিন্ন চ্যানেলে টাকা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। সব মিলে বছরে ৭৫ হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে। ব্যাংক লুটের বড় একটি অংশ মানি লন্ডারিং প্রক্রিয়ায় দেশের অর্থনীতিতে ফিরে আসছে। এসব কারণে দেশের আয় ও ধন বৈষম্য বেড়ে বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।’

সেমিনারের মূল প্রবন্ধকার অধ্যাপক মইনুল ইসলামের প্রবন্ধ থেকে এখানে কিছুটা উদ্ধৃত করছি। তিনি বলেছেন, ‘কয়েক হাজার ধনাঢ্য রাজনীতিক ও ব্যবসায়ী একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ আরোপের কারণে ব্যাংকিং খাত পুঁজি লুটপাটের আকর্ষণীয় ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। সবচেয়ে ন্যক্কারজনক ঘটনা হচ্ছে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা ফেরত না দেওয়া। রাঘববোয়াল ঋণখেলাপিদের সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের যোগসাজশ রয়েছে। ফলে অধিকাংশই ঋণ ফেরত দিচ্ছে না। ঋণ ফেরত না দেওয়ার বিষয়টি এখন ক্রমে দুরারোগ্য ক্যান্সারে পরিণত হতে যাচ্ছে। ফরাসউদ্দিন কমিটির প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ অর্থ যেভাবে চুরি হয়েছে তার দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে নেই। আর তা হয়েছে অবহেলা আর অদক্ষতার কারণে। বিশ্বে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এত বড় চুরির ঘটনা কখনো ঘটেনি। বাংলাদেশে ধনাঢ্য ব্যক্তির প্রবৃদ্ধি হার বিশ্বে সবচেয়ে বেশি। ২০১২-১৭ সাল পর্যন্ত এ দেশে ধনাঢ্য ব্যক্তির বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ছিল ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ। দেশের সম্পদের বড় একটি অংশ তাদের হাতে চলে যাওয়ায় ধনবৈষম্য অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। ধনাঢ্য ব্যক্তি সাজতে গিয়ে অনেকেই দুর্নীতিতে ডুবে যাচ্ছেন। অনেক সরকারি-আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, আধাস্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছে। দুর্নীতির মাধ্যমে আয় করা অর্থ দুর্নীতিবাজদের পরিবারের সদস্যদের অতিদ্রুত মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের অবস্থানে নিয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া দেশ থেকে পুঁজি পাচারকারী ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের অধিকাংশই গার্মেন্ট মালিক। কিন্তু এ খাতের ৩৫ লাখ শ্রমিক আগের মতোই দরিদ্র রয়ে গেছে। এ ছাড়া মালয়েশিয়া সেকেন্ড হোমের মালিক ও টরেন্টোর বেগমপাড়ায় বাড়ির মালিকদের মধ্যেও দুর্নীতিবাজ ইঞ্জিনিয়ার, সিভিল আমলা ও রাজনীতিবিদ আছেন।

বাংলাদেশের অর্থনীতির এমন কোনো ক্ষেত্র আজ নেই যেখানে লুটপাটের রাজত্ব কায়েম হয়নি। এটা ঘটেছে দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তারের মাধ্যমে। বাংলাদেশে এই দুর্নীতির অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, এটা শুধু শীর্ষ ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এটা ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র, মহামারীর মতো। এর ফলে অর্থনীতির একেবারে নিচের স্তর পর্যন্ত দুর্নীতিতে আচ্ছন্ন হয়েছে।

দুর্নীতি এক মারাত্মক সংক্রামক ব্যাধি। এটা রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে শক্তিশালী হলে অর্থনীতি ও সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রই নিদারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কোনো ক্ষেত্রই এর সংক্রমণ থেকে রক্ষা পায় না। এর সর্বশেষ উদাহরণ হলো ৯ সেপ্টেম্বর ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবির এক রিপোর্ট। এতে বলা হয়েছে, ‘ঢাকার আশপাশের থানাগুলোতে সাবরেজিস্ট্রারদের বদলির ক্ষেত্রে ঘুষের অঙ্ক ৫০ লাখ টাকা ছাড়িয়ে যায়। ভূমির দলিল নিবন্ধনে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়মবহির্ভূত অর্থ (ঘুষ) লেনদেন করতে হয়। ভূমি অফিসে নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি ও লাইসেন্সপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে বড় ধরনের আর্থিক লেনদেন হয়। দলিল লেখকদের লাইসেন্সপ্রাপ্তিতে ৩ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়। নকলনবিস থেকে মোহরার পদে যোগদানে ৮ লাখ, মোহরার থেকে সহকারী পদে যেতে ১০ লাখ টাকা ব্যয় করতে হয়।’ (যুগান্তর ১০-০৯-২০১৯)। এ রিপোর্টে বিস্তারিতভাবে আরও অনেক কিছু বলা হয়েছে, যার বিবরণ দেওয়া এখানে সম্ভব নয়। এতে বলা হয়েছে, ‘ঘুষ ও দুর্নীতিতে জড়িত সরকারি কর্মকর্তাদের ব্যাপারে গোপনে অনুসন্ধান, তাদের গতিবিধি ও অবস্থান শনাক্তে মোবাইল ট্র্যাকিং শুরু করেছে দুদক।’ বাংলাদেশে ব্যাপক দুর্নীতির বিরুদ্ধে এ ধরনের পদক্ষেপের কথা দুদকের থেকে এই প্রথম বলা হচ্ছে না, বহুবার এ ধরনের কথা তারা বলেছেন। কিন্তু তাদের দ্বারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রকৃতপক্ষে কিছুই করা সম্ভব হয়নি। এর মূল কারণ সব দুর্নীতিই হচ্ছে ক্ষমতাধরদের দ্বারা অথবা তাদের পৃষ্ঠপোষকতায়। দুর্নীতি দমনে যাদের নিয়ামক ভূমিকা থাকা প্রয়োজন, তারাই যখন দুর্নীতির মধ্যে ডুবে আছে এবং দুর্নীতির পৃষ্ঠপোষকতা করছে প্রত্যেক ক্ষেত্রে ও ব্যাপকভাবে, তখন দুদকের মতো প্রতিষ্ঠানের করার যে কিছুই থাকে না তা বুঝিয়ে বলার দরকার হয় না।

              লেখক : সাবেক সেনাপ্রধান।

 

 

সর্বশেষ খবর