শুক্রবার, ১৯ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা
সা’দত হাসান মান্টোর গল্প

শহীদ

ভাষান্তর : আবু তাহের

শহীদ

অলঙ্করণ - কাওছার মাহমুদ

গুজরাটের কাটিয়াদারে ছিল আমার বাড়ি। জাতে আমরা বণিক। দেশ ভাগাভাগির কারণে সর্বত্র যখন আকাল পড়ে গেল, আমি বেকার হয়ে পড়লাম। মাফ করবেন, আমি ‘আকাল’ কথাটা ব্যবহার করেছি। কিন্তু এতে ক্ষতি নেই। ভাষার মধ্যে এ ধরনের শব্দ আসা দরকার।

জি হাঁ, যা বলছিলাম, একেবারে বেকার হয়ে পড়েছিলাম। তবে ছোটখাটো একটা দোকান ছিল। ওই দোকানদারিতে কোনোমতে দিনটা চলে যেত। যখন দেশ ভাগ হলো, হাজার হাজার লোক পাকিস্তান যেতে শুরু করল। আমিও পাকিস্তান যাওয়ার মনস্থির করলাম। দোকানের কারবার না চলে চলুক, অন্য কোনো কারবার করা যাবে। তাই পাকিস্তানে রওনা হয়ে পথিমধ্যেই কিছু ডান হাত-বাঁ হাতের কারবার করতে করতে পাকিস্তানের মাটিতে এসে পা রাখলাম। উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানে পৌঁছে জমকালো একটা কারবার ফেঁদে বসব। সে জন্য পাকিস্তানে এসে সোজা অ্যালটমেন্টের ধান্দায় নেমে পড়লাম। তোষামোদ করা, তেল দেওয়া ইত্যাদিতে আমি আগে থেকেই অভ্যস্ত ছিলাম। মধু-চিনি মেশানো বুলি কপচিয়ে দু-চারজন ইয়ার-বন্ধু জুটিয়ে ফেললাম। অল্প দিনের মধ্যেই আমার নামে একটা বাড়ি অ্যালট হয়ে গেল। বাড়িটা থেকে পয়সা-কড়ি বেশ আসতে থাকে। এ কারবারটা নেহাত মন্দ না দেখে মনোযোগ দিয়ে লেগে থাকলাম। আরও বাড়ি অ্যালটমেন্টের ধান্দা করতে লাগলাম।

অল্পবিস্তর মেহনত সব কাজেই করতে হয়। অ্যালটমেন্টের কাজেও আমার বেশ কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। মোট কথা, এটা একটা বিরাট ঝকমারি। ভালো বাড়ি অ্যালটমেন্ট করবার জন্য আমায় সারা শহর চষে বেড়াতে হয়েছে। কারণ, আজেবাজে বাড়ি অ্যালটমেন্ট করিয়ে তেমন সুবিধে করা যায় না।

মানুষের পরিশ্রম কখনো বৃথা যায় না। এক বছরের মধ্যেই লাখ টাকার মালিক হয়ে যাই। খোদার দেওয়া সবই ছিল। চমৎকার বাংলো, চাকর-বাকর, পেকার্ড গাড়ি আর ব্যাংকে যথেষ্ট মালপানি। মাফ করবেন, ভাষার মধ্যে এসব শব্দ আসা দরকার।

জি হাঁ, যা বলছিলাম, খোদার দেওয়া সবকিছুই ছিল আমার। ব্যাংকে আড়াই লাখ টাকা, কারখানা আর দোকানপাটও ছিল। এত কিছু থাকা সত্ত্বেও মনের মধ্যে কেন জানি শান্তি ছিল না। যখন কোকেনের ব্যবসা করতাম তখনো মাঝেমধ্যে এমন লাগত। আজকাল মন বলতে কিছু আছে বলেই মনে হয় না। কিংবা বলা যায়, মনের ওপর ভারী বোঝা জমা হতে হতে মনটা তলিয়ে গেছে। কিন্তু অশান্তিটা কীসের?

মানুষটা ছিলাম বড়ই ঘাগু। সব রকম প্রশ্নেরই একটা না একটা কিনারা করে ফেলতে পারতাম। কী জন্য আমার অশান্তি লাগছে, স্থিরচিত্তে (চিত্ত বলতে সত্যিই আমার কিছু আছে কিনা কে জানে!) তার রহস্য উদঘাটনের চেষ্টা করলাম।

নারী? হয়তো বা। আমার আপন বলতে অবশ্য কেউ ছিল না। যে ছিল সে আমি গুজরাটে থাকতেই মারা গেছে। তবে অপরের বউ-ঝি ছিল। উদাহরণ হিসেবে আমাদের মালীর বউর কথাই ধরা যাক। মাফ করবেন, যার যেমন পছন্দ। তবে মেয়েদের চেহারার জৌলুস থাকা চাই। লেখাপড়া না থাকলেও চলে। কিন্তু একটু নাচ-গান আর ঠমক থাকতে হবে। ‘ঠমক’ কথাটাও আমাদের ওদিককার ভাষা।

মাথাটা ছিল অনেক সাফ। যে কোনো সমস্যার তলানিটুকু পর্যন্ত দেখে নিতে পারতাম। কারখানা আর দোকানপাট দিব্যি চলছিল। আপনিতেই টাকা পয়দা হচ্ছিল। একান্তে বসে অনেক ভেবেচিন্তে মনের অশান্তির যে কারণটি শেষাবধি নির্ণয় করলাম, তা হলো : পাকিস্তানে এসে অবধি আমি কোনো পুণ্যকাজ করিনি।

দেশে থাকতে তবু কিছু পুণ্যকাজ করেছিলাম। বন্ধু পান্ডরিং যেবার মারা গেল তার বিপন্ন বউকে বাড়িতে নিয়ে এলাম এবং পুরো দুই বছর বসিয়ে বসিয়ে খাওয়ালাম।

বিনায়কের কাঠের পা ভেঙে গিয়েছিল, ওকে নতুন একটা পা কিনে দিয়েছি। এজন্য গাঁটের চল্লিশটি টাকা খরচ হয়েছে আমার। যমুনা বাঈ, শালীর (মাফ করবেন) শরীরের তাপমাত্রা খুব বেড়ে গিয়েছিল, আমি তাকে ডাক্তার দেখালাম। ছ’মাস ধরে তার চিকিৎসার পেছনে মালপানি জোগালাম। কিন্তু পাকিস্তানে এসে এ ধরনের কোনো পুণ্যকাজ করিনি। মনের অশান্তির এ-ই একমাত্র কারণ।

এখন কী করা যায়? ভাবলাম, দান-সদকা করি। কিন্তু একদিন শহরে চক্কর দিয়ে এসে যে অভিজ্ঞতা হলো, তাতে দেখলাম, প্রায় সব লোকই অভাবী। কারও পেটে ভাত নেই, কারও কাপড় নেই। কাকে রেখে কাকে দিই! ভাবলাম, একটা লঙ্গরখানা খুলে দিতে পারি। কিন্তু একটা লঙ্গরখানায় কী হবে? তাছাড়া, তরি-তরকারি, এটা ওটা কালোবাজার ছাড়া জোগাড় করাও মুশকিল। তাহলে পাপের সাহায্যে পুণ্য অর্জনের মধ্যে সার্থকতা কোথায়?

ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে বসে আমি মানুষের দুঃখ-সুখের কাহিনি শুনেছি। সত্যি বলতে কী, এ জগতের কোনো লোকই সুখে নেই। ছোট বড় সবাই অসুখী। যারা পায়ে চলে তাদের দুঃখ, তাদের জুতা নেই। গাড়িতে চেপে যারা ঘুরে বেড়ান, তাদের দুঃখ, তাদের নতুন মডেলের গাড়ি নেই। ছোট বড় সবারই একটা না একটা অভিযোগ রয়েছে এবং প্রত্যেকেরই ন্যায্য অভিযোগ।

মির্জা গালিবের একটা গজল শুনেছিলাম আমি। গেয়েছিলেন আল্লাবখশ শোলাপুরের আমিনাবাঈ চিতলকর। গজলের একটা চরণ এখনো মনে আছে, ‘কিসকি হাজত রাওয়া করে কোই’।

মাফ করবেন, এটা গজলের দ্বিতীয় চরণ। কি জানি, প্রথম চরণও হতে পারে।

জি-হ্যাঁ, কে কাকে সাহায্য করবে বলুন! শতকরা একশ জনেরই তো ঠেকা। কাকে রেখে কাকে সাহায্য করব?

এরপর আমি দেখলাম, দান-খয়রাত করাটা তেমন ভালো কাজও নয়। এ ব্যাপারে আপনি হয়তো আমার সঙ্গে একমত হবেন না। কিন্তু আমি শরণার্থী শিবিরে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে যেটুকু বুঝলাম তাতে দেখলাম, দান-খয়রাতের বদৌলতে শক্তসামর্থ্য বহু লোক অকর্মণ্য হয়ে বসেছে। ওরা সারা দিন তাস পেটায়, গালিগালাজ করে, জুয়া খেলে। এমনি আরও কত অনাসৃষ্টি করে। এসব করে অথচ দিনের শেষে খাবার ঠিকই পেয়ে যাচ্ছে। এই অকর্মণ্যদের দিয়ে পাকিস্তানের কি উন্নতি হবে? সুতরাং দান-খয়রাতের মাধ্যমে পুণ্য অর্জনের চিন্তাটা আমি পুরোপুরি বাদ দিলাম।

 

মানুষের পরিশ্রম কখনো বৃথা যায় না। এক বছরের মধ্যেই লাখ টাকার মালিক হয়ে যাই। খোদার দেওয়া সবই ছিল। চমৎকার বাংলো, চাকর-বাকর, পেকার্ড গাড়ি আর ব্যাংকে যথেষ্ট মালপানি। মাফ করবেন, ভাষার মধ্যে এসব শব্দ আসা দরকার।

জি হ্যাঁ, যা বলছিলাম, খোদার দেওয়া সবকিছুই ছিল আমার। ব্যাংকে আড়াই লাখ টাকা, কারখানা আর দোকানপাটও ছিল। এত কিছু থাকা সত্ত্বেও মনের মধ্যে কেন জানি শান্তি ছিল না। যখন কোকেনের ব্যবসা করতাম তখনো মাঝেমধ্যে এমন লাগত। আজকাল মন বলতে কিছু আছে বলেই মনে হয় না। কিংবা বলা যায়, মনের ওপর ভারী বোঝা জমা হতে হতে মনটা তলিয়ে গেছে। কিন্তু অশান্তিটা কীসের?

মানুষটা ছিলাম বড়ই ঘাগু। সব রকম প্রশ্নেরই একটা না একটা কিনারা করে ফেলতে পারতাম। কী জন্য আমার অশান্তি লাগছে, স্থিরচিত্তে (চিত্ত বলতে সত্যিই আমার কিছু আছে কিনা কে জানে!) তার রহস্য উদঘাটনের চেষ্টা করলাম।

 

এরপর ফের চিন্তা শুরু- কীভাবে পুণ্য অর্জন করা যায়। ইতোমধ্যে শরণার্থী শিবিরে মহামারি দেখা দিল। কলেরা-বসন্ত এটা ওটায় ভুগে গন্ডায় গন্ডায় মানুষ মরে যেতে লাগল। হাসপাতালে নেই তিল ধারণের ঠাঁই। এসব দেখে আমার প্রাণ গলে গেল। ঠিক করলাম, একটা হাসপাতাল বানিয়ে দেব। প্ল্যান-প্রোগ্রাম সবকিছু প্রায় সেরে নিয়েছি। দরখাস্তের ফি-ও জমা হয়ে যেত। টেন্ডার কল করিয়ে তা নিজেই এক কোম্পানির নাম দিয়ে ধরে নিতাম। তারপর যেখানে এক লাখ টাকার টেন্ডার, সেই কাজটা সত্তর হাজার টাকায় সম্পন্ন করে ত্রিশ হাজার টাকা নিজের পকেটে পুরে নিতাম। সব রেডি। শুধু নির্মাণ শুরুর অপেক্ষা। হঠাৎ একটা কথা ভাবতেই ল-ভ- হয়ে গেল পুরো পরিকল্পনা। হাসপাতাল বানিয়ে দিয়ে লোকদের মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করার পেছনে আমি কোনো যুক্তি খুঁজে পেলাম না। সমাজে আজকাল যে হারে লোক বাড়ছে তা বরং কমানো দরকার। তা না করে লোক বাঁচাতে যাই কোন দুঃখে।

সমাজে আজকাল জনসংখ্যা উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে। লোক বাড়ছে বলেই যত ঝগড়া-ফ্যাসাদ, অরাজকতা দেখা দিয়েছে। এমন তো নয় যে, মানুষ বাড়ছে বলে জমিজমাও বাড়ছে। মানুষ বাড়ছে অথচ বর্ষণ বেশি হচ্ছে না, ফলনও বেশি হচ্ছে না। সুতরাং মানুষ বাঁচিয়ে রাখার মধ্যে কোনো উপকারিতা নেই।

তারপর ভাবলাম, একটা মসজিদ বানিয়ে দিই। কিন্তু আল্লাবখশ শোলাপুরের আমিনাবাঈ চিতলকরের গাওয়া একটা গান মনে পড়ে গেল; ‘নাম মনজুর হায়তো ফায়েজকে আসবাব বনা/পুল বনা চাহ বনা, মসজিদ অ তালাব বনা।’

কার সাধ্য এ জগতে নাম-কাম করে! নামের জন্য একটা সেতু বানিয়ে দিলে তাতে পুণ্য হবে সামান্যই। নাহ্, মসজিদ বানানোর এই খেয়ালটাও বিলকুল বেকার। তাছাড়া আলাদা আলাদা মসজিদ তৈরি করাও কওমের জন্য ক্ষতিকর। এতে কওমের মধ্যে ভাগাভাগির প্রবণতা এসে যায়। শেষতক সবকিছু বাদ দিয়ে আমি হজে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। অবশেষে আল্লাহতায়ালা নিজেই একটা পথ বাতলে দিলেন দেখছি। এমন সময় শহরে কীসের একটা সভা হলো।

সভাশেষে শ্রোতাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল বদহজমি এবং তা নিয়ে বেধে গেল দাঙ্গাহাঙ্গামা; এতে প্রায় ত্রিশ ব্যক্তির প্রাণ যায়। এ দুর্ঘটনার খবর পত্রিকায় পড়ে জানতে পাই, লোকগুলো নিহত হয়নি, শহীদ হয়েছে। শহীদ? এটা আবার কী ধরনের মৃত্যু? বিষয়টা খোলাসা জানবার জন্য ক’জন মৌলভির কাছে গেলাম। পরে বুঝলাম, যারা স্বাভাবিকভাবে মরে না, হঠাৎ কোনো দুর্ঘটনাকবলিত হয়ে মারা যায়, তারা পরকালে শহীদী দরজা পায়। মরে শহীদ হওয়ার মতো বড় সাফল্য আর হয় না। সত্যিই তো! লোকেরা এমনি না মরে যদি শহীদ হয়ে মরে সেটাই সবচেয়ে ভালো।

আমি ব্যাপারটা নিয়ে বেশ ভাবিত হয়ে পড়লাম। যেদিকে তাকাই না কেন, মানুষের বড়ই জর্জর অবস্থা। কোটরাগত চোখ, হাড্ডিসার দেহ, বেওয়ারিশ কুত্তার মতো পথেঘাটে, অলিগলিতে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘোরাফেরা করছে। কীভাবে কীসের তরে এরা বেঁচে আছে তার কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই।

কলেরা-বসন্ত দেখা দিলে এরা দলে দলে মারা পড়ে। তাছাড়া শীতে-গরমে, ক্ষুধা-অনাহারেও ধুঁকতে ধুঁকতে কত যে মরে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। জীবনটা কী, ঠিক বুঝে উঠতে পারি না।

‘উসনে খত না উঠায়া/ইয়ে ভি ঠিক হ্যায়।’

কার যেন কবিতাটা? আল্লাবখশ শোলাপুরের আমিনাবাঈ চিতলকর কত দরদ দিয়েই না গাইত :

‘মরকে ভি চয়ন না পায়া/তো কিধার জায়েঙ্গে।’

মানে বলছিলাম, মরণের পরও যদি ইহকালের মতো ধুঁকতে হয় তাহলে আর বেঁচে থেকে কী লাভ?

আজ এ জগতে যারা দুঃখ-দুর্দশায় দিন কাটাচ্ছে, তারা যদি পরকালে পরমানন্দে পায়ের ওপর পা রেখে দিন কাটাতে পারে, তাহলে বেশ মজা হবে। এবং সে জন্য এরা শহীদ হয়ে মরতে পারে ততই ভালো।

এখন প্রশ্ন হলো, এরা শহীদ হওয়ার জন্য রাজি হবে কিনা। কেন, রাজি হবে না কেন? মুসলমান হয়ে শাহাদাতবরণের ইচ্ছে যদি না থাকে, সে আবার কীসের মুসলমান? মুসলমানদের দেখা দেখি আজকাল হিন্দু ও শিখরাও শহীদ হওয়ার জন্য উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। তবে মরণাপন্ন এক ব্যক্তিকে যখন জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি শহীদ হতে চাও?’ সে সরাসরি জানায় ‘না’।

বুঝতে পারি না বেঁচে থেকে লোকটা কী লাভ করবে। তাকে অনেক করে বুঝাই, ‘দেখ বাপু তুমি যদি বাঁচ বড়জোর মাস দেড়েক বাঁচবে। এর বেশি এক দিনও না। তুমি হাঁটতে গেলে মাথা ঘুরে পড়ে যাও, কাশতে কাশতে একেক সময় প্রাণ বেরিয়ে যাচ্ছে মনে হয়, তোমার কাছে পয়সা কড়িও নেই, জীবনে সুখের মুখও দেখনি। মোটকথা তোমার জীবনে সব আশা-ভরসা স্তিমিত হয়ে এসেছে। তাই সময় থাকতে তুমি নিজেই শহীদ হওয়ার বন্দোবস্তটা করে নাও।’

‘তা কেমন করে হয়?’ বলে লোকটা।

‘কেন হবে না! মনে কর রাস্তায় কলার খোসা ফেলে রেখেছি আর তুমি চলতে গিয়ে ধড়াস করে পড়ে গিয়ে চিৎপাত। পড়েই শাহাদাতবরণ। সাধারণভাবে মরার চেয়ে শাহাদাতবরণ করার কত উপকার তা জান?’

কিন্তু লোকটাকে ঠিক বুঝানো গেল না। সে সোজা বলল, ‘চোখে দেখে কলার ছিলকায় কেন আমি পা দিতে যাব বাবা? আমার কি জীবনের মায়া নেই?’

হতভাগার কথা শুনে আমার খুব আফসোস হলো। আরও আফসোস হয়েছে যখন শুনলাম পরদিনই দাতব্য হাসপাতালের লোহার খাটের ওপর কাশতে কাশতে তার প্রাণবায়ু বেরিয়ে গেছে। অথচ লোকটা কত স্বচ্ছন্দে শাহাদাতবরণ করতে পারত।

এখন মরে তখন মরে দশায় ছিল এক বুড়ি। আমার খুব দয়া হলো। তাকে তুলে এনে রেললাইনের ওপর শুইয়ে দিলাম। ও মা! ট্রেনের আওয়াজ শুনতেই বুড়িটা ধড়মড় করে উঠে বসল আর প্রাণভয়ে দৌড়ে পালাল। আমি একেবারে হতাশ হয়ে পড়লাম। তবুও দমলাম না। জাতে বণিক আমি। জানেন তো, বণিকদের বুদ্ধি বড় পাকা। পুণ্য অর্জনের ওমন একটা মাধ্যমকে আমি সহজে হাতছাড়া করতে চাইলাম না।

মোগল আমলের পুরনো একটা দুর্গের মতো বাড়ি ছিল। তাতে ছিল একশ একান্নটি কামরা। অবস্থা একেবারে জড়সড়ো। অনেক অভিজ্ঞতা থেকে অনুমান করি, ভালোমতো একটা বর্ষা হলেই এর ছাদ ধসে পড়বে। অতএব, দশ হাজার টাকায় দুর্গটা কিনে নিয়ে আমি কায়ক্লেশে খেটে খাওয়া এক হাজার লোককে সেখানে থাকতে দিলাম। তারপর তৃতীয় মাসেই আমি যা অনুমান করেছিলাম, প্রবল বৃষ্টিতে ছাদ ধসে পড়ল। ছাদ চাপা পড়ে প্রায় সাতশ লোক মারা গেল।

আমার মনের ভারটা একটু হালকা হলো। একসঙ্গে সাতশ লোক শাহাদাতবরণ করায় সমাজের বিরাট সংখ্যক লোক কমে গেল।

পরে আমি এ কাজই করতে থাকি। বেশি না পারলেও রোজ দু-চারজনকে শাহাদাতবরণের সুযোগ করে দিতাম। আগেই বলেছি, সব কাজে পরিশ্রম লাগে ভাই। আল্লাবখশ শোলাপুরের আমিনাবাঈ চিতলকরের মুখে একটা গান প্রায়শ শোনা যেত।

মাফ করবেন, গানটি আসলে এ জায়গায় প্রযোজ্য নয়। না, আমি বলতে চাইছি, ব্যাপার যা-ই হোক, আমায় কিন্তু পরিশ্রম করতে হয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ একটা ঘটনা বলা যায়। হাবাগোবা একটা লোক শহীদ করার জন্য আমি দশ দিন ধরে চেষ্টা করেছি। ওর পথের ওপর কলার খোসা ছড়িয়ে রাখতাম প্রতিদিন। লোকটা কোনো দিনই খোসায় পা দেয় না। অবশেষে দশম দিনে পা দিল। আসলে এই দশম দিনই তার শহীদ হওয়ার নির্দিষ্ট দিন ছিল।

আজকাল আমি বিরাট একটা ভবন নির্মাণের কাজে হাত দিয়েছি। একটা কোম্পানি খুলে নিজেই নির্মাণ কাজের ঠিকাদারি নিয়েছি। দুই লাখ টাকার চুক্তিতে কাজ চলছে। পঁচাত্তর হাজার টাকা মুনাফা হবে। ভবনের বীমাও করে নিয়েছি। খুব সম্ভব তৃতীয় তলার কাজ শুরু হলেই সবকিছু ভেঙে চুরমার হয়ে পড়বে। নির্মাণের মালসামানা আমি সেভাবেই করেছি। নির্মাণ কাজে এখন একশ জন মজুর খাটছে। আল্লাহর ইচ্ছায় আমার যতটুকু ধারণা, এরা সবাই শহীদ হয়ে যাবে। যদি কেউ কোনোমতে বেঁচে যায়, বুঝতে হবে সে অতিশয় গুনাহগার, শহীদ হওয়া তার নসিবে নেই।

                > লেখকের উর্দু গল্পের ইংরেজি অনুবাদ ‘মার্টার্স’-এর ভাষান্তর।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর