বৃদ্ধাশ্রম শব্দটি আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষের কাছেই আতঙ্কের। একটা সময় আমারও চিন্তাধারা তেমনি ছিল। আজ বয়সের সঙ্গে সঙ্গে আমিও ভাবতে বসেছি বৃদ্ধাশ্রম সম্বন্ধে। আমার একাকিত্বের অবসরে বৃদ্ধাশ্রম এসে আমার মনকে নাড়া দেয়। আমি কখনো ইমোশনাল ছিলাম না, বরাবরই যা করেছি ভেবেচিন্তেই করেছি, কখনো হেরেছি কখনো জিতেছি। তবে কখনো হেরে গিয়ে আফসোস করিনি, কারণ এগুলো সবই জীবনের এক একটা অংশ বলে ধরে নিয়েছি। আমার অনেক দিনের ইচ্ছা বৃদ্ধাশ্রম নিয়ে কিছু করার, আর সেই লালিত ইচ্ছাই আজ আমাকে বৃদ্ধাশ্রম নিয়ে লেখার উৎসাহ জোগাচ্ছে।
আমাদের দেশে বৃদ্ধাশ্রম অনেকের কাছে একটি আতঙ্ক, যেমন বৃদ্ধ-বৃদ্ধার কাছে তেমনি আবার বাবা-মা ভক্ত সন্তানের কাছে। তবে আমার মতো অনেকেই আছেন যারা সমর্থন করেন বৃদ্ধাশ্রমকে। অবশ্য আমার মতের সঙ্গে অনেকের মতের মিল হবে না। আমরা সবাই জানি, বাস্তব বড় কঠিন। আমরা যা এত দিন চিন্তা করে এসেছি বাস্তবে দেখা যায় তা সম্পূর্ণ অন্যরকম। বাবা-মা যেমন সন্তানদের সবচেয়ে বড় আশ্রয় ঠিক তেমনি একটা সময়ে অর্থাৎ বৃদ্ধ বয়সে সন্তানরাও বাবা-মার সবচেয়ে বড় নির্ভরতা। কিন্তু সত্যি বলতে কী খুব কম বাবা-মারই সৌভাগ্য হয় সন্তানদের আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকার। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় অনেক বাবা-মা সন্তানদের সঙ্গে থাকলেও সে থাকাটা পুরোনো আসবাবের মতো এক কোণে পড়ে থাকা। ছেলের সময়ও হয় না তাদের খোঁজখবর নেওয়ার। আমরা বাঙালিরা বেশির ভাগ বাবা-মাই দোষ দিই বউয়ের কিন্তু না সেটা আমাদের ভুল ধারণা। কারণ আমার মতে, আমাদের ছেলেরা যদি আমাদের সম্মান দেয়, ভালোবাসে তবে বউ তো দূরের কথা কোনো তৃতীয় ব্যক্তিরও সাহস হবে না আমাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করার।
যাক যা বলছিলাম, যেসব বাবা-মায়ের সন্তানদের আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকার সৌভাগ্য হয় না, তাদের বেশির ভাগই আশ্রয় পায় বৃদ্ধাশ্রমে। এ ক্ষেত্রে বৃদ্ধাশ্রমই হয়ে যায় অনেক বাবা-মার শেষ ঠিকানা। আবার এমনও দেখা গেছে, বেশি ভাইবোন হওয়াতে বাবা-মাকে রাখার সমস্যা হয়। ভাইবোন তখন ভাগাভাগি করে নেয় কখন কার কাছে কত দিন বাবা-মাকে রাখবে। শেষে হয়তো দেখা যায় ভাইবোন তিন মাস বা এক মাস অন্তর অন্তর ভাগাভাগি করে নিজেদের কাছে বাবা-মাকে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু তারা কেউ একবারও ভাবে না যে তাদের বাবা-মা এই শেষ বয়সে এসে একজনকে ছেড়ে অন্যজন কীভাবে থাকবে, একবারও ভাবে না এই বয়সে তাদের একা করে দেওয়ার পরিণতির কথা, তাদের একবারও মনে পড়ে না যে মা-বাবা সন্তানদের নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসে অনেক কষ্টে লালনপালন করেন। কিন্তু আমরা কজন সন্তান সেটা মনে রেখেছি। তাদের কি একবারও মনে পড়ে না, এই বাবা-মাই একদিন তাদের অনেক আদরে বুক দিয়ে আগলে রেখেছিলেন। আর আজ তারাই কত অসহায়, ছেলের সংসারে তাদের ঠাঁই হয় না, যদিও বা হয় তা-ও অনেক নিয়মকানুন মেনে।
দেশের বাইরে বৃদ্ধাশ্রম আছে, কিন্তু তাদের দেশের নিয়মকানুন উন্নত, তাদের সন্তানরা ব্যয়ভার বহন করেন। ছুটির দিনে তাদের বাইরে বেড়াতে যাওয়ার জন্য লোক আছে, তারাই তাদের বেড়াতে নিয়ে যায়। খাবারদাবার সঙ্গে নিয়ে পিকনিকের মতো বেড়িয়ে আসেন, এতে তাদের মনমানসিকতাও ভালো থাকে। তাদের সময়ও কাটে আর আমাদের এখানে দুই-একটা বৃদ্ধাশ্রম যাও আছে অত্যন্ত কষ্টে তারা সেখানে মানবেতর জীবনযাপন করে। এই বিষয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে এবং অনেকেই অবগত আছেন। সরকারি বৃদ্ধাশ্রমের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম। তা ছাড়া সরকার কদিকে খেয়াল রাখবে। বৃদ্ধাশ্রমের কিছু নিয়মকানুন যা ওখানে বসবাসরতদের কষ্ট দেয়, যা দূর করার জন্যই আজকের এই লেখা। আমাদের সময় ছিল এক রকম আর বর্তমান যুগের সময় অন্য রকম। এখানে ব্যস্ততার কারণে বাবা-মাকে কেন, আমাদের সন্তানরা তাদের সন্তানদেরও সময় দিতে পারে না।
বৃদ্ধাশ্রম শুধু অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জন্য নয়, বৃদ্ধাশ্রম হবে বন্ধুত্বপূর্ণ এবং সহানুভূতিশীল একটি প্রতিষ্ঠান, যেখানে সবাই একই পরিবারের সদস্য হিসেবে বসবাস করবেন। যেসব সন্তান বাবা-মাকে সময় দিতে পারে না সেসব সন্তান যেন তাদের বাবা-মাকে একটা সুন্দর পরিবেশের প্রতিষ্ঠানে রাখেন। তবে এখানেও কথা আছে শুধু রেখে গেলেই হবে না কিছু নিয়মের মধ্যে তাদের রাখতে হবে। যেমন কোনো পারিবারিক অনুষ্ঠানে তারা তাদের বাবা-মাকে বাসায় নিয়ে দুই দিনের জন্য রাখবেন, কোনো বিয়ে, জন্মদিন বা তদ্রুপ অন্য যে কোনো অনুষ্ঠানে যাওয়ার সময় মা-বাবাকে সঙ্গে নিয়ে যাবেন। ছুটির দিন কোনো সময় তারা বাবা-মাকে দেখতে আসবেন অথবা কোনো ছুটির দিন বাবা-মাকে নিয়ে যাবেন বাসায়। তাহলে আমার বিশ্বাস উভয়েই ভালো থাকবেন। সত্যি বলতে কী বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের সময় দেওয়ার মতো সময় যেমন আজকের যুগের ছেলেমেয়েদের নেই ঠিক তেমনই বয়স্ক মানুষও কারও সঙ্গ ছাড়া একা থাকতে পারেন না। সে ক্ষেত্রে এমন একটি প্রতিষ্ঠানে থাকলে তারাও ভালো থাকবেন। তাদেরও ভালো সময় কাটবে যদি প্রতিষ্ঠানটা সুন্দর নিয়মে চালানো যায়।
লেখক : সহসভাপতি প্রবীণ হিতৈষী সংঘ ও জরাবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান, সিলেট