শনিবার, ২৪ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা

ডিজিটাল বাংলাদেশে অটো পাস!

ড. আ ন ম এহছানুল হক মিলন

ডিজিটাল বাংলাদেশে অটো পাস!

‘অটো পাস’ শ্ব্দটির সঙ্গে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের পরিচয় হয় স্বাধীনতার উষালগ্নে। ১৯৭১ সালে দীর্ঘ নয় মাসের মহান মুক্তিযুদ্ধে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীন হয় বাংলাদেশ। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় সংযুক্ত হয় অটো পাস প্রথা। তবে পাবলিক পরীক্ষায় নয়, অর্থাৎ এসএসসি, এইচএসসি, ডিগ্রি, মাস্টার্স পরীক্ষায় মেধা মূল্যায়ন হয় স্বল্প সিলেবাসে। মূলত শিক্ষাব্যবস্থার ধ্বংস শুরু হয় অটো পাস ও সংক্ষিপ্ত পাঠ্যক্রম দিয়ে। তারই ধারাবাহিকতায় সৃজনশীলতা পরিহার করে গাইড বই, নোট বই ব্যবহার করে জন্ম নেয় অভিশ্প্ত ‘নকল’। মুক্তিযুদ্ধের সময়ের পাবলিক পরীক্ষাগুলো অনুষ্ঠিত হয় পরবর্তী বছর অর্থাৎ ’৭২ সালে। একই বছর দুবার সমাপনী পরীক্ষা নেওয়া হয়। তখন শিক্ষাবিদরা বুঝে উঠতে পারেননি কোনো না কোনো সময় এসে সেশ্নজট বাঁধবেই। দেখা গেছে, ঢাকা বিশ্বিদ্যালয়ে ১৯৭৫ ও ’৭৬ সালে এইচএসসি পাস শিক্ষার্থীদের একই সেশ্নে ভর্তি হতে হয়েছিল। তার পরও শিক্ষার ‘গ্রিডলক’ খোলেনি আশির দশ্ক পর্যন্ত। সে শিক্ষা থেকেও নীতিনির্ধারকরা শিক্ষা নিতে পারেননি। মুক্তিযুদ্ধের কারণে তখনকার শিক্ষায় জট লাগার বিষয়টি শুধু বংলাদেশের জন্যই ছিল।

বিশ্ব্যাপী শিক্ষাব্যবস্থায় কভিড-১৯ কোনো দেশ্কেই ছাড় দেয়নি। সে ক্ষেত্রে শিক্ষার হাব দেশ্গুলো যেমন ভারত, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, গ্রেড ব্রিটেন, কানাডা বা আমেরিকাকে লিড হিসেবে আর আমরা বাংলাদেশ লগ হিসেবে (খবধফ ষড়ম) অর্থাৎ তাদের শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন অনুসরণ করা যেতে পারত। কিন্তু আজকের বাস্তবতায় উন্নত বিশ্বের কোথাও অটো পাস দেওয়া হয়নি। এমন কোনো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স) ব্যারোমিটার নেই যা দ্বারা মেধার পরিমাপ করা সম্ভব। সে ক্ষেত্রে পরীক্ষাহীন মেধাকে মূল্যায়িত করে এইচএসসির সার্টিফিকেট দেওয়া হবে জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলের ওপর নির্ভর করে। বিগত তিন বছরের জেএসসি ও এসএসসি ফলনির্ভর গাণিতিক পরিসংখ্যানের নমুনা হতে পারে নিম্নরূপ-

সম্ভাব্য টাইম সিরিজ ফোরকাস্টিং ম্যাথডের ভিত্তিতে দেখা যায়, এ বছর সম্ভাব্য পাসের হার হতো ৮১.২২% ও সম্ভাব্য জিপিএ-৫-এর সংখ্যা হতো ৬৫,৩১০। প্রশ্ন হচ্ছে, কোন পদ্ধতিতে নির্ধারিত হবে, জেএসসি ২০১৫ সালে জিপিএ-৫ প্রাপ্ত ১,৮৭,৫০২ ও এসএসসি ২০১৮ সালে জিপিএ-৫ প্রাপ্ত ১,১০,৬২৯ জন শিক্ষার্থী, যারা ২০২০ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ আশা করছে। অন্যদিকে অনেক শিক্ষার্থী জেএসসির পরীক্ষাকে গুরুত্বহীন ভেবেছিল কিংবা জিপিএ-৫ পায়নি। অনেকেই এসএসসি পরীক্ষাকে গুরুত্ব দিয়েছে এবং জিপিএ-৫ পেয়েছে, এরই মধ্যে ২০১৯ সালের অনেক শিক্ষার্থীই মানোন্নয়ন পরীক্ষা দেবে। তা ছাড়া যারা এসএসসিতে জিপিএ-৫ পায়নি, তারা এবার মরিয়া হয়ে প্রস্তুতি নিয়েছে উচ্চশিক্ষায় ভালো করার জন্য অর্থাৎ এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পাওয়ার জন্য। জিপিএ-৫-এর সংখ্যাতত্ত্ব গাণিতিকভাবে বের করা সম্ভব হলেও মূলত কারা জিপিএ-৫ পাবে, সে নাম বের করা হবে কোন পদ্ধতিতে? তাহলে সার্বিক মূল্যায়ন কোন জাদুর কাঠি দিয়ে করা হবে, সে প্রশ্নটি রয়েই গেল। অন্যদিকে প্রশ্ন হচ্ছে, বঞ্চিত পরীক্ষার্থীদের ফলাফল চ্যালেঞ্জ করার কোনো সুযোগ বিবেচনা করা হবে (রাইটস টু আপিল) কিনা? সে বোধ থেকেই বিশ্বের কোনো দেশই অটো পাস দেয়নি। অটো পাস ইজ নট দ্য বেস্ট সলিউশ্ন।

এদিকে, ঢাকা বিশ্বিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় উচ্চমাধ্যমিক ও মাধ্যমিকের ২০% এবং লিখিত ৫০% ও বহুনির্বাচনী পরীক্ষার ৩০%-এর ওপর ভিত্তি করে মূল্যায়ন করা হবে বলে ঘোষণা করেছে। তাহলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে লিখিত পরীক্ষার সম্মুখীন শিক্ষার্থীদের হতেই হবে। সারা দেশে করোনার সময় প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিশ্বিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষকম-লী ছুটিতে ছিলেন ও শ্রেণিকক্ষগুলো অব্যবহৃত ছিল। সে ক্ষেত্রে উপকেন্দ্র বাড়িয়ে দেশ্ব্যাপী এইচএসসি পরীক্ষা নিতে বাধা কোথায়? অটো পাসের কারণে জাতি বহুদিন খেসারত দিয়েছে, আবারও অটো পাস দিয়ে অতীত ভুলের পুনরাবৃত্তি করে জাতিকে মেধাশূন্যতার গহিন গহ্বরে নিপতিত করছে কোন স্বার্থে?

ইতিমধ্যে বিশ স্বাস্থ্য সংস্থার আগাম বাণীতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের কথা বলা হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষাব্যবস্থা প্রস্তুতি তেমন একটা সরব হয়ে ওঠেনি। অন্যদিকে পরিপূর্ণভাবে আমেরিকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো অনলাইন শিক্ষা পদ্ধতি গ্রহণের কারণে পাশের ভারতের প্রায় দেড় লাখ শিক্ষার্থী আমেরিকার নামিদামি বিশ্বিদ্যালয়গুলোয় অনলাইনে ভর্তি হয়েছে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ দেরিতে হলেও বুঝতে পেরেছে অনলাইন শিক্ষার বিকল্প নেই। এজন্য প্রায় সব প্রতিষ্ঠান অনলাইনে লেখাপড়া চালুর চেষ্টা করছে। প্রসঙ্গত, অনেক সিনিয়র শিক্ষক মানসিকভাবে অনলাইন শিক্ষায় অনভ্যস্ত হওয়ায় অনলাইন ফোবিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। সে ক্ষেত্রেও সরকারের অনলাইন শিক্ষক ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা নিতে হবে।

বাংলাদেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রতি বছর প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত এনসিটিবি কর্তৃক প্রায় সাড়ে এগারো শ কোটি টাকার বই বিনামূল্যে বিতরণ করে। যদি বর্তমান সরকার অনলাইন শিক্ষা প্রাধান্য দিয়ে বইয়ের পরিবর্তে ট্যাব আকারে ই-বুক বিতরণ করে তবে আগামী দিনে ব্যয় অনেকাংশে সাশ্রয় হবে। কারণ, পাঠ্যপুস্তক পরবর্তী বছরে ব্যবহারযোগ্য নয় বলে পুনরায় প্রিন্ট করতে হয়। অথচ ট্যাব পরবর্তী বছরের শিক্ষার্থীদের জন্য সরবরাহ করা যেতে পারে। ই-বুক, ই-লাইব্রেরি, বাংলাদেশ বেতারের দ্বিতীয় চ্যানেলটি, যা সংসদের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে, তার উপযুক্ত ব্যবহারের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর জন্য ইন্টারনেট প্রোভাইডারদের স্বল্পমূল্যে সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে। বিশ্বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের তাদের পরিচয় কোডের মাধ্যমে ইন্টারনেট দিতে হবে। সব লাইব্রেরির বইকে ই-লাইব্রেরিতে কনভার্ট করতে হবে।

বিশ্বায়নের যুগে শিক্ষাকে ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, ভারত ও মালয়েশিয়া বাণিজ্যিকায়ন করেছে, সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ মোটেই পিছিয়ে থাকার কোনো কারণ নেই। অনলাইন এডুকেশ্ন বিশ্সমাদ্রিত, তাই বলে ক্লাসরুমের প্রয়োজন নেই- এমনটিও নয়, উভয়ের সমন্বয়ে শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালিত হচ্ছে পৃথিবীময়। বাংলাদেশ সে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য ইতিমধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশের স্লোগানে উদ্বেলিত। কালক্ষেপণ না করে সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতেই হবে- করোনার বাস্তবতা মেনে নিয়ে উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষাব্যবস্থাকে চালিয়ে যাওয়া।

 

 লেখক : সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ও চেয়ারম্যান, ইআরআই

[email protected]

সর্বশেষ খবর