১ অক্টোবর, ২০২২ ১২:১৮

একটি পুলিশি হামলা ও রণেশ মৈত্রের ভূমিকা

মোশাররফ হোসেন মুসা

একটি পুলিশি হামলা ও রণেশ মৈত্রের ভূমিকা

রণেশ মৈত্র

মনীষীরা বলেছেন, প্রতিটি মানুষ জীবনে কিছুক্ষণের জন্য হলেও একবার বিখ্যাত হওয়ার সুযোগ পায়। তেমনিভাবে তাকে একবারের জন্য হলেও কঠিনতম বিপদের সম্মুখীন হতে হয়। পাবনার পাকশীর কাছে পদ্মা নদীর ওপর নির্মিত ‘লালন শাহ’ সেতুটি উদ্বোধন করা হয় ১৮ মে, ২০০৪-এ। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার আমলে অর্থাৎ ১৯৯৮ সালে এর নির্মাণকাজ  শুরু হয়। ২০০৪ সালে নির্মাণকাজ শেষ হওয়ায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া সেতুটি উদ্বোধন করেন। সেতুটি দুই মাস আগেই চলাচলের উপযোগী হয়ে গেলেও প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করবেন এ রকম সিদ্ধান্ত থাকায় উদ্বোধনের তারিখ দুবার পরিবর্তন করা হয়। 

উল্লেখ্য, চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি ব্রিজ নির্মাণের জন্য প্রায় ১ হাজার চীনা শ্রমিক নিযুক্ত করে। যা হোক, তিনজন চীনা শ্রমিক একটি চায়ের দোকানে উপস্থিত হলে দোকানে বসা কয়েকজন সাধারণ মানুষ জানতে চান কবে নাগাদ ব্রিজটি উদ্বোধন হবে। চায়না শ্রমিকরা ‘কিচিরমিচির’ শব্দ করে যেসব কথা বলেন সেগুলো দুর্বোধ্য মনে হলেও ‘বিউটি কুইন’ শব্দটির অর্থ সবাই বুঝতে পারেন। সঙ্গে থাকা বাঙালি ড্রাইভার অনুবাদ করে আমাদের জানান, তাদের দেশে এ-জাতীয় ব্রিজ কাউন্টি মেয়র উদ্বোধন করেন। 

ব্রিজটি দুই মাস আগে উদ্বোধন করা হলে প্রায় ২ কোটি টাকা আয় হতো। গরিব দেশের এ-জাতীয় বিলাসিতা ও আলসেমি তাঁদের অবাক করেছে। তাঁরা প্রায় নৃত্যের ভঙ্গিতে বলতে থাকেন, ‘কবে নাগাদ তোমাদের বিউটি কুইন আসবেন, কবেই বা আমরা ছাড়া পাব। এদিকে আলীবাবারা লোহালক্কড়গুলো সব চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে। তোমরা সব আলীবাবা।’ 

তাঁদের কথাগুলো গুছিয়ে আমার বাল্যকালের একটি ঘটনার উল্লেখ করে রম্য রচনা টাইপের একটি ক্ষুদ্র লেখা লিখি। বাড়ির পাশে একজন বিধবা মহিলা একটি টিনের ঘর নির্মাণ করে বসবাস শুরুর আগে মিলাদের আয়োজন করেন। আমরা ছোটরা শিন্নি খাওয়ার লোভে মিলাদে উপস্থিত হই। মিলাদ শেষে মাওলানা সাহেব এক লম্বা মোনাজাত ধরেন। মোনাজাত যেন কিছুতেই শেষ হয় না। তিনি একের পর এক মৃত আত্মীয়স্বজনের রুহের মাগফেরাত কামনা করে চলেছেন। অবশেষে আমি ধৈর্য হারিয়ে বলে উঠি, ‘হুজুর তাড়াতাড়ি করেন, শিন্নি ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।’ 

ক্ষুদ্রাকার লেখাটির শিরোনাম দেওয়া হয় ‘প্রধানমন্ত্রী তাড়াতাড়ি করেন, শিন্নি ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে’। লেখাটির ফটোকপি করে কয়েকটি স্থানীয় ও জাতীয় পত্রিকায় পাঠাই। ১৬ মে, ২০০৪ আমাকে থানায় ডেকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে আপত্তিকর লেখার কারণ দেখিয়ে গ্রেফতার করা হয় এবং নাশকতামূলক কাজে জড়িত আছি কি না জিজ্ঞাসাবাদের নামে প্রহার করা হয়। তা ছাড়া ওই ওসি জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য টেলিফোনে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যকে থানায় আসতে বলেন। ঈশ্বরদী প্রেস ক্লাবের তৎকালীন সভাপতি মোস্তাক আহমেদ কিরণ ঘটনাটি জানতে পেরে রণেশ মৈত্রকে জানান। রণেশদা বুঝতে পারেন আমি একটি গভীর চক্রান্তের জালে আটকা পড়তে যাচ্ছি। তিনি তৎক্ষণাৎ পাবনার পুলিশ সুপারকে টেলিফোনে বলেন, সে কোনো নাশকতামূলক কাজে জড়িত নয়। সে একজন রাজনৈতিক ও সংস্কৃতি কর্মী। রণেশদার টেলিফোনে যে কাজ হচ্ছে তা থানা হাজত থেকে আমি বুঝতে পারি। ওসি প্রথমে ক্রুদ্ধস্বরে গালাগাল করলেও টেলিফোন পেয়ে তার মেজাজ নামতে থাকে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বলতে শুনি, ‘না, তাকে কোনো নির্যাতন করা হয়নি। থানা হাজতে শুধু আটক রাখা হয়েছে।’ 

পরদিন আমাকে ৫৪ ধারায় আটক দেখিয়ে কোর্টে পাঠানো হয়। মামলার প্রাথমিক তথ্য বিবরণী পড়ে জানতে পেরেছিলাম, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও পাবনা পুলিশ সুপারের নির্দেশে আমাকে গ্রেফতার করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর আগমন অনুষ্ঠান কেন্দ্র করে আমি নাকি ব্যঙ্গাত্মক ও কুরুচিপূর্ণ ভাষায় লিফলেট ছাপিয়ে বিতরণ করেছি, আমি নাকি প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠান বানচাল করার জন্য অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার সঙ্গে জড়িত রয়েছি, সেজন্য জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন রয়েছে উল্লেখ করে সাত দিনের রিমান্ড চাওয়া হয়। যথারীতি কোর্টে রিমান্ডের শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। এ উপলক্ষে কোর্টে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা ঘটে। দেখি, রণেশদার নেতৃত্বে প্রায় ২০ জন আইনজীবী রিমান্ড নামঞ্জুরের দাবি জানিয়ে একযোগে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন যুক্তি উত্থাপন করতে থাকেন। তাঁদের যুক্তি একপর্যায়ে হইচইয়ে পরিণত হয়। ম্যাজিস্ট্রেট রিমান্ড আবেদন নামঞ্জুর করে আমাকে জেলহাজতে পাঠান। 

জেলখানা থেকে শুনতে পেলাম, পত্রিকায় আমাকে নিয়ে বহু লেখালেখি শুরু হয়েছে। রণেশদা আমার লেখার বিষয়ে যুগান্তর, জনকণ্ঠ, সংবাদ, করতোয়াসহ বেশ কয়েকটি পত্রিকায় ‘পুলিশ ক্ষমতা দেখাল বটে’, ‘আঁধার ঘরে সাপ-সকল ঘরেই সাপ’ ইত্যাদি শিরোনাম দিয়ে একাধিক কলাম লেখেন। ফলে জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় বিষয়টি উত্থাপিত হয় এবং কল্পিত রাষ্ট্রদ্রোহ মামলাটি প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ২৩ মে, ২০০৪-এ জেলখানা থেকে বেরিয়ে দেখি রণেশদা তাঁর দলবলসহ একগুচ্ছ ফুলের তোড়া নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। প্রথমে তাঁর পা ছুঁয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। রণেশ মৈত্র পাবনায় বসবাস করলেও জাতীয় সমস্যা নিয়ে বেশি লিখতেন। তিনি ছিলেন বর্ণবহুল ও সফল জীবনের অধিকারী। একুশে পদকপ্রাপ্ত মহান হৃদয়ের মানুষটি ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২২ মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে যেন আজীবন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে পারি, সে কামনাই করি।


লেখক: গণতন্ত্রায়ণ ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারবিষয়ক গবেষক 
Email : [email protected]

বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন

সর্বশেষ খবর