বৃহস্পতিবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

মেয়েরা অধিকার চাইবে, অশান্তি হবে না, এ কেমন কথা?

তসলিমা নাসরিন

মেয়েরা অধিকার চাইবে, অশান্তি হবে না, এ কেমন কথা?

বেগম রোকেয়ার জন্মবার্ষিকীতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খুব গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতা করেছেন। তিনি মেয়েদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘অধিকার আদায় করে নিতে হয়। সাথে সাথে এইটুকু বলব অধিকার আদায় করতে গিয়ে সংসারে যেন ঝামেলা না হয়, অশান্তি না হয়। সেটাও দেখতে হবে।’ মেয়েরা অধিকার চাইবে, আর সংসারে অশান্তি হবে না, এমন সংসার আমি বাংলাদেশে দেখিনি। অধিকার যে চায়, সত্যি বলতে কী, সে অশান্তি করে না। অশান্তি করে তারাই, যারা চায় না মেয়েরা তাদের প্রাপ্য অধিকার পাক। শেখ হাসিনা আরও বলেছেন, ‘পরিবারের প্রতি মেয়েদের দায়িত্ব আছে, সমাজের প্রতিও দায়িত্ব আছে। এই দায়িত্বটা থাকতে হবে। পরিমিতিবোধটা থাকতে হবে। সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ পরিমিতিবোধ, সেটা আমি মনে করি।’ এ নতুন উপদেশ নয়। মেয়েদের ওপর এরকম উপদেশ প্রতিনিয়ত বর্ষিত হয়। ‘স্বামী সন্তানের প্রতি, পরিবারের প্রতি, সমাজের প্রতি দায়িত্ব রয়েছে মেয়েদের। এই দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করতে হবে।’ ‘পরিমিতিবোধ’ কিন্তু একটি আপেক্ষিক শব্দ। কোনও কোনও পুরুষের কাছে, স্বামী-সন্তান ফেলে একটি মেয়ে যদি ২ ঘণ্টার জন্য ঘরের বাইরে চাকরি করতে যায়, সেটি পরিমিতির অভাব, আবার কারও কাছে ৮ ঘণ্টার বেশি পার হলে তবেই পরিমিতির অভাব। কারো কাছে অফিস করা চলবে, কিন্তু অফিসের কাজে শহরের বাইরে যাওয়া চলবে না, অথবা কলিগদের সঙ্গে পার্টিতে যাওয়া চলবে না। কারো কাছে হিজাব বা বোরখা না পরে বাইরে কাজ করতে যাওয়াও পরিমিতিবোধ না থাকা। পরিবারের প্রতি এবং সমাজের প্রতি মেয়েদের দায়িত্ব বলতে পুরুষতান্ত্রিক লোকেরা যা বোঝে বা পরিমিতিবোধের যে সংজ্ঞা তারা জানে, তা পালন করতে গেলে মেয়েদের ঘরের বাইরে বেরোনো বন্ধ করা ছাড়া পথ নেই। ঘরের বাইরে বেরোলে কোনও না কোনও দায়িত্বে ব্যাঘাত ঘটবে। পুরুষেরা যখন তাদের পূর্ণ অধিকার উপভোগ করে, তখন কিন্তু পরিবারের প্রতি এবং সমাজের প্রতি তাদের দায়িত্ব পালন করার এবং পরিমিতির ব্যাপারে সতর্ক থাকার প্রশ্ন ওঠে না। এর মানে এসব দায়িত্ববোধ আর পরিমিতিবোধ শুধু নারীর জন্য, পুরুষের জন্য নয়।

স্বামী-সেবা করা, সন্তান লালনপালন করা, রান্না করা, পরিবেশন করা, পরিবারের সকলের দেখভাল করা, ঝুটঝামেলার নিষ্পত্তি করা, ঘরবাড়ি পরিষ্কার রাখা, অতিথি-আপ্যায়ন করা ... এরকম হাজারো রকম কাজ সম্পন্ন করলেই পরিবারের প্রতি দায়িত্ব পালন করা হয়। মেয়েরা যদি অর্থ উপার্জনের অধিকার ‘আদায়’ করতে যায়, তাহলেই কোনও না কোনও ‘দায়িত্ব’ অসম্পূর্ণ থেকে যাওয়ার আশংকা থাকে। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু নারী পুরুষ উভয়ে যদি পরিবারের কাজ সমানভাবে ভাগাভাগি করে নেয়, তাহলে কিন্তু ‘দায়িত্ব’ নিয়ে সমস্যা হয় না। আসলে সমাজের বেঁধে দেওয়া নারী পুরুষের ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকাই সমস্যা ঘটায়। পুরুষ যখন নিজের অধিকার ভোগ করে, তখন কিন্তু তাকে উপদেশ দেওয়া হয় না, পরিবারে, সমাজে যেন কোনও অশান্তি না হয়। কিন্তু মেয়েরা অধিকার ভোগ করতে গেলে সংসারে অশান্তি হলে চলবে না। অশান্তি হলে অধিকার ভোগ করা চলবে না, এই তো? এর অর্থ মেয়েরা যদি নিজের প্রাপ্য অধিকার পেতে চায়, পিতা বা স্বামী যদি বাধা দেয়, মেয়েদের অধিকার পাওয়ার আশা বাদ দিতে হবে। বাদ না দিলে অশান্তি সৃষ্টি হবে। এবং অশান্তিটিই কোনওভাবে হতে দেওয়া যাবে না।

আসলে মেয়েদের এই উপদেশ দেওয়ার প্রয়োজন নেই যে, অধিকার ভোগ করতে গিয়ে সংসারে যেন ঝামেলা না হয়, অশান্তি না হয়। অশান্তি যেহেতু পুরুষেরা করে, তাই পুরুষদের এই বলে উপদেশ দিতে হয়,... ‘মেয়েরা তাদের অধিকার ভোগ করবে, পুরুষ তোমরা ঝামেলা করো না, অশান্তি সৃষ্টি কোরো না। মেয়েদের প্রাপ্য অধিকার পেতে বাধা হয়ে দাঁড়িও না। পরিবারের প্রতি, সমাজের প্রতি তোমাদের যে দায়িত্ব তা পালন করো, পরিমিতিবোধ যেন থাকে।’ যারা মেয়েদের চলার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তারা, আমরা সবাই জানি, পুরুষ। মেয়েরা কিন্তু পুরুষের অধিকার পেতে বাধা নয়, পুরুষ শিক্ষিত হবে, স্বনির্ভর হবে, নিজের স্বপ্ন পূরণ করবে, নিজের ইচ্ছের মূল্য দেবে এতে মেয়েরা বাধা হয়নি কখনো। বরং প্রেরণা দিয়েছে। শেখ হাসিনা নিজেই বলেছেন তাঁর মা ফজিলাতুন্নেসা তাঁর বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রেরণা দিতেন। বলেছেন, “বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেমন সংগ্রাম করেছেন তার পাশে থেকে সাহস জুুগিয়েছিলেন আমার মা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব। তিনি তার জীবনে যেই মহান আত্মত্যাগ করেছিলেন, তার সন্তান হিসেবে আমি তা জানি। তাই আজকের দিনে তাকে বারবার মনে পড়ছে। আব্বা থাকতেন কারাগারে বন্দি। মা একদিকে যেমন আমাদের সব ভাই বোনদের মানুষ করেছেন, আত্মীয় স্বজন বা পার্টির কেউ যদি অসুস্থ হতো তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা বা তাদের দেখা, যারা জেলে যেত প্রত্যেকটা পরিবারকে তিনি নিজে সহযোগিতা করতেন। পাশাপাশি দলকে সংগঠিত করা, আন্দোলন গড়ে তোলা এবং আব্বার জন্য মামলা মোকদ্দমা। একটার পর একটা তার বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হতো সেগুলোও একাধারে দেখার কাজ তিনি করে যেতেন। মাঝে মাঝে ভাবি কীভাবে তিনি এতকিছু করতেন। আমার বাবার রাজনৈতিক জীবনে তিনি ছিলেন একজন উপযুক্ত সাথী। যিনি সব সময় পাশে থেকে প্রেরণা জুগিয়েছেন। তিনি কোনো দিন বলতেন না যে সমাজে সংসারে কোনো অভাব-অনটন বা কোনো অসুবিধার কথা নিয়ে মাকে কোনো দিন অভিযোগ করতে শুনি নাই। শুধু বলতেন তুমি তোমার কাজ করে যাও। ঘর সংসার নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না।”

নারীর আত্মত্যাগী ভূমিকাটিকেই মানুষ পছন্দ করে। পুরুষকে নির্বিঘ্নে তাঁর কাজ করে যেতে নারী প্রেরণা দেবে, নারী ঘর সংসার সামলাবে, সন্তান মানুষ করবে, স্বার্থহীন হবে, নিজের কথা ভাববে না, শুধু অন্যের কথা ভাববে, অন্যের জন্য জীবন দেবে। পুরুষ বিশ্বজয় করবে। অন্যের কথা ভাববে না, শুধু নিজের কথা ভাববে, নিজের সাফল্যের কথা। নারী ও পুরুষের ভূমিকা এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ এভাবেই নির্ধারণ করেছে। পুরুষ ভোগ করবে, নারী ত্যাগ করবে। ভোগী এবং ত্যাগী। নারী বিশ্বজয় করছে, আর পুরুষ নারীকে প্রেরণা দিচ্ছে এগিয়ে যাওয়ার, পুরুষ সংসার সামলাচ্ছে, সন্তান মানুষ করছে, আর বলছে ‘তোমার কাজ করে যাও, ঘর সংসার নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না’ এ কেউ কল্পনাও করতে পারি না। এরকম ঘটনা এই সমাজ ঘটতেই দেবে না। সমাজ চাপ দেবে স্বামী যেন এমন স্বার্থপর মেয়েকে তালাক দেয়, মেয়েটিকে যেন সমাজচ্যুত করে।

যদিও নারীর সমানাধিকার আমরা দাবি করি, যতক্ষণ বাক্যটি দাবির মধ্যে আছে, ততক্ষণ সমস্যা নেই। কিন্তু সত্যিই যদি নারীরা সমানাধিকার ভোগ করতে শুরু করে, নারীকে কচুকাটা করবে পুরুষ, পুরুষতান্ত্রিক পরিবার এবং সমাজ। পুরুষতান্ত্রিক পরিবার এবং সমাজের থাবা থেকে বাঁচতে হলে তাই গণতান্ত্রিক একটি রাষ্ট্র মেয়েদের জন্য খুব জরুরি, যে রাষ্ট্রের চোখে নারী পুরুষ উভয়ে সমান, যে রাষ্ট্র মেয়েদের নিরাপত্তা দেবে এবং মেয়েদের অধিকার পেতে যে কোনও বাধাকেই অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করবে।

শেখ হাসিনা খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন, ‘আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী না হলে মেয়েদের কোনো স্থান সমাজে ও সরকারে থাকে না। এটাই প্রকৃত বাস্তবতা।’ হ্যাঁ, এটাই প্রকৃত বাস্তবতা। সে কারণে মেয়েদের স্থান সমাজে নেই বললেই চলে। সমাজের কত ভাগ মেয়ে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী? আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হতে চাইলে স্বামীরা বাধা দেয়। স্বামীরা চায় মেয়েরা স্বামীর অর্থের ওপর নির্ভর করুক, স্বামীর অনুগত হয়ে থাকুক।

যে স্বামীরা চায় মেয়েরা অর্থ উপার্জন করুক, সে স্বামীরা কিন্তু চায় না মেয়েরা স্বাবলম্বী হোক, জীবনে কী করবে না করবে সে সিদ্ধান্ত নিজে নিক। তারা চায় মেয়েরা স্বামীদের অর্থের জোগান দিক। অর্থ উপার্জন করে সেই অর্থ কী খাতে মেয়েরা খরচ করবে, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার খুব কম মেয়েরই আছে। স্বামীরা মেয়েদের স্বাধীনতার পথে সবচেয়ে বড় বাধা।

রোকেয়া নারীবাদী লেখক হতে পেরেছিলেন, কারণ তাঁর স্বামী তাঁর কাজে বাধা দেননি। বরং প্রেরণা দিয়েছেন। সাখাওয়াতের মতো স্বামী আমাদের নারীবিরোধী সমাজে কোটিতে একটিও মিলবে বলে আমার মনে হয় না। সাখাওয়াত হোসেনের মতো স্বামী যদি না জোটে, তাহলে কী করে মেয়েরা তাদের প্রাপ্য অধিকার পাবে? পাবে যদি স্বামী বলে কোনও বস্তু মেয়েদের না থাকে। দুর্মুখেরা বলে, পুরুষের সাফল্যের পেছনে আছে নারী আর নারীর সাফল্যের পেছনে আছে ডিভোর্স। আমি আমাকে দিয়েই ভাবি, আমি যদি ডিভোর্স না দিতাম আমার স্বামীকে, তাহলে আমাকে দাসীবাঁদী হয়ে থাকতে হতো, মানুষ হওয়া হতো না।

লেখক : নির্বাসিত লেখিকা

সর্বশেষ খবর