শুক্রবার, ২ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা
শেষ পর্ব

দুর্বিপাকের সাহিত্য বাংলা সাহিত্যের অনুষঙ্গ

ড. নেয়ামত উল্যা ভূঁইয়া

দুর্বিপাকের সাহিত্য বাংলা সাহিত্যের অনুষঙ্গ

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প উপন্যাসেও মহামারির উল্লেখ রয়েছে এন্তার। ‘আরোগ্য’তে ললনার মুখে শোনা যায়, “কলেরা বসন্ত লেগেছে খুব। রক্ষাকালীর পূজো হবে, চাঁদা চেয়ে নিল। রোগ ব্যারামের এমন ছড়াছড়ি বোধ হয় জগতে কোথাও নেই। এবার যেন কাটতেই চায় না অসুস্থ অবস্থাটা।” ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ উপন্যাসের কেন্দ্রে রয়েছে অনগ্রসর গাওদিয়া গ্রাম। আর কেন্দ্র্রীয় চরিত্র শশী ডাক্তার। এ উপন্যাসেও এসেছে মড়কের প্রসঙ্গ। পুকুরঘাটে বন্ধুর বোন কিশোরী মতিকে যুবক ডাক্তার শশী জিজ্ঞাসা করে, সে কলেরার টিকা নিয়েছে কি না? মতির স্বভাবসুলভ জবাব- কলেরার টিকা লাগবে কেন? মা শীতলার দয়া থাকলেই সে বেঁচে যাবে। উত্তরে শশী হয় বিক্ষুব্ধ। ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’য় আক্ষরিক অর্থে পুতুল নাচের কোনো কাহিনি নেই। কিন্তু মানুষগুলোকে আড়ালের কোনো কলকাঠি কেমন করে ওদের নাচায়-সেটাই মূল বিষয়। মানুষ সত্তার মধ্য দিয়ে মানুষ ও পুতুলের দ্বৈরত নির্মাণ করেছেন মাণিক। প্রতিটি মানুষ আত্মকাম, নিজের লোভ এবং আকাক্সক্ষার দ্বারা চালিত। মানুষই মানুষের নিজের প্রতিপক্ষ, বিরোধী। এ আত্মকামনার কারণেই মানুষ নিজেকে নিয়ে খেলে। যে খেলায় সে যেমন খেলনা তেমনি খেলোয়াড়ও। মানুষ নিজেই নিজের নিয়ামক। এ নিজেকে নিয়ে খেলার কাহিনি ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’য় দৈব-দুর্বিপাকের বর্ণনায় আরও পাই “ভ্যাপসা গুমোট, শুষ্ক ডোবা-পুকুর-ভরা গ্রামের রুক্ষ মূর্তি আর কলেরা রোগীর কদর্য সান্নিধ্য, এই সমস্ত পীড়নের মধ্যে কুসুমের খাপছাড়া হাসিটুকু ভিন্ন মনে করিবার মতো আর কিছু শশী খুঁজিয়া পায় নাই।”

                বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পেয়ালা’ গল্পের প্রথমেই কথক কলেরার ভয়াবহ এক স্মৃতি স্মরণ করেন। কুলবেড়ের মেলাফেরত কাকা গল্পের কথককে মেলা শেষ হওয়ার আগেই বাড়ি ফিরে আসার বিষয়ে বলছেন, “হঠাৎ কলেরা শুরু হয়ে গেল, ওই তো হ’ল মুস্কিল! সব পালাতে লাগল, বাঁওড়ের জলে রোজ পাঁচটাছ’টা মড়া ফেলছিল, পুলিস এসে বন্ধ ক’রে দিলে, খাবারের যত দোকান ছিল সব উঠিয়ে দিলে, কিছুতেই কিছু হয় না, ক্রমেই বেড়ে চলল। শেষে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে এলাম।” গল্পের কথক গ্রামে গ্রামে নলকূপ বসানোর সরকারি বরাত নেন। ১৯৪৬ সালে প্রকাশিত বিভূতিভূষণের রোমাঞ্চকর উপন্যাস ‘হীরা মাণিক জ্বলে’তে জামাতুল্লার সমুদ্রের স্মৃতিতে জড়িয়ে থাকে কলেরায় আক্রান্ত হওয়ার ভয়াবহ দুঃসময়।

অনুরূপ কলেরার ভয়াবহ দৃশ্যের অবতারণা পাই তার ‘আরণ্যক’-এর  পঞ্চম পরিচ্ছেদে। “সেবার শুয়োরমারি বস্তিতে ভয়ানক কলেরা আরম্ভ হইল, কাছারিতে বসিয়া খবর পাইলাম। ...প্রতিদিন এত লোক মরিতে লাগিল যে, কুশী নদীর জলে সর্বদা মড়া ভাসিয়া যাইতেছে, দাহ করিবার ব্যবস্থা নাই।”

            তারাশঙ্করের অনেক গল্প-উপন্যাসেই রয়েছে মারী-মড়ক, দুর্বিপাকের অনুষঙ্গ। তার ‘আরোগ্য নিকেতন’ উপন্যাসে ‘শিক্ষিত ছেলেরা’ বিশুদ্ধ পানীয়জলের ব্যবস্থা করে কলেরায় মৃত্যু রোধ করতে চায়। কুয়ো খুঁড়তে কাঁধে তুলে নেয় কোদাল। এদের নাম ‘কোদালি ব্রিগেড’। এরা সবাই সেবাব্রতের সঙ্গী। কলেরার মড়ক থেকে গ্রামকে বাঁচাতে মরিয়া। “শুকনো পুকুরের তলায় কুয়ো কেটে তার জল বের করলে। তাই তো! কথাটা তো কারোর মনে হয়নি! স্যানিটারি ইনস্পেক্টরেরা পুকুরে ব্লিচিং পাউডার গুলে দিয়ে জলকে শোধন করলে। অ্যান্টি-কলেরা ভ্যাকসিন ইনজেকশন দিলে। কলেরার টিকে!” তারাশঙ্করের অপর উপন্যাস ‘ধাত্রীদেবতা’র নায়ক শিবনাথ কলেরার সময় গ্রামে গ্রামে আর্ত ও পীড়িতের সেবায় হয়েছে আত্ম-নিবেদিত। শিকার হয়েছেন নানান বিরুদ্ধতার। বৃন্দাবনের মতো একই দৃশ্য দেখতে হয়েছে তাকেও। ‘অস্পৃশ্য’দের সেবা করা নিয়েও হতে হয়েছে সামাজিক প্রতিরোধের শিকার। গ্রামের ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র তাকে রেহাই দেয়নি তিলমাত্রও। ‘ওলাওঠার বিস্তার’ নামে বিজ্ঞান প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথের ভাষ্য এরকম, “ভারতবর্ষ যে ওলাওঠা রোগের জন্মভূমি, এ সম্বন্ধে সন্দেহ অতি অল্পই আছে। ১৮১৭ খৃস্টাব্দে এই ভীষণ মড়ক বঙ্গদেশ হইতে দিগ্বিজয় করিতে বাহির হইয়া সিন্ধু, য়ুফ্রাটিস, নীল, দানিয়ুব, ভল্গা, অবশেষে আমেরিকার সেন্ট লরেন্স এবং মিসিসিপি নদী পার হইয়া দেশবিদেশে হাহাকার ধ্বনি উত্থিত করিয়াছিল

                      ১৭৭৬-এর মন্বন্তর এবং মন্বন্তরের অনুষঙ্গ হিসেবে মারী ও মড়কের বিবরণ এসেছে ১৮৮২ সালে রচিত বঙ্কিম চন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে। মুসলিমবিদ্বেষী বক্তব্যের ‘আনন্দমঠ’ সমালোচনার যোগ্য। কিন্তু ১৭৫৭ সালে বাংলায় ব্রিটিশ শাসন সূচিত হবার প্রেক্ষাপটে ১৭৭৬ নাগাদ কীভাবে এক মহাদুর্ভিক্ষ নেমে আসে এবং ক্রমে জনস্বাস্থ্যও দুর্ভিক্ষের কুপ্রভাব কিভাবে পড়ে, ‘আনন্দমঠ’ তাঁর এক বিশ্বস্ত দলিল : ‘১১৭৬ সালে গ্রীষ্মকালে একদিন পদচিহ্ন গ্রামে রৌদ্রের উত্তাপ বড় প্রবল। গ্রামখানি গৃহময়, কিন্তু লোক দেখি না। বাজারে সারি সারি দোকান, হাটে সারি সারি চালা, পল্লীতে পল্লীতে শত শত মৃন্ময় গৃহ। মধ্যে মধ্যে উচ্চ-নীচ অট্টালিকা। আজ সব নীরব। বাজারে দোকান বন্ধ, দোকানদার কোথায় পালাইয়াছে ঠিকানা নাই। আজ হাটবার, হাটে হাট লাগে নাই। ভিক্ষার দিন, ভিক্ষুকেরা বাহির হয় নাই। তন্তুবায় তাঁত বন্ধ করিয়া গৃহপ্রান্তে পড়িয়া কাঁদিতেছে। ব্যবসায়ী ব্যবসা ভুলিয়া শিশু ক্রোড়ে করিয়া কাঁদিতেছে। দাতারা দান বন্ধ করিয়াছে। অধ্যাপকে টোল বন্ধ করিয়াছে; শিশুও বুঝি আর সাহস করিয়া কাঁদে না। রাজপথে লোক দেখি না, সরোবরে স্নাতক দেখি না, গৃহদ্বারে মনুষ্য দেখি না। বৃক্ষে পক্ষী দেখি না। গোচারণে গরু দেখি না। কেবল শ্মশানে শৃগাল-কুকুর।’

       দুর্ভিক্ষের ফলে ঘটে ছোঁয়াচে রোগের অপ্রতিরোধ্য বিস্তার। মানুষ ‘খাদ্যাভাবে গাছের পাতা খাইতে লাগিল, ঘাস খাইতে আরম্ভ করিল, আগাছা খাইতে লাগিল। ইতর ও বন্যেরা কুক্কুর, ইন্দুর, বিড়াল খাইতে লাগিল। অনেকে পলাইল, যাহারা পলাইল, তাহারা বিদেশে গিয়া অনাহারে মরিল। যাহারা পলাইল না, তাহারা অখাদ্য খাইয়া, না খাইয়া রোগে পড়িয়া প্রাণত্যাগ করিতে লাগিল। রোগ সমর পাইল, জ্বর, ওলাওঠা, ক্ষয়, বসন্ত। বিশেষত বসন্তের প্রাদুর্ভাব হইল। গৃহে গৃহে বসন্তে মরিতে লাগিল। কে কাহাকে জল দেয়, কে কাহাকে স্পর্শ করে। কেহ কাহার চিকিৎসা করে না; কেহ কাহাকে দেখে না, মরিলেও কেহ ফেলে না।’

সৈয়দ মুজতবা আলী ‘পাদটীকা’ গল্পটি আরম্ভ করেছেন এভাবে, “গত শতকের শেষ আর এই শতকের গোড়ার দিকে আমাদের দেশের টোলগুলো মড়ক লেগে প্রায় সম্পূর্ণ উজাড় হয়ে যায়।” হাসান আজিজুল হকের ‘আগুনপাখি’ উপন্যাসটি বর্ধমান-বাঁকুড়া অঞ্চলের এক প্রত্যন্ত গ্রামের বধূর জবানিতে লেখা। উপন্যাসটি বহমানতায়, সততায়, নিরঙ্কুশ পবিত্রতায়, ক্ষুরধার চরিত্র-চিত্রণে হয়ে উঠেছে এক অতুলনীয় মানবিক দলিল। এটি সমকালীন গ্রামের সমাজের নিখুঁত ছবি এবং একটি একান্নবর্তী পরিবারের উত্থান-পতনের অনুপুঙ্খ বিবরণ। মেতর বউ-এর জবানিতে শোনা যায়, “এত রোগের নামও ত্যাকন জানত না লোকে। ডাক্তারবদ্যিও ছিল না তেমন। মরবার আগে মুখে যেদি ওষুধ পড়ত, তাই কত! পেরায় পিতি বছর কলেরা-বসন্তেই কত যে লোক মরত, তার সীমাসংখ্যা নাই।”

                        বেগম রোকেয়া ‘সুলতানার স্বপ্ন’-তে এঁকেছেন ইউটোপিয়ান দেশের চিত্র। তা সত্ত্বেও সেখানে আছে দৈব-দুর্বিপাক, মহামারি। সারার সঙ্গে গল্পের কথকের কথোপকথন অংশে দেখা যায়, “ভারতের প্লেগ সম্বন্ধেও অনেক কথা হইল, তিনি বলিলেন, ‘প্লেগ- ট্লেগ কিছুই নহে-কেবল দুর্ভিক্ষ প্রপীড়িত লোকেরা নানা রোগের আধার হইয়া পড়ে। একটু অনুধাবন করিলে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়, গ্রাম অপেক্ষা নগরে প্লেগ বেশি-নগরের ধনী অপেক্ষা নির্ধনের ঘরে প্লেগ বেশি হয় এবং প্লেগে দরিদ্র পুরুষ অপেক্ষা দরিদ্র রমণী অধিক মারা যায়। সুতরাং বেশ বোঝা যায়, প্লেগের মূল কোথায়-মূল কারণ দেশে অন্নাভাব। আমাদের এখানে প্লেগ বা ম্যালেরিয়া আসুক তো দেখি!” জহির রায়হানের ‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাসে ওলা, বসন্ত, যক্ষ্মা তিন বোন হিসেবে বর্ণিত হয়েছে। কাহিনিতে তারা একে অপরকে ছেড়ে যেন বাঁচতেই পারে না। উপন্যাসে কলেরা মড়ক চিত্রিত হয়েছে এভাবে, “অবশেষে আরো আট দশটি প্রাণ হরণ করে তবে গ্রাম থেকে বিদায় নিলেন ওলা বিবি।”

                 অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর স্মৃতিকথা ‘ঘরোয়া’তে বলেছেন, “শ্যামসুন্দর চলে গেল, রাধিকা গোঁসাই সমাজে কাজ নিলে, আর আসে না কেউ, দিনু তখন গানবাজনা করে, কলকাতায় প্লেগ, মহামারী, তার পরে এল স্বদেশী হুজুগ।” উল্লেখ্য, তাঁর মেয়ে প্লেগে মারা যায়। ‘জোড়াসাঁকোর ধারে’-তে তিনি উল্লেখ করেন, “সেই সময়ে কলকাতায় লাগল প্লেগ। চারদিকে মহামারি চলছে, ঘরে ঘরে লোক মরে শেষ হয়ে যাচ্ছে। রবিকাকা এবং আমরা এবাড়ির সবাই মিলে চাঁদা তুলে প্লেগ হাসপাতাল খুলেছি, চুন বিলি করছি। রবিকাকা ও সিস্টার নিবেদিতা পাড়ায় পাড়ায় ইন্সপেক্শনে যেতেন। নার্স ডাক্তার সব রাখা হয়েছিল। সেই প্লেগ লাগল আমারও মনে। ছবি আঁকার দিকে না ঘেঁষে আরো গানবাজনায় মন দিলুম। চারদিকে প্লেগ আর আমি বসে বাজনা বাজাই। হবি তো হ, সেই প্লেগ এসে ঢুকল আমারই ঘরে। আমার ছোট্ট মেয়েটাকে নিয়ে গেল। ফুলের মতন মেয়েটি ছিল, বড় আদরের। আমার মা বলতেন, ‘এই মেয়েটিই অবনের সবচেয়ে সুন্দর।’ ন-দশ বছরের মেয়েটি আমার টুক করে চলে গেল; বুকটা ভেঙে গেল। কিছুতে আর মন যায় না। এ বাড়ি ছেড়ে-চৌরঙ্গিতে একটা বাড়িতে আমরা পালিয়ে গেলুম।”             

           সুকুমার রায়ের ‘অবাক জলপান’ নাটকের দ্বিতীয় দৃশ্যে পথিকের সঙ্গে মামার সংলাপে পাই, “এই দেখুন এক শিশি জল... দেখতে মনে হয় বেশ পরিষ্কার, কিন্তু অনুবীক্ষণ দিয়ে যদি দেখেন, দেখবেন পোকা সব কিলবিল করছে। কেঁচোর মতো, কৃমির মতো সব পোকা। এমনি চোখে দেখা যায় না, কিন্তু অনুবীক্ষণ দিয়ে দেখায় ঠিক এত্তো বড় বড়। এই বোতলের মধ্যে দেখুন, ও বাড়ির পুকুরের জল; আমি এইমাত্র পরীক্ষা করে দেখলুম; ওর মধ্যে রোগের বীজ সব গিজ্গিজ্ করছে। প্লেগ, টাইফয়েড, ওলাওঠা, ঘেয়োজ্বর। ও জল খেয়েছেন কি মরেছেন! এই ছবি দেখুন। এইগুলো হচ্ছে কলেরার বীজ, এই ডিপথেরিয়া, এই নিউমোনিয়া, ম্যালেরিয়া। সব আছে। আর এই সব হচ্ছে জলের পোকা। জলের মধ্যে শ্যাওলা ময়লা যা কিছু থাকে ওরা সেইগুলো খায়। আর এই জলটার কি দুর্গন্ধ দেখুন! পচা পুকুরের জল। ছেঁকে নিয়েছি, তবু গন্ধ।” সুকুমার রায় তাঁর ‘নানাগল্পে’-র ‘পেটুক’ (সন্দেশ-১৩২৪) -এ লিখেছেন, “বাড়িতে ইঁদুরের যে রকম উৎপাত, ইঁদুর মারবার একটা বন্দোবস্ত না করলে চলছে না। চারদিকে যে রকম প্লেগ আর ব্যারাম এই পাড়াসুদ্ধ ইঁদুর না মারলে আর রক্ষা নেই।”

             ঊনিশ শতকের শেষ ত্রিশ বছর এবং বিশ শতকের প্রথম দুই দশকের স্মৃতিচারণা ‘ঘরের কথা ও যুগসাহিত্য’ গ্রন্থের ‘ঢাকায় ওলাউঠা’ শীর্ষক লেখায় দীনেশচন্দ্র সেন কলেরার মড়কে ভয়াবহ মনের অবস্থার কথা জানিয়েছেন এভাবে, “একটা উৎকট দুঃস্বপ্নের মত দিনটা চলিয়া গেল। স্কুলে গেলাম, দেখিলাম সহপাঠীরা প্রায় সকলে পলাইয়া গিয়াছে, মাষ্টারবর্গও প্রায়ই অনুপস্থিত। রাস্তা দিয়া আসিতে পথে পথে কেবল ‘হরিবোল’, কান্নার রোল, অনাথ ছেলেমেয়েদের চিৎকার, দোকানপাঠ বন্ধ। ‘বলহরি’ মিষ্ট কথাটা বুকের মধ্যে বজ্র নিনাদের মত বাজিতে লাগিল।”

     প্লেগ, কলেরা বা বসন্ত রোগে মড়ক লাগার ফলে গড়ে উঠেছিল শীতলা-মনসাসহ নানান লৌকিক দেবীর থান ও তাঁদের কেন্দ্র করে কাব্য-কবিতা। মড়কে মৃতদেহ সৎকারের জন্য পাওয়া যেতো না কাউকে। কিন্তু সব সময় একদল মানুষ মানুষের পাশে এসে দাঁড়াত, দেশসেবার অংশ হিসেবেই হোক বা মানবতার খাতিরে। স্বামী বিবেকানন্দ রচনাবলির পত্রাবলি ৩৫০ থেকে আমরা জানতে পারি, কলেরা বা বিসূচিকা রোগীর সেবা কেমন করে পক্ষান্তরে দেশ-সেবারই অঙ্গ হয়ে উঠে।

                মানুষ দৈব-দুর্বিপাক, দুর্যোগ, সংকট জয় করে এগিয়ে যায়। জীবনের চলমান স্রোত রুদ্ধ করার শক্তি নেই কোন দুর্বিপাকের। সে অর্থে মানুষই সর্ব-বিজয়ী। অগ্রজ নমস্য কবিদের মতো আমার মতো নগণ্যেরও অভিন্ন বিশ্বাস:

দেখা হবে কোনো পাখিডাকা ফাল্গুনে/ কেটে যাবে সব বিচ্ছেদ ব্যাকুলতা/ মরু সাহারার সবুজ মরুদ্যানে /মিলনে মিলবে মমতার উষ্ণতা। দেখা হবে কোনো মুখরিত জনস্রোতে/ জনসমাগমে করতালি হিল্লোলে/একাকার হয়ে মহামিলনের ব্রতে/ চোখে চোখ রেখে বাকহীন বিহ্বলে। সৃষ্টি-লয়ের বৃত্তবন্দি ডোর/ মহাকাল তাতে খেয়ালের ছক আঁকে /প্রগতির পথে বিঘ্ন যতোই ঘোর/ মানুষই বিজয়ী দৈব-দুর্বিপাকে।

সর্বশেষ খবর