শনিবার, ৩১ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

হৃষিকেশ দাস রোড জুড়ে এখনো ইউরোপীয় স্থাপত্যশৈলীর ছাপ

পুরান ঢাকার ঐতিহ্য-৮

মাহবুব মমতাজী

হৃষিকেশ দাস রোড জুড়ে এখনো ইউরোপীয় স্থাপত্যশৈলীর ছাপ

পুরান ঢাকার হৃষিকেশ দাস রোডের পরতে পরতে এখনো স্পষ্ট ইতিহাসের ঐতিহ্য। এই রোডে আছে পুরাকীর্তির দাবিদার অনেকগুলো ভবন। এগুলো ব্রিটিশ আমলে লাল ইট দিয়ে তৈরি। যাতে ইউরোপীয় স্থাপত্যশৈলীর ছাপ রয়েছে। কয়েক বছর আগে নগরবিদ ও এলাকার মানুষের বাধার মুখে প্রশাসন এখানকার বাড়ি ভাঙা বন্ধ করে দিয়েছে। এখন পর্যন্ত ওই রোডে প্রায় ৩৩টি ভবন বিদ্যমান রয়েছে। জানা গেছে, ১৯২০ সালে ঢাকার জমিদার হৃষিকেশ দাস নির্মাণ করেছিলেন চোখ জুড়ানো রোজ গার্ডেন। আর হৃষিকেশ দাস লেন নামে পরিচিত সড়কটিতে ব্রিটিশ আমলের স্থাপনাগুলোয় আছে অর্ধবৃত্তাকার খিলান, অলঙ্কৃত ডেন্টিলসহ কার্নিশ ও অলঙ্করণ করা ছাদে রেলিং। ওই সময় নির্মিত অসংখ্য ভবনের মধ্যে ইউরোপীয় ধ্রুপদী স্টাইলে আয়নিক বা কোরিন্থিয়ান অর্ডারসমৃদ্ধ অলঙ্করণ দেখা যায়। বাড়তি অনুষঙ্গ হিসেবে এসেছে নানা ধাঁচের ব্যালকনি। কোথাও কোথাও মোঘল স্থাপনাগুলোর আংশিক পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের মাধ্যমে এর স্থাপত্যরীতির ওপর ইউরোপীয় স্থাপত্যশৈলীর ছাপ দেখা যায়। যে কারণে ঢাকায় লাল ইটের ব্রিটিশ স্থাপত্যরীতির নিদর্শনগুলোর গুরুত্ব অনেক বেশি। প্রবীণ স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, এখানে মুড়াপাড়া জমিদার পরিবারেরও একটি বাড়ি আছে।

সরেজমিন দেখা গেছে, অসংখ্য ঐতিহাসিক ভবন রয়েছে এখানে। মোগল-ব্রিটিশ শিল্পশৈলীর আদলে স্থাপনাগুলো নির্মিত। চারশ বছরের পুরনো একটি নগরীর বৈশিষ্ট্য এসব ভবন। রাস্তার দুই পাশের এসব ভবনের দিকে তাকালে ঢাকার ঐতিহাসিকতা ফুটে ওঠে। কিন্তু ঐতিহাসিক ভবনগুলোর অনেকগুলো আবার আজ আর নেই।

ঢাকার ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছেন স্থপতি এবং আরবান স্টাডি গ্রুপের প্রধান নির্বাহী তাইমুর ইসলাম। তিনি জানান, লাল ইটের এই ভবনগুলো বহন করছে আমাদের হারানো ঐতিহ্য। এর পরতে পরতে লুকিয়ে আছে অতীত ইতিহাসের নানা উপাদান। লাল ইটের ভবন ছাড়াও ব্রিটিশ আমলে নির্মাণ করা সাদা ও হলুদ রঙের সরকারি-বেসরকারি অনেক স্থাপনা রয়েছে ঢাকায়। ব্রিটিশ আমলে নির্মাণ করা এসব স্থাপত্যশৈলীর সঙ্গে ঢাকা নগরীর ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-উপাত্ত জড়িয়ে আছে। এসব না ভেবেই  নির্বিচারে ভাঙা হচ্ছে লাল ইটের ঐতিহাসিক ভবন। গত তিন-চার মাসে ঐতিহাসিক স্থাপনা রক্ষায় ছয়টি রিট করা হয়েছে। প্রতিটি রিটেই পুরনো এই স্থাপনাগুলো রক্ষার পক্ষে রায় এসেছে। তারপরও আদালতের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে কেউ কেউ এসব স্থাপনা ভাঙছেন। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে এর অধিকাংশই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। জানা গেছে, বঙ্গভঙ্গের পর ১৯০৬ সাল থেকে ঢাকায় নতুন শহরের পত্তন ঘটে। রমনার বিস্তীর্ণ এলাকায় প্রশাসনিক এলাকা গড়ে তোলা হয়। যা সিভিল স্টেশন নামে পরিচিতি অর্জন করে। তখন সেখানে লাল ইটের বাংলো টাইপের বেশ কিছু ভবন নির্মাণ করা হয়। এর মধ্যে পুরনো হাইকোর্ট ভবন, বড় লাটের বাসভবন, রমনা হাউস, চামেলী হাউস, বর্ধমান হাউস অন্যতম। মিন্টো রোডের আবাসিক এলাকার ভবনগুলো ছিল লাল ইটের। এগুলো ছাড়া আরও অনেক লাল ইটের ভবন ছিল রমনা প্রশাসনিক এলাকায়। এর মধ্যে বেশ কিছু ভবন ভেঙে সেখানে সুউচ্চ ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। যেগুলো অবশিষ্ট আছে সেগুলোর রং পরিবর্তন করে ফেলা হয়েছে। এদিকে পুরনো ঢাকার ওয়ারী আবাসিক এলাকার সিংহভাগ লাল ইটের বাংলো টাইপের আবাসিক ভবনগুলো প্রকাশ্যে ধ্বংস করা হয়েছে। একতলা কিংবা দোতলা ব্রিটিশ স্থাপত্যের নিদর্শনগুলো ভেঙে সেখানে ১০-১৫ তলা এমনকি ২০ তলা ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, ওয়ারী, বনগ্রাম, লালমোহন সাহা স্ট্রিট, পাটুয়াটুলী, ফরাশগঞ্জ, সদরঘাট, ইসলামপুর, বাংলাবাজার, সূত্রাপুর ও লক্ষ্মীবাজার এলাকায় এক সময় লাল ইটের অসংখ্য ভবন ছিল। এখন আর এসব ভবনের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না।

সর্বশেষ খবর