বুধবার, ১৫ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

অযোগ্য অথর্ব শাসিত সমাজে ভিসির পাশবিক ধর্ষণের অভিজ্ঞতা

পীর হাবিবুর রহমান

অযোগ্য অথর্ব শাসিত সমাজে ভিসির পাশবিক ধর্ষণের অভিজ্ঞতা

আমৃত্যু বঙ্গবন্ধুই আমার চিরসত্য, চিরসুন্দর, আদর্শ। মহাকালের ইতিহাসের কিংবদন্তি। আমার আজন্মের আবেগ-অনুভূতি নিঃশর্ত আনুগত্য ও অমিত সাহসের নাম জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কি দুর্র্ধর্ষ এক মহান বীর জন্মেছিলেন টুঙ্গিপাড়ার শ্যামলছায়া গাঁয়! কি কঠিন সময়ে তিনি ধর্মের নামে জন্ম নেওয়া পাকিস্তান রাষ্ট্রকে মেনে না নিয়েই স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম শুরু করেছিলেন! পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণ, তাদের এ-দেশীয় ক্ষমতাধর প্রতাপশালী দাস ও বিশ্বমোড়লদের ছায়াকে তোয়াক্কা করেননি।

জিন্নাহ, ইসলাম, মুসলমান, পাকিস্তান- এমন অনুভূতির বিপরীতে তাঁর দূরদর্শী নেতৃত্বের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের আন্দোলনে গোটা জাতিকে এক মোহনায় এনেছিলেন। জীবনের ১৩টি বছর জেল-নির্যাতন সয়েছেন। কত বিদ্বেষ, ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করেছেন। ফাঁসির দড়ি ঝুলেছে, কবর খুঁড়েছে তবু মাথা নত করেননি। গভীর মমতায় দল গড়েছেন, কত শত নেতা, কত সহস্র কর্মী-সংগঠক ও বীর তৈরি করেছেন। নেতা-কর্মীদের আস্থা-বিশ্বাস, স্নেহে আগলে রেখেছেন। গভীর দেশপ্রেমের আদর্শে, সাহসে, সততায় তৈরি করেছেন। একটি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে নিজের প্রতি বিশ্বাসে অনুগত করে গণরায় নিয়ে মহান স্বাধীনতার ডাক দিয়েছেন। ’৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বীরের বেশে ফিরে এসেছেন তাঁর হাজার বছরের শৃঙ্খলমুক্ত জাতির প্রিয় স্বাধীন স্বদেশে। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যাঁকে হত্যার সাহস পায়নি, ’৭১ সালে ফাঁসির রায় দিয়ে কবর খুঁড়েও যারা হত্যার সাহস করেনি, সেই মহান নেতাকে এ দেশের বিশ্বাসঘাতকরা হত্যাই করেনি, কত মত-পথের বিরোধীরা তাঁর নাম-কীর্তি ও ইতিহাসকে মুছে দিতে চেয়েছে। আমরা সেই অন্ধকার সময় থেকে পিতৃহত্যার প্রতিবাদে, তাঁর আদর্শে লড়েছি অবিচল বিশ্বাসে। রক্তাক্ত বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু আমার হৃদয়জুড়ে ভালোবাসার গভীর সমার্থক শব্দ।

বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে দীর্ঘ লড়াইয়ে আবার ইতিহাসে জাতির পিতাকে আপন মহিমায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন। বঙ্গবন্ধুর মতো, এমন নেতৃত্ব আর কোনো দিন পৃথিবীর বুকে আসবে না। এমন মানবতাবাদী সুপুরুষ বাঙালি মহানায়কের আবির্ভাব হবে না বিশ্বরাজনীতিতে। খুনিদের বিচার হলেও পিতৃহত্যার গ্লানি থেকে কি আসলেই জাতি মুক্ত হবে কখনো? ভাবলেই আমার মন বিষাদে বেদনায় ভারী হয়! কতটা নির্দয়তা পিতার প্রতি একটি জাতি করেছে! আজ সরকারি-বেসরকারি সব দল-মত-পথের সবাই মুজিববন্দনা করেন, শেখ হাসিনার জন্য কি আকুতি করেন, আওয়ামী লীগের কত বড় ভক্ত হন!

যদি জিজ্ঞাসা করি পঁচাত্তরের পর কোথায় ছিলেন? কোন রাজনীতি করেছেন? আয়নায় চেহারা দেখেন? ২০০১-এর পর কী ভূমিকা রেখেছেন? এখন কি ক্ষমতার হালুয়া-রুটির ভাগে নাকি বিশ্বাসে আত্মগ্লানির অনুশোচনায় নিজেকে বদলেছেন? যদি দেখি আওয়ামী লীগবিরোধী দলে গেলে যারা টানা ১১ বছরে শেখ হাসিনার আমলে আওয়ামী লীগ হয়েছেন তারা প্রকৃত অর্থেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শকেই চিন্তা-চেতনায় লালন করেছিলেন নাকি শঠতা, প্রতারণা, চতুরতার আশ্রয় নিয়ে করুণাশ্রিত ক্ষমতার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা ও ব্যক্তিগত লাভ-লোভের হিসাবে নিজেদের এখানে সমবেত করেছিলেন দেখা যাবে? তবে জনগণের কাঠগড়ায় সবাইকেই জবাব দিতে হবে। দিতে হয়। এ প্রশ্নগুলো কাউকে অবজ্ঞা বা খাটো করার জন্য উঠে আসে না। ১৯৭৫ সালের রক্তাক্ত ১৫ আগস্টের কালরাতে পরিবার-পরিজনসহ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মানবসভ্যতার ইতিহাসের সবচেয়ে নৃশংস হত্যাকা-ের মাধ্যমে একটি জাতির উদিত সূর্যকে অস্তগামী করার পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ থেকে উঠে আসে। সেদিন বঙ্গবন্ধুর রক্তাক্ত নিথর দেহ ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে ফেলে রেখে আগের দিনও তাঁর জন্য খাবার নিয়ে আসা ঘাপটি মেরে থাকা ধূর্ত মীরজাফর, ক্ষমতালোভী, বিশ্বাসঘাতক খন্দকার মোশতাককে খুনিদের প্রহরায় অবৈধভাবে রাষ্ট্রপতির শপথ নিতে দেখা গেছে। অনেককে শপথ আয়োজন নিয়ে শোকস্তব্দ জাতির সামনে তটস্থ হতে দেখা গেছে। অনেককে সেই খুনির মন্ত্রিসভায় রক্তের ওপর দিয়ে যোগ দিতে দেখা গেছে। দেশের বাইরে থাকায় বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বেঁচে যান। কিন্তু তাদের আমৃত্যু রক্তক্ষরণের সেই হৃদয়বিদারক অপূরণীয় ক্ষতির দিনে বেলজিয়ামে বঙ্গবন্ধুর দয়ায় নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত সানাউল হকের বাসভবনে উপলব্ধি করেছেন। আগের রাতে যিনি তাঁদের অতিথি পেয়ে মহানন্দে গর্বিত হয়েছেন এবং থাকার জন্য অনুরোধ করেছেন, সেই সানাউল হকই পারলে দ্রুত বের করে দেন। সেদিন জার্মানিতে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত পেশাদার কূটনীতিক মরহুম স্পিকার হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী ড. ওয়াজেদ মিয়াকে খবরই দেননি, তাঁদের সবাইকে তাঁর কাছে এনে ভারতীয় হাইকমিশনের মাধ্যমে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর আশ্রয়ে পাঠিয়ে দেন। সে সময় দেশে একচ্ছত্র রাজনৈতিক দল ছিল আওয়ামী লীগ। মস্কোপন্থিরা ছিলেন নবগঠিত বাকশালে বিলীন। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ছিল নিষিদ্ধ। বিপ্লবী উগ্রপন্থি কর্মকান্ডের তৎপরতা থাকলেও সারা দেশে প্রায় সব শ্রেণি-পেশার মানুষই ছিলেন আওয়ামী লীগের সমর্থক। কিন্তু পরবর্তী পরিস্থিতি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কমিটেড অনুসারী আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের এবং বিভিন্ন পেশার মানুষের জন্য ছিল ভয়াবহ। হাজার হাজার নেতা-কর্মীকে জেল-জুলুম, নির্যাতন, মামলা ও নির্বাসিত জীবনে যেতে হয়েছে। পরের সংগ্রাম সবার জানা। কি কঠিন পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের শক্তিতে একা লড়াই করে কঠিন দুঃসময় পাড়ি দিতে হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতিই হয়নি, সাম্প্রদায়িক শক্তির পুনর্জন্মই হয়নি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম ও তাঁর বর্ণাঢ্য ইতিহাস নিষিদ্ধই করা হয়নি, নৃশংস হত্যাকান্ডের বিচার হবে না বলে কুখ্যাত ইনডেমনিটি বিলও পাস করা হয়েছিল। সংবিধান হয়েছিল ডাকাতি।

বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা নির্বাসিত জীবন থেকে গোটা পরিবারের রক্তে ভেজা মাটিতে দলের সভানেত্রী নির্বাচিত করে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের উত্তরাধিকারিত্বের বাতি জ্বালিয়েছিলেন। পথের লড়াইয়ে নেমে তিনি দলকে সুসংগঠিত করে জনমতকে পক্ষে টেনে সেই দীর্ঘ অন্ধকারের পথ ভেদ করে আলোর যাত্রাপথে বাংলাদেশকে ফিরিয়ে এনেছিলেন। প্রথমবার ক্ষমতায় আসতে আওয়ামী লীগকে ২১ বছর আরেক দফা আত্মদানের সংগ্রাম করতে হয়েছে। পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার পর ২০০১ সালের নির্বাচনে ক্ষমতার বাইরে ছিটকে পড়ায় ফের অবর্ণনীয় কঠিন নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা একুশের গ্রেনেড হামলার মতো ভয়াবহ মৃত্যুফাঁদ থেকে নেতাদের নিয়ে বেঁচে এলেও আইভি রহমানসহ ২২ জনের প্রাণহানি দেখতে হয়েছে। শত শত নেতা-কর্মী পঙ্গু ও আহত হয়েছেন। রক্তে ভেসেছে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ। সেই পাঁচ বছর দেশবরেণ্য ব্যক্তিসহ দলের নেতা-কর্মীকে হত্যাকান্ডের শিকার হতে হয়েছে। ওয়ান-ইলেভেনের ভয়াবহতা বাড়তি দুই বছর মোকাবিলাই করতে হয়নি, শেখ হাসিনাসহ অনেক নেতাকে কারাগারের অন্ধকারে কাটাতে হয়েছে। সেই লড়াইয়ে পিতার মতো অমিত সাহস নিয়ে বিজয়ী শেখ হাসিনা টানা ১১ বছর ধরে দলকে ক্ষমতায় রেখেছেন। দেশকে অর্থনীতিতে দক্ষিণ এশিয়ায় শক্তিশালীই করেননি, প্রবৃদ্ধিতে পশ্চিমাদের কাছেও বিস্ময়কর জায়গায় নিয়েছেন। পার্শ্ববর্তী দেশগুলো নিজেদের পিছিয়ে পড়া এবং বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়া অবলোকন করছে। উন্নয়নের মহাকর্মযজ্ঞের মধ্য দিয়ে দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নই ঘটাননি, অসংখ্য মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের পথে। সারা দেশ বিদ্যুতায়নে এসেছে। সীমান্ত সমস্যার সমাধানই ঘটেনি, সমুদ্র বিজয়ের মধ্য দিয়ে আরেক বাংলাদেশের নবসূর্যোদয় ঘটেছে। জাতির পিতার কন্যার হাত ধরে অর্থনৈতিক মুক্তির পথে হাঁটছে। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্তদের মৃত্যুদ- হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফাঁসি হয়েছে। জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদ দমন হয়েছে। মাদক, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই হচ্ছে। যে আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীনতা সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে সেই মহান নেতার কন্যা শেখ হাসিনার হাত ধরেই জাতির পিতার শততম জন্মবার্ষিকী মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে প্রস্তুতি চলছে।

জাতি মুজিববর্ষের উৎসবের আনন্দে, আমার কেন পিতৃহীন দেশে আনন্দ আসে না? বেদনা অনুভব করি, সেই কালরাতের ঘটে যাওয়া পরবর্তী দিনগুলোর কথা মনে হলে! বঙ্গবন্ধুর জীবন ও দর্শন মানুষ ও দেশের প্রতি মমত্ববোধ উপলব্ধি করে কাজ করার শপথ হোক মুজিববর্ষ। বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু সমার্থক শব্দ। তিনিই এ রাষ্ট্রের মহান আদর্শ। আমার কাছে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের আত্মার নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

পেশাগত কারণে দেশের সমাজ ও রাজনীতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে যাওয়ায় অনেক কিছু যেমন আনন্দ দেয়, তেমনি অনেক ঘটনা অস্থির-অশান্ত-বিচলিতও করে। অনুভূতিপ্রবণ মানুষের জন্য চাইলেই নির্বোধের মতো বসে থাকা যেমন যায় না, তেমনি অসংগতি দেখলে উটপাখির মতো বালির নিচে মুখ গুঁজে দেওয়া যায় না।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বের বিজয়ের পূর্ণতা লাভ করেছিল। এবার সেই দিনটিতে কাউন্টডাউন অনুষ্ঠানটি টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার হওয়ায় আমি অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখেছি! যেভাবে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের লেজার রশ্মির আবির্ভাব দেখানো হয়েছে, সেটি আমাকে আনন্দ দেয়নি। পিতৃহীন প্রিয় স্বদেশে আমি বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যার বেদনার্ত মুখটি বারবার দেখেছি। এত দিন ধরে মুজিববর্ষ উদ্যাপন কমিটির এত এত পেশার, এত এত গুরুত্বপূর্ণ মানুষেরা তাদের সব সৃজনশীলতায় যে আইডিয়ার বাস্তবায়ন ঘটিয়েছেন সেটি আমার কাছে এমন বিশ্বনন্দিত মহানায়ক নিয়ে সৃষ্টিশীল উত্তম কিছু মনে হয়নি। মনে হয়েছে এর চেয়ে বিশাল প্রজেক্টরে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সেই ভিডিও প্রচার করলে আবেগ-অনুভূতি ও হৃদয়কে আরও বেশি আলোড়িত করত।

মুজিববর্ষজুড়ে শুনেছি আয়োজকরা বিশাল বাজেটে অনেক প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আশা করব, গোটা দেশের মানুষের আশা-আকাক্সক্ষাই যেন সততা ও সৃষ্টিতে জবাবদিহিতে আত্মার জোরে পূরণ হয় না, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও দর্শন এবং তাঁর বীরত্বের গৌরব নতুন প্রজন্মসহ দেশের জনগণ এবং অনাগত প্রজন্মের কাছে রেখে যাওয়া যায়, বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরা হয়। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ এখন ১২টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। আড়াই হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ ভাষণগুলোর একটি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। দার্শনিকদের ভাষায়, ‘শেখ মুজিবকে ফ্রান্সের চতুর্দশ শাসক যিনি তাঁর জনগণকে গভীরভাবে ভালো বেসেছেন এবং ৭২ বছর শাসনের পর মৃত্যুকালে বলেছিলেন, “আমি চলে যাচ্ছি কিন্তু রাষ্ট্র টিকে থাকবে”, সেই চতুর্দশ লুইয়ের সঙ্গে তুলনা করা যায়। জনগণ তাঁর কাছে এত প্রিয় ছিল যে, লুইয়ের মতো তিনি এ দাবি করতে পারেন যে, “আমিই রাষ্ট্র”।’ একাত্তরের ৭ মার্চ তাঁর ভাষণের মধ্য দিয়ে জাতির একক নেতা হিসেবে তিনি সেটিও প্রমাণ করে গেছেন। ২৩ মার্চ ক্যান্টনমেন্ট ও গভর্নর  হাউস ছাড়া সবখানে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়েছিল তাঁর নির্দেশে। তাঁর স্বাধীনতা ঘোষণা কার্যত ৭ মার্চ ঘটে যাওয়ায় সেদিন ঢাকায় থাকা পাকিস্তানের নেতারা বলেছিলেন, ক্যান্টনমেন্ট ও গভর্নর হাউস ছাড়া পাকিস্তানের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্বমানবতার শান্তির দূতই ছিলেন না, বিশ্বের স্বাধীনতাকামী মানুষের অনুপ্রেরণার উৎসই ছিলেন না, তিনি ছিলেন বিশ্বের শোষিতের বন্ধু। বিশ্বের দুই সুপার পাওয়ার লড়াইয়ের যুগে তাঁর অসীম সাহস নিয়ে বলেছিলেন, ‘বিশ্ব  আজ দুই শিবিরে বিভক্ত, শোষক আর শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে।’ বাঙালি জাতীয়তাবাদের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বিশ্বের শোষিত মানুষের নেতা। তাঁর এ সারমর্মটুকু বীরত্বের সঙ্গে বিশ্বমানবতার সামনে উপস্থাপন এবং দেশের জনগণের কাছে তাঁর মহান আদর্শ ছড়িয়ে দিয়ে জনগণকে তাঁর গভীর দেশপ্রেম, মানুষের প্রতি ভালোবাসা, মানুষের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, উদার গণতান্ত্রিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং নির্লোভ-নিরাভরণ সাদামাটা জীবনের সততার আদর্শ ও অমিত সাহসের দ্যুতি ছড়িয়ে মানুষকে তাঁর আদর্শে জাগাতে পারলেই মুজিববর্ষের সব আয়োজন সাফল্যের মধ্য দিয়ে ইতিহাসে অমরত্ব পাবে।

বঙ্গবন্ধু পারিবারিকভাবে খোদাভীরু ধর্মপ্রাণ মুসলমান হলেও রাজনীতিতে অসাম্প্রদায়িক। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র দেন। সাম্প্রদায়িক ধর্মের রাজনীতি নিষিদ্ধ করেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। তাঁর এ মহান আদর্শে দেশ-সমাজ-রাজনীতিকে জাগাতে পারলেই মুজিববর্ষ সফল হবে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর কিউবা বিপ্লবের নায়ক ফিদেল কাস্ত্রো বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব এবং সাহসিকতায় তিনিই হিমালয়। শেখ মুজিবের মৃত্যুতে বিশ্বের শোষিত মানুষ হারাল তাদের একজন মহান নেতাকে। আমি হারালাম একজন অকৃত্রিম বিশাল হৃদয়ের মানুষকে।’ স্বাধীনতাসংগ্রামী ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাত বলেছিলেন, ‘আপসহীন সংগ্রামী নেতৃত্ব আর কুসুম কোমল হৃদয় ছিল মুজিব চরিত্রের বৈশিষ্ট্য।’

যে পিতা তাঁর বীরত্বের বিজয়ের মধ্য দিয়ে আমাদেরকে বীরের জাতি হিসেবে অহংকারী করেছিলেন, সেই পিতৃহত্যার মধ্য দিয়ে আমরা বিশ্বাসঘাতক আত্মগ্লানিতে জর্জরিত জাতি হিসেবে অন্তহীন দহনে দগ্ধ হচ্ছি। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নের মাধ্যমে তাঁর ভালোবাসার জনগণের জন্য নিরাপদ, উন্নত, আধুনিক অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক, শোষণমুক্ত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সেই গ্লানি থেকে কেবল মুক্ত হতে পারি।

স্বৈরশাসক কেবল রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় বিরাজ করে না। সমাজ ও ব্যক্তিজীবনে বিরাজ করে। স্বৈরশাসক অন্যের কথা শোনে না। নিজের কর্তৃত্ববাদী আচরণে অন্ধের মতো তাঁর মতবাদকেই প্রতিষ্ঠিত করে। শ্রোতা শুনুক বা না শুনুক, গ্রহণ করুক বা না-ই করুক তাঁর নিজের মতো করে সেটাকেই প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। চাটুকার বাহবা বাহবা করে। মুজিবকন্যার হাত ধরে এত উন্নয়ন ঘটলেও রাজনীতির স্থিতিশীলতা এলেও আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, রক্তে লেখা গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল। শক্তিশালী হয়নি। অসাম্প্রদায়িক আদর্শ ফিরে আসেনি। সমাজে লোভ-লালসা-দুর্নীতি ক্যান্সারের মতো ছড়িয়েছে। বঙ্গবন্ধু রাজনীতিতে নির্লোভ, দেশপ্রেমিক, গণমুখী, আদর্শিক বীরের জন্ম দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর দিনে দিনে সেটি করুণ বিপর্যয়ে পতিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য অনেক বীর ছিটকে পড়েছে। অনেকে থেকেও অবহেলিত জীবন্মৃত অবস্থায়! যে নেতা হওয়ার কথা নয়, রাতারাতি নেতা হয়ে যাচ্ছে। কষ্টার্জিত পরিশ্রমের মূলধন খাটিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বড় শিল্পপতি হওয়ার পথ পরিহার করে রাতারাতি জনগণের টাকা লুট করে পালিয়ে যাচ্ছে, না হয় সমাজে বুক ফুলিয়ে হাঁটছে। রাতারাতি ব্যবসায়ী, নেতা ও রাজনৈতিক ক্ষমতাবান হয়ে যাচ্ছে। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী না হয়ে, মানুষের সেবক না হয়ে হয়ে কর্তৃত্ববাদী শাসক হয়ে যাচ্ছে সরকারি কর্মকর্তাদের কেউ কেউ। সমাজে সর্বত্র অযোগ্য অথর্ব, অদক্ষ অপদার্থ দাসদের ছড়াছড়ি। ব্যক্তিত্ববান দক্ষ আদর্শবানদের নির্বাসিত করে দলকানাদের উল্লাস চলছে। কমবেশি সব পেশায় নষ্টরা কর্তৃত্ব করছে।

বিশ্ববিখ্যাত গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস শাসকের রায়ে হেমলক পান করে বিদায় নিয়েছেন। সত্য থেকে নড়ে যাননি। তাঁর ছাত্র ছিলেন প্লেটো। আর প্লেটোর ছাত্র ছিলেন দার্শনিক অ্যারিস্টটল। প্রাচীন গ্রিসের এ তিন দার্শনিক পশ্চিমা দর্শনের ভিত রচনা করে গেছেন। প্লেটো বলেছেন, ‘রাজনীতিতে অংশগ্রহণের অনীহার অন্যতম শাস্তি হচ্ছে নিকৃষ্টদের দ্বারা শাসিত হওয়া।’ সমাজের সার্বিক অবস্থা বিচার করলে সেই অনুভূতি পাওয়া যায়। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল একসময় দেশের দার্শনিক ও চিন্তাশীল শিক্ষকদের আঁতুড়ঘর। গণতান্ত্রিক রাজনীতির তীর্থস্থান, সেকেন্ড পার্লামেন্ট। সেই বিশ্ববিদ্যালয় এখন চিন্তাশীল জ্ঞানের প্রতীক, দার্শনিক খুঁজে পাওয়া যায় না। তেমনি ছাত্র রাজনীতির করুণ রুগ্নদশা দৃশ্যমান। ক্যাম্পাস মৃত। শিক্ষাঙ্গনসহ অসংখ্য প্রতিষ্ঠানে আজ্ঞাবহ দলকানাদের বসাতে গিয়ে এ অবস্থা। বোধহীন সমাজ তা শোনেই না। রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ যতগুলো সমাবর্তনে যাচ্ছেন, সেখানে তরুণ ছাত্রছাত্রীদের আকৃষ্ট করে রাজনীতি, শিক্ষাঙ্গন ও সমাজের অসংগতির চিত্রপট তুলে ধরে আলোর পথে জেগে ওঠার বার্তা দিচ্ছেন। কতটুকু কার্যকর হচ্ছে জানি না। একদিকে তিনি বলছেন, আরেকদিকে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা আকুতি জানাচ্ছেন। এর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ছাত্রীটি কুর্মিটোলায় ধর্ষিতা হয়েছেন, তার যন্ত্রণা তাকে আমৃত্যু বহন করতে হবে। সমাজের বিবেকবান অনুভূতিপ্রবণ মানুষের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ থামতে না থামতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামান বিস্মিত, ক্ষুব্ধ, ব্যথিত ও হতাশ করেছেন। তার বক্তব্যে বলেছেন, ধর্ষিতা ছাত্রীর সঙ্গে তার কথা হয়েছে। তার পাশবিক ধর্ষণের অভিজ্ঞতা হয়েছে। পাশবিক ধর্ষণের অভিজ্ঞতা জানেন ঢাবির ভিসি? কোন মূর্খের সমাজে বাস? একাত্তরে আমাদের মা-বোনদের ওপর পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর ধর্ষণের ভয়াবহতার ক্ষত জাতির হৃদয় থেকে এখনো শুকিয়ে যায়নি। সেখানে দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উপাচার্য যখন এমন কথা বলেন সেটিও সহ্য করতে হয়! এর আগেও তিনি তার বক্তব্য এবং কর্মকান্ডে বিদ্রুপ ও উপহাসের পাত্রে পরিণত হয়েছেন। কিন্তু এবার মানুষের হৃদয়কে আঘাত করে প্রমাণ করেছেন সবখানে অযোগ্যরা কীভাবে কর্তৃত্ব করে যাচ্ছে। যে মন্ত্রী হওয়ার কথা নয়, সে মন্ত্রী হচ্ছে। যে এমপি হওয়ার কথা নয়, সে এমপি হচ্ছে। যে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে, দলে যে পদ পাওয়ার কথা নয়, সে তা পাচ্ছে! সমাজের রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বের মুখে নিকৃষ্টদের  উল্লাসে উৎকৃষ্টরা যেমন সৃষ্টি হচ্ছে না, তেমনি রাজনীতি থেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। দেশে সুশাসনের অভাব ভীষণভাবে নাড়া দিচ্ছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, নির্বাচনী ব্যবস্থা এবং সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নিয়েই প্রশ্ন উঠছে না; মূল্যবোধহীন, আদর্শহীন অবক্ষয়ের মুখোমুখি দেশ ও সমাজ। ১০ বছর আগে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারম্যান হয়ে অধ্যাপক খায়রুল হোসেইন বলেছিলেন, পুঁজিবাজার তিন মাসেই স্থিতিশীল করবেন। মূলধন থেকে ৪৭ হাজার কোটি টাকা লুট হয়ে গেছে। শেয়ারবাজারে যেন অন্ধকার কবরের নিস্তব্ধতা। সরকার ও প্রশাসন উদাসীন নির্বিকার। ডিএসই থেকে ব্রোকার অ্যাসোসিয়েশনের নেতৃত্ব চরম ব্যর্থ। অর্থমন্ত্রী বিশ্বসেরা খেতাবে সংবর্ধনা নিচ্ছেন। শেয়ারবাজারকে জীবিত করার কোনো উদ্যোগ নেই! কারা লুট করেছেন? তাদের বিচার না হলে কোনো দিন জাগবে? ব্যাংক লুটেরা, শেয়ার লুটেরা, বিদেশে অর্থ পাচারকারীদের গ্রেফতার করে বিচার হয় না। দুর্নীতির বরমাল্য নিয়ে দাপটে হাটে যখন তারা তখন জনমনে প্রশ্ন- সম্রাটদের দুর্নীতির অভিযানে আটক কি তবে আইওয়াশ? মুজিববর্ষে ও স্বাধীনতার ৫০ বছরের দোরগোড়ায় বঙ্গবন্ধুর মহান আদর্শে দেশকে সুশাসনে আলোর জগতে ফিরিয়ে আনার লড়াইয়ে বিজয় না ঘটাতে পারলে সবকিছু অর্থহীন হয়ে যাবে।

সারা দেশে যাত্রাপালা, কবিয়াল লড়াই, পালাগান বন্ধ হয়ে গেছে। যে অসাম্প্রদায়িক পরিবেশে বেড়ে উঠেছি, সেখানে ভোরের আলোয় ঘুম ভেঙেছে মা-বাবার কোরআন তিলাওয়াতের শব্দে। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা স্পর্শ করেনি। ধর্মান্ধতার বিষাক্ত বাতাস সমাজজীবনে বিদ্বেষ ছড়ায়নি। এখন যাত্রাপালা, কবিয়াল লড়াই, পুঁথির আসর নির্বাসনে গেছে। ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য উপেক্ষা করে নাচ-গানে সারা দেশে ওয়াজ মাহফিল হচ্ছে। হিন্দি, বাংলা গানে গানে একদল বক্তা ওয়াজ করছেন। একপক্ষ আরেক পক্ষকে গালাগাল করছে। ইউটিউব খুললেই দেখা যায়, একেকজনের দর্শক ১০ লাখের ওপরে! এর মধ্যে মিসরের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া করে আসা মিজানুর রহমান নামের এক তরুণ তার নামের সঙ্গে আজহারী যুক্ত করে একেকটি ওয়াজ মাহফিলে যাচ্ছেন। লাখো মানুষের ঢল নামছে। ইংরেজি, বাংলা, আরবিতে বাগ্মিতায় ফ্যাশনদুরস্ত, স্মার্ট এ বক্তা রাতের পর রাত মানুষকে সম্মোহন করে রাখছেন। নাস্তিকতার নামে আল্লাহ-রসুলের সমালোচনা করে মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা যেমন বিকৃত রুচিই নয়, সমাজের স্থিতিশীলতা নষ্টে অপরাধ, তেমনি ধর্মের বাণী ছড়ানো সব ধর্মের মানুষের অধিকার। কিন্তু ধর্মের নামে সমাজে ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানো বা অন্য ধর্মের মানুষকে আঘাত করা, ধর্মকে রাজনীতিতে এনে মতলব হাসিল সুমহান মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত আদর্শিক বাংলাদেশের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। মিজানুর রহমান আজহারী বুদ্ধিদীপ্ত কথার চাতুর্যে ক্রিকেটের বিস্ময়কর কৃতিত্বের কথাও বলেন, কিন্তু যখন মানবতাবিরোধী অপরাধে আজীবন কারাদন্ডে দন্ডিত সাঈদীকে ওপরে তুলে ধরেন, তার জন্য ওয়াজ মাহফিলে আগত মুসল্লিদের রক্ত গরম করেন, তখন বড় সন্দেহ হয়। যখন সাঈদীকে সিংহ আর নিজেদের সিংহের বাচ্চা বলেন, তখন ভয়ে আঁতকে উঠি। সন্দেহ জাগে এ জামায়াতের নতুন মডেল নয় তো?

পেশাজীবীসহ সবাই দুই দলের দাসত্ব বরণ করে যখন অন্ধের সমাজ তৈরি করছেন তখন, সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বললে কত নোংরা আক্রমণের শিকার হতে হয়। জানি, আক্রমণ হয়েছে, হচ্ছে, হবে। কিন্তু সত্য বলবই। দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীও জামায়াতে যোগ দেওয়ার আগে কোরআনের তাফসির করতে গিয়ে ওয়াজ মাহফিলে ঢল নামাতেন। পরবর্তীতে তার লক্ষ্য ও চূড়ান্ত পরিণতি দৃশ্যমান হয়েছে। আজহারীকে নিয়ে কৌতূহল থেকে প্রশ্ন তুলে স্ট্যাটাস দেওয়ায় দেশ-বিদেশে থাকা জামায়াত-শিবিরের সাইবার গ্রুপ তুমুল আক্রমণ করে বসে। এতে সন্দেহ আরও বাড়ে। গরিব শরিয়ত বয়াতিকে পুলিশ গ্রেফতার করে নিয়ে আসে। অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদী খেয়ে না খেয়ে থাকা গরিব শান্তিপ্রিয় মানুষকে আটক করা হয়। অথচ ধর্মান্ধ রাজনীতির নিষ্ঠুর শক্তিকে নিয়ে শাসকদলের নেতারা ওয়াজ করেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা মিজানুর রহমান আজহারীর শক্তির উৎস, নেটওয়ার্ক, মূল্যবান ফ্যাশনেবল কাপড়-চোপড়, হেলিকপ্টারে করে ওয়াজে যাওয়ার ব্যয় কারা জোগাচ্ছে এবং তার একেকটি ওয়াজে কত আয় হচ্ছে, তার ট্যাক্স কতটা দেওয়া হচ্ছে, সে সম্পর্কে কতটা খোঁজ নিচ্ছেন এ নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।

মিসরের হাসান আল বান্না সে দেশের ব্রাদারহুড দলের  প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। ইসলামী বিপ্লব ঘটাতে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। হিটলার ও তার নাৎসি বাহিনীর সঙ্গে সম্পর্ক করে হিটলারের মাইন্ড ক্যাম্প অনুবাদ করে ‘আমার জিহাদ’ নামে বই ছড়িয়েছিলেন। কামাল আতাতুর্ক তুরস্কের স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে একটি ধর্মনিরপেক্ষ জাতি-রাষ্ট্র গঠনে ধর্মান্ধ উগ্রপন্থিদের কঠোর হস্তে দমন করলেও তার তুরস্ক এ দেশের জামায়াতের মতোই রাজনীতির পথ ধরে এরদোগানের নেতৃত্বে ক্ষমতায় এসেছে। সমাজতন্ত্র যেমন কমিউনিস্টদের বিপ্লবের একটি আদর্শ, তেমনি ধর্মের ওপর ইসলামী বিপ্লবও ধর্মীয় উগ্রপন্থিদের কাছে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার একটি আদর্শ। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে দুটিই চ্যালেঞ্জ করে। এ দেশে সমাজতন্ত্রের বিপ্লবে কমিউনিস্টরা যেমন ব্যর্থ এবং নিঃস্ব, সেখানে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসর যুদ্ধাপরাধী জামায়াত অনেক দূর অগ্রসর হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে গণতন্ত্রই উত্তম শাসন। লাখো মানুষের রক্তে ও জাতির মহান নেতার সারা জীবনের সংগ্রামের এ আকুতি।

 

লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।

সর্বশেষ খবর