১০ জানুয়ারি, ২০২৩ ১৩:৩৮

মুজিবনগর সরকার যুদ্ধজয়ের পর যেভাবে বরণ করেছিল বঙ্গবন্ধুকে

সোহেল সানি

মুজিবনগর সরকার যুদ্ধজয়ের পর যেভাবে বরণ করেছিল বঙ্গবন্ধুকে

মুজিবনগর সরকার যুদ্ধজয়ের পর যেভাবে বরণ করেছিল বঙ্গবন্ধুকে

“রক্ত দিয়েই যদি স্বাধীনতার মূল্য নিরূপণ করা হয় তাহলে, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে এমন স্বাধীনতা অর্জন পৃথিবীর কয়টা দেশ-জাতি পেরেছে,আমার জানা নেই, যার মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমান”।

ব্রিটেনের বিখ্যাত সংবাদপত্র New Statesmen এর সম্পাদক কিংসলি মার্টিন তাঁর স্বনামে প্রকাশিত এক বিশেষ সম্পাদকীয়তে উপর্যুক্ত মন্তব্যটি করেছিলেন। অথচ, তখনো রমনার রেসকোর্স ময়দানে পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণে পূর্বদিগন্তে বিজয়-নিশান উড়িয়ে ‘স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ অভ্যুদয় ঘটেনি। ওই রেসকোর্স ময়দান থেকেই সাত মার্চ বঙ্গবন্ধু মুক্তির ও স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দিয়ে জ্বালাময়ী ভাষণে বলেছিলেন, “আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমাদের যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা কর’’। সেই রেসকোর্স ময়দানেই জেনারেল নিয়াজীর নেতৃত্বে পাকবাহিনীর নব্বই হাজার সৈন্যের আত্মসমর্পণের দৃশ্য মঞ্চস্থ হলো। কিন্তু যৌথবাহিনী কমান্ডার জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার নেতৃত্বে বিজয় হলেও বাঙালির সার্বিক মুক্তি তখনো অপূর্ণ থেকে যায়, জাতির পিতা পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডির কারাগারে বন্দী থাকায়।বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ঘরে-বাইরে তখনো উৎকণ্ঠা আর নানা গুজব।

মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে ছাত্রলীগ ও মুজিব বাহিনীর দ্বন্দ্ব উৎকণ্ঠা ও গুজবকে আরও প্রকট করে তুলছিল। মুজিব বাহিনী রেসকোর্স ময়দানে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে জনসভা করারও ঘোষণা দেয়। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ স্বয়ং বঙ্গবন্ধুর মুক্তির ব্যাপারে আন্তরিক নন- এমন গুজবও রটে যায়। এ পরিস্থিতিতে তাজউদ্দিন ছুটে যান বেগম মুজিবের কাছে - ধানমন্ডির ১৮ নম্বরের বাড়িতে। তিনি বঙ্গবন্ধুর মুক্তির বিষয়ে সরকারের সার্বিক তৎপরতা সম্পর্কে বেগম মুজিবকে অবহিত করেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর  বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য পাকিস্তানের সামরিক জান্তাকে চাপ দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ৬৭টি দেশের সরকার প্রধানকে চিঠি দেন। তৎকালীন জাতিসংঘ মহাসচিব এবং ইউরোপের অধিকাংশ দেশের রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দাবি করেন। কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন। তারা শেখ মুজিবের যদি কিছু হয়ে যায়, তবে ফলাফল ভয়াবহ হবে বলেও হুমকি দেয়। ৮ জানুয়ারি সকাল ৭টায় বিবিসির ওয়ার্ল্ড সার্ভিসে প্রচারিত খবরে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান বিমানযোগে লন্ডনে আসছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই বিমানটি লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে অবতরণ করবে’। অবতরণের পরপরই ব্রিটিশ বৈদেশিক দফতরের কর্মকর্তারা রাষ্ট্রীয় অতিথির মর্যাদা দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানান। ব্রিটিশ সরকারের সম্মানিত অতিথি হিসেবে লন্ডনের ক্ল্যারিজেস হোটেলে নিয়ে আসা হয় তাঁকে। বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতির কথা জেনে হাজার হাজার বাঙালি ‘জয় বাঙলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানে লন্ডনের আকাশ-বাতাস মুখর করে তোলে। দুপুরের দিকে এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘এক মুহূর্তের জন্য আমি বাংলাদেশের কথা ভুলিনি। আমি ধরে নিয়েছিলাম ওরা আমাকে হত্যা করবে। আমি আপনাদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পাবো না। কিন্তু আমার জনগণ মুক্তি অর্জন করবে’।
বঙ্গবন্ধু যখন লন্ডনে পৌঁছান, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী অ্যাডওয়ার্ড হিথ তখন ছিলেন লন্ডনের বাইরে। বঙ্গবন্ধুর পৌঁছানোর কথা শুনে পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি বাতিল করে প্রধানমন্ত্রী হিথ ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে ছুটে আসেন এবং বঙ্গবন্ধুকে নজিরবিহীন সম্মান দেখান। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী তার কার্যালয়ের বাইরে এসে গাড়ির দরজা খুলে ততক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন, যতক্ষণ না বঙ্গবন্ধু গাড়ি থেকে বেরিয়ে না এলেন। ৮ জানুয়ারি রাতে ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে স্বীকৃতির বিষয়টি উত্থাপন করেন।

৯ জানুয়ারি সকালে লন্ডনে বসেই টেলিফোনে ইন্দিরা গান্ধী-বঙ্গবন্ধুর মধ্যে আধাঘণ্টা আলোচনা হয়। বঙ্গবন্ধুকে অভিনন্দন জানান, ইন্দিরা গান্ধী এবং অনুরোধ করেন, ঢাকার পথে যেন তিনি দিল্লিতে যাত্রাবিরতি করেন। বঙ্গবন্ধু আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন এবং দিল্লির উদ্দেশে রওনা হন।

দিল্লির ‘এক্সপ্রেস’ পত্রিকার বিবরণ অনুযায়ী, ‘কালো-ধূসর ওভারকোট পরে বঙ্গবন্ধু উড়োজাহাজের সিঁড়ি বেয়ে নামলেন। প্রেসিডেন্ট ভি. ভি. গিরি বঙ্গবন্ধুকে আলিঙ্গন করলেন। পাশে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী স্বাগত জানাচ্ছিলেন। তখন ২১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে অভিনন্দন জানানো হয়। শুভেচ্ছা পর্ব শেষে বঙ্গবন্ধু তিন বাহিনীর ১৫০ সদস্যের গার্ড অব অনার পরিদর্শন করেন এবং পরে ভিআইপি প্যান্ডেলে যান। সেখানে তাঁকে ফুল ছিটিয়ে শুভেচ্ছা জানানো হয়।

ভারতীয় কূটনীতিক শশাঙ্ক শেখর ব্যানার্জি লন্ডন থেকে বঙ্গবন্ধুর সহযাত্রী হন। তিনি লিখেছেন, ‘৯ জানুয়ারি ১৯৭২, ভোর ছয়টা। লন্ডন হিথরো বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে পৌঁছান বঙ্গবন্ধু। তাঁকে স্বাগত জানালেন ব্রিটিশ পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ বিভাগের কর্মকর্তা ইয়ান সাদারল্যান্ড ও লন্ডনে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার আপা বি পন্থ। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হিথের সঙ্গে শেখ মুজিবের বৈঠকের ব্যবস্থা করে দেন ইয়ান। আর ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ করিয়ে দেন আপা বি পন্থ। ফেরার পথে বিমানের সিটে সামনের টেবিলে বঙ্গবন্ধুর প্রিয় সুগন্ধময় এরিনমোর তামাক, আর সেই বিখ্যাত পাইপ রাখা ছিল। দেশে ফেরার জন্য উৎফুল্ল মুজিবের তখন তর সইছে না’। আপ্লুত কণ্ঠে তিনি বলে উঠলেন, ‘স্বাধীন বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ।’ তিনি বললেন, বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় মিত্রবাহিনী সদস্যদের ৩১ মার্চ ১৯৭২ সালের মধ্যে ভারতকে ফেরত নিতে হবে। ভারতীয় মিত্রবাহিনী চলে গেলে ব্রিটিশ সরকার স্বীকৃতি দেবে।  শশাঙ্ক ব্যানার্জি লিখেছেন, “উড়োজাহাজ আকাশে থাকতেই বঙ্গবন্ধু দাঁড়িয়ে গাইতে লাগলেন, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’। নয় মাসের  মুক্তিযুদ্ধে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় হলে ২২ ডিসেম্বর অস্থায়ী সরকার কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের মুজিবনগর থেকে রাজধানী ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ, অর্থমন্ত্রী এম মনসুর আলী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচএম কামরুজ্জামান গভর্নর হাউসে (বঙ্গভবন) গিয়ে ওঠেন। পদচ্যুত পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ চলে যান তার পুরাণ ঢাকার আগামসি লেনের বাড়িতে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী করা হয়  আব্দুস সামাদ আজাদকে।

৭ জানুয়ারি রাতে বিবিসির খবর দেয় যে- বঙ্গবন্ধু একটি চার্টার্ড বিমানে করে লন্ডনের পথে রয়েছেন। সেই খবরে মানুষের মাঝে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। বিবিসি দ্বিতীয় খবরে বলে, বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী বিমানটি সকাল সাড়ে ৬টায় লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে পৌঁছেছে। ওদিন সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু তাঁর সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন্নেছার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন।

৯ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন বাসায় গিয়ে বেগম মুজিবকে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশে ফেরার সময়সূচি জানান। বঙ্গবন্ধু ৯ জানুয়ারি রাতে লন্ডন ত্যাগ করে পরদিন দিল্লিতে পৌঁছে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। ভারতীয় একটি বিমানে কোলকাতায় একঘন্টা যাত্রা বিরতি করে বিকাল চারটার দিকে ঢাকা পৌঁছাবেন বলে খবর ছড়িয়ে পড়ে। বেগম মুজিব প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনকে অনুরোধ করে বলেন, দিল্লিতে বিমানে পরিবর্তন করলে ব্রিটেন মনক্ষুন্ন হতে পারে। তার ব্রিটিশ বিমানেই ঢাকা আসা উচিত। ততক্ষণে তাজউদ্দিন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ডি পি ধরকে ফোন করে বেগম মুজিবের পরামর্শ জানিয়ে দেন। সে অনুযায়ী ১০ জানুয়ারি দুপুরের দিকে ব্রিটিশ রাজকীয় বিমান “কমেট” দিল্লির পালাম বিমান বন্দরে অবতরণ করে। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও তাঁর মন্ত্রিসভা বিশাল অভ্যর্থনা জানান বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। সেই লাখ লাখ ভারতীয়দের উদ্দেশে দেয়া ভাষণে বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, “এক বিরাট সংকল্প নিয়ে আমি ফিরে যাচ্ছি আমার দেশে-বাংলাদেশে। সামনে যে পথ আমরা রচনা করবো, তা হবে শান্তির এবং প্রগতির পথ। কারো জন্যে কোনো ঘৃণা বুকে নিয়ে আমি ফিরছি না। মিথ্যার ওপরে সত্যের জয়,অশুচিতার ওপরে শুচিতার জয়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের জয় এবং সর্বোপরি অশুভ ও অসত্যের ওপরে সার্বজনীন সত্যের বিজয়ের প্রেক্ষাপটে আমি ফিরে যাচ্ছি আমার নিজের দেশে-রক্তস্নাত ওপর শুচিতায় উদ্ভাসিত স্বাধীন বাংলাদেশে।

মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ২৫ মার্চ, ১৯৭১ সালে তাঁকে গ্রেফতার করে পাকিস্তান সরকার। তাঁর দেশে ফেরার প্রক্রিয়া শুরু হয় ১৯৭১ সালের ২৪ ডিসেম্বর থেকে। ১৯৭২ সালের সাত জানুয়ারি ভোররাতে তাকে নিয়ে একটি উড়োজাহাজ যাত্রা করে লন্ডনে। ৮ জানুয়ারি লন্ডনে পৌঁছান বঙ্গবন্ধু। সেখানে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে বৈঠক করে পরদিন দেশের উদ্দেশে রওনা দেন তিনি। ফেরার পথে ভারতে যাত্রাবিরতি দিয়ে অবশেষে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে পৌঁছান বাঙালির মহানায়ক। ১০ জানুয়ারি দুপুর ১টা ৪১ মিনিটে তেজগাঁও বিমানবন্দরে নামেন জাতির জনক। সেখানকার জনসমুদ্র সাঁতরে রাজনীতির মহাকবি পৌঁছে যান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। লাখো জনতা সেখানে তাঁকে স্বাগত জানায়। ব্রিটিশ রাজকীয় সাদাকমেট বিমান থেকে অবতরণের সিঁড়ির মুখে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে প্রিয় নেতাকে অভিবাদন জানাতে উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ,অর্থমন্ত্রী মনসুর আলী, পদচ্যুত মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এইচএম কামরুজ্জামান, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুকে মাল্যভূষিত করেন।

এরপর  মুজিববাহিনীর চার অধিনায়ক শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক,তোফায়েল আহমেদ এবং মুক্তিযুদ্ধের খলিফাখ্যাত  স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতা নূরে আলম সিদ্দিকী, আসম আব্দুর রব, শাজাহান সিরাজ ও আবদুল কুদ্দুস মাখন বঙ্গবন্ধুকে মাল্য ভূষিত করেন। তাঁরা ডজ ট্রাক বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যাত্রা করে রেসকোর্স ময়দান অভিমুখে। ছাত্রনেতাদের নিয়ন্ত্রিত ট্রাকটিতে গাদাগাদি করে- দণ্ডায়মান ছিলেন মন্ত্রিসভার সদস্যরা। বিকাল তিনটায় অবতরণ করেছিলো বিমানটি। ছাত্রলীগ নেতারা ব্যূহের মতো করে মঞ্চের কাছে নিয়ে আসে বঙ্গবন্ধুকে। লাখ লাখ মানুষের উপচে'পড়া ভিড় ঢেলে যখন বঙ্গবন্ধু মঞ্চে উপবিষ্ট, তখন জয়বাংলার গগণবিদারি শ্লোগানে মুখরিত ময়দানের জনস্রোত। উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের মহানায়ক তোফায়েল আহমেদের কণ্ঠ মাইকে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে গর্জে উঠে শোনায় শেখ মুজিবুর রহমানের আগমনী বার্তা। উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইউব খানের পতনের পর ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক ডাকসু ভিপি তোফায়েল আহমেদ ২৩ ফেব্রুয়ারি কারামুক্ত আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি প্রদান করে এক জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে। ছাত্রজনতা করতালির মাধ্যমে মুহুর্মুহু শ্লোগান দিয়ে অভিষিক্ত করে। তোফায়েল আহমেদ ১০ জানুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে দাঁড়িয়ে সেই বঙ্গবন্ধু অভিধায়ই শেখ মুজিবকে অভিষিক্ত করে বলেন, ‘ভাইসব’ বঙ্গবন্ধু মঞ্চের দিকে আসছেন। কিছুক্ষণের মধ্যে তিনি ভাষণ দেবেন। কিন্তু তার আগে বঙ্গবন্ধুর এবং আমাদের নিরাপত্তার জন্যে দয়া করে সবাই বসে পড়ুন। হাত দুটোকে মাটির ওপর রাখুন। সঙ্গে সঙ্গে নজর রাখুন আশেপাশের প্রত্যেকের ওপর। খুনীর হাত যে কোনো জায়গা থেকে উঠে আসতে পারে।কড়া নজর রাখবেন। তোফায়েল আহমেদের এ বক্তৃতার মধ্যেই চোখের পলকে বঙ্গবন্ধু সভামঞ্চে। তিনি দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ নিথর হয়ে থাকলেন। ময়দানে উত্তেজনার উদ্বেল আনন্দ ধ্বনি। বঙ্গবন্ধু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নাবিজড়িত কন্ঠে বললেন ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ আমি বলেছিলাম, “ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলন, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম” আপনারা বাংলাদেশের মানুষ সেই স্বাধীনতা জয় করে এনেছেন। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমার ফাঁসি হুকুম হয়েছিলো,আমার সেলের পাশে আমার কবর খোঁড়া হয়! আমি মুসলমান, আমি জানি মুসলমান একবারই মরে,তাই আমি ঠিক করেছিলাম, আমি তাদের কাছে নতিস্বীকার করবো না।  ভুট্টোকে আমি বলেছি, বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে। এখন যদি কেউ সেই স্বাধীনতা নস্যাৎ করতে চায় তাহলে এই স্বাধীনতা রক্ষার করার জন্য শেখ মুজিব সর্বপ্রথম প্রাণ দেবে’।

বঙ্গবন্ধু জনসভা শেষ করে সদলবলে ছুটে যান শেরেবাংলা ও সোহরাওয়ার্দীর মাজারে। মাজার জিয়ারত করে ওখান থেকে যান শহীদ মিনারে। ততক্ষণে সন্ধ্যা। ওখান থেকে ৩২ নম্বরের সড়কের ধানমন্ডির বাড়িতে। যে বাড়ি থেকে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে তাঁকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। সেখানে ফেরেন বাবা, মা, ভাইবোন স্ত্রী, পুত্র-কন্যার মাঝে ।
১৮ জানুয়ারি নিউইয়র্ক টাইমসের শ্যানবার্গকে বঙ্গবন্ধু বলেন, আমাকে গ্রেফতার করে জাতীয় পরিষদ ভবনে নেয়া হয়। 
সামরিক ছাউনির একটি স্কুলের নোংরা ও অন্ধকার ঘরে রাখা হয় ছয় দিন। মধ্যরাতে জেনারেল টিক্কা খানের ঘরে।১ এপ্রিল বিমানে করে রাওয়ালপিন্ডিতে। তারপর মিয়ানওয়ালির কারাগারে। আমাকে রাখা হয় ফাঁসির আসামিদের সেলে।

পাকিস্তান তাঁর বিরুদ্ধে ১২টি অভিযোগ ‘বিচার’ শুরু করে। ছয়টির দণ্ড ছিল মৃত্যুদণ্ড। বিচার শেষ হয় চার ডিসেম্বর। ‘ইয়াহিয়া শেখ মুজিবকে হত্যার নির্দেশ দেন’। ৭ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধুকে মিয়ানওয়ালিতে নেয়া হয়। ১৫ ডিসেম্বর, ঢাকায় পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণের আগে ভোররাতে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার নির্ধারিত সময়ের দুঘণ্টা আগে জেল সুপার বঙ্গবন্ধুর সেলে ঢোকেন দরজা খুলে। বঙ্গবন্ধু জানতে চান, ‘আমাকে কি ফাঁসির জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে?’ জেল সুপার জানালেন, তাঁকে ফাঁসির জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে না। 
বঙ্গবন্ধুকে কয়েক মাইল দূরে এক অজ্ঞাত স্থানে সরিয়ে দেন জেল সুপার। সেখানে নয় দিন কাটে। ১৯ ডিসেম্বর জুলফিকার আলি ভুট্টো পাকিস্তানের শাসনভার গ্রহণ করেন। ২৪ ডিসেম্বর ও ৭ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে শেষ দেখা করেন ভুট্টো। বঙ্গবন্ধু তাঁকে বলেন, ‘আজ রাতেই আমাকে মুক্তি দিন অথবা মেরে ফেলুন’। শেষ পর্যন্ত ভুট্টোকে মুক্তিই দিতে হয়।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট ও ইতিহাস গবেষক

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর