মঙ্গলবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

যেভাবেই তুমি সকাল দেখ সূর্য কিন্তু একটাই

ওয়াহিদা আক্তার

যেভাবেই তুমি সকাল দেখ সূর্য কিন্তু একটাই

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সরাসরি কাজ করেছি মাত্র সাড়ে তিন বছর, এর মধ্যে করোনার জন্য বেশ অনেকটা সময় তাঁর কাছে যেতে পারিনি। প্রতি বছর সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময় জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে যোগ দিতে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে দেশ ত্যাগ করেন এবং ফিরে আসেন সেপ্টেম্বর মাসের শেষে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অনুপস্থিতিতে প্রতি বছর ২৮ সেপ্টেম্বর তাঁর জন্মদিন অনাড়ম্বরভাবে পালিত হয়। গণভবনে বাদ আসর একটা মিলাদের আয়োজন করা হয়। সেখানে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং গণভবনের কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দ, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আত্মীয়স্বজন, স্কুল-কলেজের বান্ধবী, দলীয় কার্যালয়ের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও কর্মীরা উপস্থিত থাকেন। আমি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে কাজ করার সুবাদে ১০ বছর এ সুযোগ পেয়েছি। ব্যক্তিগত অনুবিভাগের কর্মকর্তা হিসেবে আমি প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হিসেবে প্রায় ১৭ বার বিদেশ ভ্রমণ করেছি। খুব কাছ থেকে দেখেছি অন্যান্য দেশের রাষ্ট্রপ্রধানগণ আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে রাষ্ট্রাচারের বাইরে শ্রদ্ধাপূর্ণ সমীহ করতেন। বয়স, ব্যক্তিত্ব, সৌন্দর্য ও রুচিতে মানবিক চিন্তাচেতনায় মৌলিক দর্শনে শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে অনন্য অসাধারণ। প্রতিবার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে শেখ হাসিনার মুকুটে একটি করে পালক যোগ হয়। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। শেখ হাসিনা দেশের জন্য সবসময় বয়ে আনেন মর্যাদার স্বীকৃতি। আবারও ফিরে এসেছে তাঁর জন্মদিন। ব্যক্তিগত কর্মকর্তা হিসেবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রোগ্রাম অনুসরণ করে প্রতিদিন সকালে গণভবনে চলে আসতাম। দোতলায় রিসিভ করে বেশির ভাগ সময় আমি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে প্রোগ্রামে যেতাম। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী খুব দ্রুত হাঁটেন, শুনেছি মানুষের বয়স শুরু হয় পা থেকে। সে  হিসেবে শেখ হাসিনার হাঁটা এখনো অনেক তরুণ-তরুণীকে পেছনে ফেলে দেবে। তাঁর হাঁটার স্টাইল আমাকে খুব টানে। প্রতিদিন সকালে আমরা যার যার এজেন্ডা নিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে সারি হয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতাম। আমি কখনই কোনো প্রোগ্রামে তাঁকে বিলম্ব হতে দেখিনি।

যেদিন মন ভালো থাকত আমাদের বাড়তি পাওনা থাকত তাঁর হাসিমুখ ও স্বভাবসুলভ রসিকতা, আদরমাখা কথা। সাধারণত বের হওয়ার সময় খুব জরুরি না হলে আমরা কোনো কথা বলতাম না। কথা বলে দেরি করে দেওয়া তিনি পছন্দ করতেন না। খুব জরুরি কথা অনেক সময় সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে সেরে নিতাম। সেটা তাঁর সাক্ষাৎ প্রার্থীদের বিষয়ে প্রতিদিনের নির্দেশনা বা তিনি যে সব বিষয়ে জানতে চাইতেন। নিচে অনেক সময় নেতা-কর্মীরা থাকতেন তিনি সেভাবেই বের হতেন। নিচে নেমে তিনি একটু ধীরেসুস্থে গাড়িতে উঠতেন যেন তাঁর ব্যক্তিগত কর্মকর্তারা ঠিকমতো গাড়িতে অবস্থান নিতে পারে। আমরা দৌড়ে যার যার গাড়িতে উঠতাম। আমি যেহেতু প্রতিদিন সকালে গণভবনে যেতাম এ জন্য যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকালীন জন্মদিন উপলক্ষে ২৮ সেপ্টেম্বর গণভবনের পরিবেশ আমার চোখে পড়ত। অন্যান্য দিন গণভবনের গেট থেকেই ভিতরের ব্যস্ততা, মালিদের বাগান পরিচর্যা, শিফট পরিবর্তনে কর্মচারীদের আসা-যাওয়ায় গণভবন চত্বর টান টান উত্তেজনায় ভরপুর থাকত। জেলার নেতা-কর্মীরা যাদের পাস লাগে না নিরুৎসাহিত করার পরও আসা-যাওয়ার পথে সেসব নেতা-কর্মী, সাক্ষাৎ প্রার্থীদের ভিড় লেগে থাকত। এ ছাড়া এসএসএফ, পিজিআরের সদস্যদের তৎপরতা, কার্যালয়ের সচিব কর্মকর্তাদের গাড়ি আসা-যাওয়ায় গণভবন সরব থাকত। কিন্তু ২৮ সেপ্টেম্বর গণভবনে যাওয়ার সময় মনে হতো চারদিকে সুনসান নীরবতা, গাছের পাতারাও যেন থেমে আছে। কিচিরমিচির করা পাখিরাও যেন থেমে আছে। গণভবনের ভিতরে ঢোকার পর মিলাদে আসা কাউকে দেখলে তখন ভালো লাগত।

মিলাদের আগে কার্যালয়ের কর্মকর্তাসহ অন্য সবার উপস্থিতিতে কিছুটা সরগরম হয়ে আবার সুনসান নীরবতা বিরাজ করত। গণভবনে অনেক প্রাণীর মধ্যে কিছু বানর আছে যারা শেখ হাসিনার প্রশ্রয়ে অহেতুক ঝাঁপাঝাঁপি করে এ গাছ থেকে সে গাছে, ছাদে কার্নিশে দৌড়াদৌড়ি করে তাদের দেখতে চেষ্টা করেও দেখা যেত না। গণভবনের এই শাখামৃগের দল প্রধানমন্ত্রীর সামনেই দোতলার টবে লাগানো আম, পেয়ারা ছিঁড়ে খেত। তিনি কিছুই বলতেন না। আমরা মিলাদ শেষে শেখ হাসিনার দীর্ঘায়ু ও সুস্থ জীবনের জন্য দোয়া করে পালন করতাম শেখ হাসিনার জন্মদিন। বঙ্গবন্ধু পরিবারের অন্য সদস্যদের জন্মদিন বেশির ভাগই আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে। বিভিন্ন এতিমখানায় খাবার পাঠিয়ে জন্মদিন পালন করতেন শেখ হাসিনার পরিবার। পরিবারের সদস্যদের ছেলেমেয়েদের জন্মদিন নীরবে একান্তভাবে নিজেরা পালন করেন যা আমরা কর্মকর্তারা জানতে পারতাম না। একবার শেখ রেহানা আমাকে বললেন- উত্তরখান এলাকায় আপন নিবাস নামে একটি প্রতিষ্ঠান আছে যারা রাস্তায় পড়ে থাকা ভিক্ষুক, অসুস্থ, পঙ্গু নারীদের তুলে নিয়ে এসে সেবা দেয়, চিকিৎসা দিয়ে জীবনের শেষ দিনগুলোতে আপনজনের মতো সেবাযত্ন পায়, তাদের কোনো অসুবিধা আছে কি না খোঁজ নিতে। আমি তৎকালীন সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব জুয়েনা আজিজ ম্যাডামসহ একবার সেখানে যাই। প্রায় ৬০-৭০ জনের মতো অতিবৃদ্ধ, দুস্থ, অসুস্থ নারীকে দেখলাম, সবকিছু খোঁজ নিতে গিয়ে জানলাম এদের বড় বড় হাঁড়ি-পাতিল, প্লেট, বাসন, রান্নার সরঞ্জাম সব শেখ রেহানার কিনে দেওয়া। তিনি তাদের শীতের কম্বল, পোশাক পাঠান, মাঝে মাঝে পারিবারিক সব সদস্যের জন্মদিনের খাবার পাঠান। সচিব ম্যাডাম ও আমি শেখ রেহানার নীরবে-নিভৃতে এমন সমাজ সেবায় অভিভূত হই।

একান্ত সচিব-২ হিসেবে আমাকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর তৃণমূলের রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, দুস্থ অসহায় সাহায্যপ্রার্থী/সাক্ষাৎ প্রার্থীদের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপনের কাজ করতে হতো। তাঁকে দেখতাম বিরোধী দলে থাকাকালীন জুলুম নির্যাতনের শিকার, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার আহত স্পি­ন্টার বহনকারী নেতা-কর্মীরা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কাজ করেছেন এমন বয়স্ক অসুস্থ নেতা-কর্মীদের তিনি খোঁজ করতেন। কোনো সূত্রে তাদের খবর পেলে আমাদের বলা হতো ব্যবস্থা নিতে। নিজ হাতে লিখে সাহায্য করে আমাদের যোগাযোগ করতে বলতেন।

দলমত নির্বিশেষে কোনো সাহায্য প্রার্থী তাঁর কাছে থেকে নিরাশ হতেন না। লেখাপড়া খরচ, বাসস্থান তৈরি, চিকিৎসা, সাহায্যপ্রার্থীদের বৃদ্ধ বাবা-মা, বিধবা স্ত্রীলোকদের তিনি পৃথকভাবে নির্দেশনা দিতেন। আমি এক দিন প্রশংসা করতে গিয়ে বললাম, ‘স্যার’ আমি হিসাব করে দেখেছি প্রতিদিন আপনি এত পরিমাণ টাকা দান করেন। তিনি বললেন এগুলো তো ওদেরই টাকা আমার কাছে আছে। তবে আমার নিজের কিছু টাকা আছে কয়েকবার প্রধানমন্ত্রী হওয়াতে বেশ কিছু টাকা জমেছে। ওটা থেকে আমি আমার ব্যক্তিগত দান করি। এই শেখ হাসিনা যখন বলেন যে, ক্ষমতায় যাওয়া মানে আমার কাছে দায়িত্ব পালনের সুযোগ পাওয়াকে বুঝি এ কথাটা যেন তাঁর মুখেই মানায়। বিচার বুদ্ধি প্রয়োগ করে জনগণের আমানত রক্ষার দায়িত্ব পালন করার ক্ষমতা সবার থাকে না, এটা ঐশ্বরিক। আরও বলতেন এই দেশটার জন্য আমার আব্বা, মা, ভাই-বোনদের অনেক ত্যাগ আছে। আমার আব্বা যাদের জন্য রাজনীতি করেছেন সেই বাংলার দুঃখী মানুষের জন্য কিছু করাতেই শান্তি পাই। শেখ হাসিনার বেঁধে দেওয়া সীমার মধ্যে তাঁর পরিবারের সদস্য যারা তাঁরা ব্যক্তিগত লোভ লালসা, ভোগ বিলাস দুর্নীতির ঊর্ধ্বে। পরিবারের অন্যতম সদস্য সজীব ওয়াজেদ জয় ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকার ও প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও প্রযুক্তিবিষয়ক অবৈতনিক উপদেষ্টা। সরকারের কোনো খাত থেকে তিনি একটি পয়সাও ভাতা পান না এ নিয়ে মিথ্যাচারের শেষ নেই দুমুখদের। যেখানে এই যুগে প্রফেশনালিজমের নামে টাকা ছাড়া কোনো সেবাদাতা মুখটা পর্যন্ত হাঁ করেন না, যেখানে মেধাস্বত্বের দাবিতে কথায় কথায় মামলা হয় সেখানে অবৈতনিক উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দিয়ে সজীব ওয়াজেদ জয়কে বঞ্চিত করা হচ্ছে তাঁর ন্যায্য প্রাপ্য থেকে। এটা আমার ব্যক্তিগত অভিমত।

শেখ হাসিনা অনেক খবর পান সরাসরি জনগণের কাজ থেকে। অবসর পেলে মেসেজগুলো দেখেন, প্রয়োজন মনে করলে ব্যবস্থা নেন। আমরা যারা তাঁর ব্যক্তিগত অনুবিভাগের কর্মকর্তা ছিলাম। আমাদের কাছে ফরোয়ার্ড করে তিনি ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিতেন। এ ছাড়া গণভবনে আমার কিছু রিকুইজিশন আসত পাস দিতে হবে এরা আপার লোক। নিয়ম ছিল যে যাদের পাস দেবে তারা সাক্ষাতের সময় উপস্থিত থাকবে। আমি দেখতাম তৃণমূলের রাজনৈতিক কর্মী, গরিব দুঃখী, সাধারণ লোক, নেতা-কর্মী, অসুস্থ সাহায্যপ্রার্থী হিসেবে যারা আসত তাদের পরিচয় হলো আপার লোক। একবার একজন রাজনৈতিক নারীকর্মী মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর খুবই কাছে গিয়ে উচ্চস্বরে কথা বলছে দেখে এসএসএফ সদস্যরা আমাকে ডেকে নিয়ে আসে। আমি কিছু বুঝে না বুঝে ওকে পেছন দিকে টেনে ধরে একটু জোরেই দূরে নিয়ে আসি। শেখ হাসিনা আমাকে ধমক দিয়ে বললেন, ‘এই তুমি ওকে এত জোরে ধরেছো কেন’। পরে রাতে বিদায় দিতে দোতলায় উঠলে আমাকে বললেন, ‘তোমরা ওদের সঙ্গে এমন করবে না ওরা আমাকে মারবে না বরং ওরা আমাকে বাঁচায়।’ আপার লোক হিসেবে যারা আসত তারা তাঁকে মাঝে মাঝে

জড়িয়েও ধরত তখন এসএসএফ সদস্যরা আমার দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকাত। এমনই একটা মজার কথা তিনি এক দিন বলেন যে, ১৯৮১ সালে ১৭ মে দেশে ফিরে তিনি সারা বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বলতে গেলে চষে বেড়ান।

‘শেখের বেটি’ হিসেবে অনেকে কুঁড়েঘরে নিয়ে বসাত। এমন একজন দরিদ্র নারী পাটি পেতে বসতে দিয়ে বলেন, তোমার বাবাও এভাবে রাস্তায় হেঁটেছে তুমিও শুরু করেছ। তাঁর খসখসে হাতে গলায় হাত দিয়ে বলে গলা কেন খালি, কানে হাত দিয়ে বলে কান কেন খালি, এরপর নাকে হাত দিয়ে দেখে নাকফুল নেই। এসব অনুযোগ করার পর দুই হাতে মুখটি ধরে পান খাওয়া মুখে দুই গালে চকাস চকাস করে ভিজিয়ে দিল। আমি শুনে হেসে বলি ভালোবাসার অত্যাচার! তাঁর পিতার জীবনের অনেক ঘটনা নিজের জীবনে ঘটেছে বলে তিনি জানান। ৯ এপ্রিল ১৯৪৬ সালে বঙ্গবন্ধু দিল্লি নিজামউদ্দিন আউলিয়ার মাজারে গিয়েছিলেন-১৯৮১ সালের ঠিক সেই দিনেই তিনি এবং শেখ রেহানা ওই মাজারে গেলে খাদেমরা তাঁকে খাতাটি এনে দেখায়। সেদিন তিনি অনুমান করেছিলেন মহান আল্লাহপাক তাঁকে দিয়ে কিছু করাবেন হয়তো। এরপর দীর্ঘ সংগ্রাম ধৈর্য মিলে আরেক ইতিহাস।

আমি প্রায়ই একা সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় আশপাশে তাকিয়ে কাউকে না দেখলে দোতলায় লিফটে উঠে পড়তাম। প্রধানমন্ত্রী কখনো এ লিফট ব্যবহার করতেন না। আমি ভাবতাম কেউ মনে হয় দেখছে না। এক দিন বললেন- তুমি তো দোতলায়ও লিফটে যাও, হাঁট না, সিঁড়ি ভাঙতে চাও না; আমি তো থ। তিনি দেখলেন কীভাবে, পরে শুনেছি সিসি ক্যামেরায় দেখেছেন। এখনো নিজের বয়সের দিকে তাকিয়ে নিজেই মজার কথা বলে কটাক্ষ করেন। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, শেখ হাসিনা মহান আল্লাহপাকের ইচ্ছায় এখনো চলাফেরাতে চিন্তাচেতনায় অনেক পরিশ্রমী, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী, বয়সের চেয়ে অনেক সবল একজন রাষ্ট্রনায়ক। মাঝে মাঝে তাঁর সঙ্গে পেছনে চেয়ারে বসে নামাজ তাড়াতাড়ি শেষ করতাম। চেয়ারে বসে নামাজ পড়ছি-তিনি যেন না দেখেন। তাঁকে রুকু, সেজদা, যথারীতি নিয়মমাফিক আদায় করার সৌভাগ্য আল্লাহ দিয়েছেন। এও ভাবতাম আল্লাহ তো দেখছেন, আমি আল্লাহকে ভয় না পেয়ে প্রধানমন্ত্রীকে ভয় পাচ্ছি, এটা ভেবে নিজের মনে হাসতাম।

কোনো গরিব মানুষকে কখনো শেখ হাসিনাকে ভয় পেতে দেখিনি, তাদের জড়িয়ে ধরে, হাত ধরে ঝগড়া করতেও দেখেছি। ঈদের সময় শুভেচ্ছা বিনিময়ে সাধারণ মানুষের জন্য বাঁশ দিয়ে সারিতে দাঁড়ানোর ব্যবস্থা হয়। সবাই ঈদ মোবারক বলে, কথা বলে কাগজ ধরিয়ে দিলে কাগজগুলো তিনি আমাদের হাতে দিতেন। একবার মিরপুরের দিকের একজন মিছিলের অগ্রভাগের যুবলীগের নারীকর্মী প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে রীতিমতো ঝগড়া শুরু করেছে, আমরা বিব্রত। সে চিৎকার করে গলা উঁচিয়ে বলছে শেখ হাসিনাও জবাব দিচ্ছেন। এক পর্যায়ে শেখ হাসিনার অপরাধ হলো যে তিনি বলেছেন অনেক রাজনীতি করেছ আর করতে হবে না, বাড়ি বসে সংসার কর। আর যায় কোথায় কেন এ কথা বললেন নেত্রী, সে ঝগড়া শুরু করেছে তো থামতে চায় না। এসএসএফ মেয়েরা পথ থেকে তাকে সরাতে পারেনি। গেট হয়ে পথ আটকে দাঁড়িয়ে আছে, আমি কাছে গেলে এক ঝটকায় পারলে আমাকে ফেলে দেয়। শেখ হাসিনা বললেন ‘ও থাক দাঁড়ানো, তুমি ওর পেছন দিয়ে অন্যদের আসতে দাও। তাঁর নেতা-কর্মীরা যে আচরণ করত, নালিশ করত, অভিমান করত উনি প্রত্যেকের সঙ্গে দাঁড়িয়ে ধৈর্য ধরে কথা শুনতেন। খুশি করার জন্য বঙ্গবন্ধুর ছবির সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে বলতেন, ‘হইছে, এবার বাড়ি যা’। আমাদের ওপর নির্দেশনা ছিল গণভবনে কেউ এলে চা, বিস্কুট মিষ্টি কিছু যেন খেতে দেওয়া হয়। তারা গণভবনে এসে ছবি তুলে হাসিমুখে চলে যেত। একবার একজন এসে সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে অনেক কিছু নালিশ জানালেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন যে, দেখবেন, দলের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে হবে। ছবি তুলে বিদায় দিয়ে ওপরে উঠলেন। সিঁড়িতে উঠতে উঠতে আমি বললাম যিনি সংসদ সদস্য হয়েছেন তিনি তো আপনার আশীর্বাদপ্রাপ্ত। নেতা-কর্মীদের সঙ্গে এমন করা উচিত না। তিনি ওপরে উঠে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, তুমি চেন তাকে? আমি বললাম- জি না, চিনি না। বললেন তাহলে তো কিছুই জান না। এর অত্যাচারে ওর জীবন অতিষ্ঠের জন্য সে কিছুই করতে পারছে না এলাকায়। আমি দেখতাম গণভবনে কে কী কাজে কার মাধ্যমে আসছে তিনি জানতেন। আমি অনেকবারই প্রমাণ পেয়েছি।।

আমি এক দিন কথায় কথায় বললাম, স্যার অনেক লেখা পড়েছি আপনার, কিন্তু নিজের কথা, পথ চলতে সবার সহযোগিতা-অসহযোগিতার কথা কোথাও লেখেন না, বললেন-পাগল! এসব লিখলে সব ভেঙে খান খান হয়ে যাবে। নীলকণ্ঠ যদি দেখতে চাও, আমাকে দেখ। এক দিন অনুষ্ঠানের বিদেশি অতিথিদের অনুবাদ ডিভাইস হেডফোন দেওয়া হয়নি। তিনি লক্ষ্য করেছেন যে, তাদের বুঝতে কষ্ট হচ্ছে। পড়বি পড় মালির ঘাড়ের মতো আমার দায়িত্ব না হওয়া সত্ত্বেও বকা খেলাম। বললেন- ‘এই তোমরা যে সাজুগুজু করে বসে থাক, এসব দেখ না?’ আর এক দিন ঈশ্বরদী রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রথম ঢালাই অনুষ্ঠানে রাশিয়ান কোম্পানির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে একটি কল অনে দেখা গেল রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত মহোদয়কেই ঢুকতে দেওয়া হয়নি। নালিশ হতেই আমার দিকে চেয়ে বললেন, ‘সব দোষ আমার অফিসের, এই তোমরা ঝাঁকের কই-এর মতো আমার সঙ্গে ঘুরে বেড়াও এগুলো দেখ না?’ নীরবে বকা খেতে সবাই ইশারা করলেও মনে মনে বলি প্রধানমন্ত্রীরা বাংলার ছাত্রী হলে বকা খেয়েও মজা! নারীর ক্ষমতায়ন ও মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় অসামান্য অবদানের জন্য ২০১৮ সালে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে ‘গ্লোবাল সামিট অন উইমেন’ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গ্লোবাল লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড প্রদান করে। আমরা সমাজের বিভিন্ন স্তরের প্রায় সব সফরসঙ্গী মহিলা ছিলাম। অ্যাওয়ার্ড প্রদান অনুষ্ঠানটি উদযাপনের জন্য ব্যবসায়ী নারী প্রতিনিধিগণ ওয়াটার মেলন কেক কেটে উদযাপনের সিদ্ধান্ত নেন। কেক কাটার সময় দেখা গেল স্তরে স্তরে বরফ জমে ফুটস কেকে কেউ ছুরিটি বসাতেই পারছেন না। সবাই একবার চেষ্টা করে ফিরে আসছেন। অবশেষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্যান্ট্রিতে কর্মরত একজন অস্ট্রেলিয়ান পুরুষ লোক এসে কেকটি কেটে দেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দূরে বসে আমাদের এ অবস্থা দেখে মজা করে বললেন ‘দেখ আমার নারীর ক্ষমতায়নের অবস্থা’! অনেক মজার স্মৃতি যা লিখে বা বলে শেষ হবে না।

প্রত্যেক মানুষের মনে কোনো না কোনো কাজের প্রতি প্রবণতা আছে। সেই কাজটি করে তিনি আনন্দ পান। সেই কাজটি তিনি ভালোবেসে করতে পারেন। এই প্রবণতা বা আগ্রহ ছাড়া উন্নতি করা যায় না। মহান আল্লাহপাক কাউকে দিয়ে কিছু করাতে চাইলে তাঁর ভিতরে সেই কাজের জন্য আগ্রহ বা ভালোবাসা দিয়ে দেন। যুগে যুগে দার্শনিকরা বলেছেন তাই নিজেকে ভালোভাবে জানতে নিজেকে নিজে আবিষ্কার করতে। কেউ যদি নিজেকে আবিষ্কার করতে পারে বা তার প্রবণতা খুঁজে পায় তাকে আমরা আত্মবিশ্বাসী মানুষ বলে অভিহিত করি। এই ভালোবাসা তাকে কিছু একটা করতে বাধ্য করে। আমাদের জীবনের শ্রেষ্ঠতম উদ্দেশ্যই হলো এই প্রবণতা বা সহজাত ক্ষমতাকে ঠিক পথে কাজ করতে চালনা করা। ভালো কাজে সন্তানকে প্রভাবিত করা মানুষের কাজ। শেখ হাসিনা তাঁর সন্তানদের আত্মবিশ্বাসী হিসেবে গড়ে তুলেছেন এবং সেভাবে শিক্ষা দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর সীমাবদ্ধতা ছিল বাংলাদেশের মানুষকে তিনি খুব বেশি ভালো বাসতেন আর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সীমাবদ্ধতা হলো তিনি কখনই অমানবিক কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। শেখ হাসিনার সমালোচনাকারীদের কাছে একটাই বিনীত প্রশ্ন যে, শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবারকে নিয়ে আপনারা যেসব কথা প্রচার করেন তা আপনারা নিজেরা বিশ্বাস করেন কি-না?

বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা তাদের সন্তানদের জনহিতৈষীমূলক ভালো কাজের প্রবণতাকে উৎসাহিত করেছেন সব সময় যেমন করেছেন বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুৎফর রহমান তাঁর ছেলে শেখ মুজিবকে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেখেছি বহুমাত্রিক কাজের ভিড়েও কোনো সাহায্য প্রার্থী মানুষের আবেদন ধরলেও বিরক্ত হতেন না বরং বিস্তারিত জেনে তিনি আর্থিক সহায়তা দিতেন। আজ শেখ হাসিনার জন্মদিন। শেখ হাসিনার দেহে বইছে বঙ্গবন্ধুর শোণিত ধারা। বাংলার দুঃখী মানুষের প্রতি বাবার অনুভূতি ধারণ করা শেখ হাসিনা নিখাদ দেশপ্রেম, দূরদর্শিতা, প্রজ্ঞা, দৃঢ়তা ও মানবিকতার এক অপূর্ব সমন্বয়ে দায়িত্ব পালনের ধারাবাহিকতায় বিশ্বময় বাংলাদেশকে এক অনন্য উচ্চতায় আসীন করেছেন। হাজার বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে বঙ্গবন্ধুর মতো একজন মহান নেতাকে পাওয়ার জন্য আর জানি না কত শত বছর অপেক্ষা করতে হবে শেখ হাসিনার মতো আর একজন মানবতাবাদী রাষ্ট্রনায়কের জন্য। পরিশেষে কবি আসাদ মান্নানের ‘এক মহা শান্তিমাতা’ কবিতার চরণ দিয়ে শেষ করছি :

কে বলে রোহিঙ্গা ওরা! ওরা ভাই আমার সন্তান।

দানবের কণ্ঠ ছিঁড়ে আনতে হবে মানবের গান।

বাঙালির গর্ব যিনি দেশরত্ন মানবী হাসিনা

মানব মুক্তির যুদ্ধে তিনি ছাড়া আমরা বাঁচি না।

লেখক : অতিরিক্ত সচিব।

সর্বশেষ খবর