বারবার কেন এমন হচ্ছে বুঝতে পারছি না। যতই আমরা ভুলতে চাচ্ছি ভুলতে পারছি না। নতুন নতুন ঘটনা ভুলতে দিচ্ছে না। যতই ভাবছি প্রতিবেশী বা ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ভাষায় ‘নেইবার ফার্স্ট’ ততই যেন মনে হচ্ছে ‘নেইবার লাস্ট’। ফেলানীর মৃত্যুর ঘটনাই আজও আমরা ভুলতে পারিনি, ভোলার মতো নয়ও। সীমান্ত হত্যা প্রসঙ্গ এলেই না চাইতেও উঠে আসে ফেলানীর নাম। ফেলানীর সেই কাঁটাতারে আটকে থাকা ঝুলন্ত দেহ সভ্যতাকে ভেংচি কাটে। সিনেমার রিলের মতো চোখের সামনে দিয়ে ভেসে যায় একের পর এক দৃশ্যাবলি। ফেলানী খাতুন সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা ঝুলে ছিল কাঁটাতারে। ভাবলেও শিউরে উঠি! ফেলানীর বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। বিয়ের জন্য বাবার সঙ্গে ফিরছিল সে। কাঁটাতারে আটকে গিয়েছিল তার কাপড়। ভয় পেয়ে চিৎকার করেছিল বাঁচার জন্য। সে চিৎকার তাকে বাঁচতে দেয়নি। ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিয়েছিল।
ফেলানীর ঝুলন্ত লাশ বিশ্ববিবেককে নাড়িয়ে দিয়েছিল। সোচ্চার হয়েছিল গোটা বিশ্ব। বিচার চাওয়া হয়েছিল হত্যাকারীদের। লাভ হয়নি। বিচারে খালাস দেওয়া হয়েছিল হত্যাকারীদের। ফেলানীর মা আজও কেঁদে বুক ভাসিয়ে বলেন, ‘মেয়েটার হত্যার বিচার পেলাম না। সীমান্তে যেন একটা পাখিও হত্যা করা না হয়।’
স্বর্ণা দাস কিন্তু কাঁটাতার অবধি যায়নি। সে আর তার মা সীমান্তের কাছাকাছি একটা পুকুরের পাশে গিয়ে বিএসএফ দেখে ভয় পেয়েছিল। মাফ চেয়েছিল বারবার। কিন্তু ওরা মাফ করেনি। গুলি করেছিল। গুলি লেগেছিল স্বর্ণার গায়ে। ওর মা মেয়েকে বাঁচানোর জন্য খানিকটা টেনে এনেছিল। তারপর মৃতপ্রায় মেয়ে বাস্তবতা বুঝে মাকে বলেছিল, ‘আমাকে ধরে থেক না। নিজের জীবন বাঁচাও’। ভেবে দেখুন একবার তখন সেই মায়ের অবস্থা! মেয়ে মারা যাচ্ছে, পেছনে ধাওয়া করছে গুলি, কী করে কোনো প্রাণে মা সেই মেয়েকে ফেলে চলে এসেছিল! আহা এ কেমন জীবন!
ফেলানী বা স্বর্ণা কিন্তু চোরাকারবারি না, নিতান্তই কিশোরী। সীমান্তের কাছাকাছি বাড়ি এদের। নানান কারণেই যেতে হয় সীমান্তের কাছাকাছি। অবুঝ এরা! এত নিয়ম-কানুন বোঝে না, হয়তো একটু বেশি কাছেই গিয়েছে। তাই বলে এফোঁড়-ওফোঁড় করে গুলি! আর যদি চোরাচালানের কথাই বলা হয়, চোরাচালান কি এক পক্ষে হয়। দুটো পক্ষ থাকে। মাঝখানে মধ্যস্বত্বভোগীও থাকে। গরু চোরাচালানের কথাই ধরি। ভারতের হরিয়ানা থেকে আসে গরু। অনেক অনেক দূরত্ব পার হয়ে তবেই সীমান্ত অবধি আসে। এই দীর্ঘ পথে গরুগুলোকে কেন আটকানো হয় না? কেউ না কেউ তো গরুগুলো নিয়ে আসে। তাদের ধরা হয় না কেন? সীমান্তে এসে লেনদেন ঠিকঠাক হলে সব উতরে যায়। সেটা না হলেই বিপত্তি। বাজার অর্থনীতি বলে উভয় পক্ষের লাভের ভিত্তিতেই চোরাচালান হয়। দুঃখ হচ্ছে মারা পড়ে বাংলাদেশিরা।
নয়াদিল্লি, ঢাকা এবং সিলেটে অনুষ্ঠিত একাধিক সীমান্ত সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের তরফ থেকে বারবার বলা হয়েছে সীমান্ত হত্যা বিষয়ে। সে প্রতিনিধি দলে একাধিকবার আমিও ছিলাম। বিএসএফের মহাপরিচালক ও ভারতীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের পক্ষ থেকে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখার প্রতিশ্রুতি দিলেও আজ অবধি সমস্যার সমাধান হয়নি। আরও একটা ব্যাপারে অবাক লাগছে। বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক দেশ হিসেবে প্রমাণ করার জন্য দেশের একটা মহল বড়ই তৎপর! ভারতের একজন বিধায়ক মসজিদে ঢুকে মুসলিম হত্যা করার সদর্প ঘোষণা দিলেন, আমার সেই ভাইয়েরা টুঁশব্দ করলেন না। কিন্তু বাংলাদেশে কোনো কিছু ঘটার আগেই তারা তৎপর হয়ে ওঠেন। এই তৎপরতার পেছনে শুধু আমার দেশিরা না, ভারতের কিছু মানুষও ধুয়ো দেয়। তারা নানারকম কথা বলে, প্রচার-প্রচারণা চালায়, ভিডিও করে। অথচ এদের কখনই বাংলাদেশিদের সম্প্রীতির চিত্রটা চোখে পড়ে না। মুসলিমরা মন্দির পাহারা দিলে এরা নিশ্চুপ থাকেন। হিন্দুপাড়া পাহারা দিলে মুখে কুলুপ এঁটে থাকেন। এদের কেউ কেউ এমনকি আমেরিকায় গিয়ে নালিশ করে আসেন। আমি বলছি না, এ দেশে হিন্দু নির্যাতনের ঘটনা একেবারেই ঘটে না। ঘটে আর সেগুলোর আমি নিন্দা জানাই। সম্প্রতি উৎসব মন্ডলের সঙ্গে যে ঘটনা ঘটেছে সেটাও নিন্দনীয়। বিচারবহির্ভূত কোনো হত্যা বা নির্যাতন গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু উৎসব মন্ডলই বা কেন বারবার ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে লিখছিলেন। তিনি তো থানায় নিজ মুখে সে কথা স্বীকার করেছেন। এটাও তো ঠিক না। উৎসবকে নাকি তার ধর্ম নিয়ে বলা হয়েছিল। খুব অন্যায় কথা। উৎসব প্রতিবাদ করে কিছু লিখলেই হতো। একেবারে মহানবীকে তার পিতা-মাতাসহ টেনে আনার দরকার ছিল না। সে তো একটা বাচ্চা ছেলে। এই বয়সে এতটা ধর্মান্ধ হওয়ার কী আছে! তাকে যারা বলেছে এ কথাটা তাদের জন্যও।
অবাক হয়ে দেখছি যারা সংখ্যালঘু সংখ্যালঘু বলে সারাক্ষণ চিৎকার করেন তারা এখন চুপ করে আছেন। যে কোনো অজুহাত পেলেই যারা আন্দোলন করেন এখন কেন তাদের মুখে কুলুপ আঁটা! স্বর্ণার পর মারা গেছেন শ্রী জয়ন্ত লাহিড়ী। জয়ন্তর লাশ বিএসএফ নিয়ে গিয়েছিল। মৃত সন্তানের লাশটা পাবেন কি না এ নিয়ে অনিশ্চয়তায় ছিল তার পরিবার। শেষবারের মতো তার মুখ দেখতে পাবেন কি না সে সংশয় ছিল। তিন দিন পর ফ্লাগ মিটিংয়ের মাধ্যমে লাশ হস্তান্তর হয়েছে। এরপরও কিন্তু বাংলাদেশে কোনো জোরালো আওয়াজ নেই বা শাহবাগ কিংবা অন্যত্র কোনো আন্দোলন নেই। এমনও নয় যে, কোনো একটা নির্দিষ্ট সীমান্তে ঘটনাগুলো ঘটছে। ঘটছে ভারত-বাংলাদেশের একাধিক সীমান্তে। আর এ ধরনের বেশির ভাগ হত্যাকান্ডের শিকার কিশোর-কিশোরী। কেন তাদেরই টার্গেট করে হত্যা করা হচ্ছে সেটাও একটা প্রশ্ন। কিশোর-কিশোরী ছাড়াও বিভিন্ন বয়সি মানুষ হত্যা করা হচ্ছে। তবে কিশোর-কিশোরীর সংখ্যা বেশি। ফেলানী ধর্মে মুসলিম ছিল কিন্তু স্বর্ণা ও জয়ন্ত হিন্দু। একশ্রেণি এদের সংখ্যালঘু বলে সুবিধা নিতে ভালোবাসেন। আমরা কাউকে সংখ্যালঘু মনে করি না। সবাই এ দেশের নাগরিক, বাংলাদেশি। আমাদের ভাইবোন। ভাইবোন হত্যার বিচার সবাই চায়। আমিও চাই। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে লেখা হয়েছে। বলা হয়েছে, এ ধরনের ঘটনা অনাকাক্সিক্ষত এবং অযৌক্তিক। দুই দেশের সীমান্ত কর্তৃপক্ষের জন্য ভারত বাংলাদেশ যৌথ নির্দেশিকা ১৯৭৫ সালের বিধানের লঙ্ঘন। এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে আর না হয় এবং সীমান্তে ঘটা হত্যাগুলোর তদন্ত করে দোষী ব্যক্তিদের শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানিয়েছে সরকার।
২০১১ সালে ফেলানীকে হত্যা করা হয়েছিল। ২০১১ থেকে ২০২৪, ১৩ বছর কেটে গেছে। পরিস্থিতি কিন্তু একই থেকে গেছে। বরং আরও খারাপ হয়েছে বলা চলে। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী- ২০২৩ সালে ৩১ জন বাংলাদেশি সীমান্তে বিএসএফের গুলি বা নির্যাতনে নিহত হয়েছেন। ২০২১ ও ২০২২ সালে এই সংখ্যা ছিল ১৮ ও ২৩। আসকের হিসাবে এর আগে ২০০৯ থেকে ২০২০ সাল এই ১১ বছরে ৫২২ জন বাংলাদেশি বিএসএফের গুলিতে মারা গেছেন (সীমান্ত হত্যা কমেনি করোনাকালেও, প্রথম আলো, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২০)।
সীমান্ত হত্যার প্রসঙ্গ উঠলেই বিএসএফ ‘আত্মরক্ষার জন্য’ বা ‘বাধ্য হয়ে’ এ ধরনের অজুহাত দিয়ে থাকে। কিন্তু এ অজুহাত একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। ফেলানী, স্বর্ণা বা জয়ন্তর মৃত্যুর কথা ভাবলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায়। এই কিশোর-কিশোরীরা বিএসএফের মতো বন্দুকধারীদের জন্য কী ধরনের হুমকি ছিল যে কারণে তাদের আত্মরক্ষার জন্য বা বাধ্য হয়ে গুলি করতে হয়েছে! কথাটা হাস্যকর নয় কি?
সত্যি কথা বলতে কি পৃথিবীর কোনো সীমান্ত বোধহয় ভারতের সঙ্গে আমাদের সীমান্তগুলোর মতো এতটা অনিরাপদ নয়। আরও একটা বিষয় দেখার, এখানে বিএসএফই গুলি করে, বিজিবি নয়। এরা যদি ধৈর্য আর সহ্যের পরিচয় দিতে পারে, ওরা পারে না কেন?
অন্যায়ভাবে সীমান্ত অতিক্রম করার কোনো ঘটনা ঘটলে তাকে/তাদের ধরে বিচারের আওতায় আনলেই তো হয়। তারপর আইন অনুযায়ী যে সাজা পাওয়ার কথা সেটাই পাবে। কিন্তু সেদিকে না গিয়ে সরাসরি গুলি করতেই ভালোবাসে বিএসএফ। ভারতীয় পেনাল কোড বা অন্য কোনো আইনও কিন্তু সীমান্ত হত্যা সমর্থন করে না। তারপরও হত্যা চলছে কখনো কুলাউড়া, কখনো কুড়িগ্রাম, কখনো চাঁপাইনবাবগঞ্জ আবার কখনো ঠাকুরগাঁও সীমান্তে। হত্যা চলছে একতরফাভাবে। কিন্তু অবাক ব্যাপার বিচ্ছিন্নভাবে গোলাগুলি বা যুদ্ধাবস্থা থাকলেও পাকিস্তান ও চীনের সঙ্গে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনী এমন আগ্রাসি আচরণ করে না, একতরফাভাবে তো নয়ই। তাহলে প্রতিবেশী বাংলাদেশিদের সঙ্গে এমন আচরণ কেন, তারা বেশি ভদ্র আর অমায়িক বলে কী!
একটা কথা প্রচলিত আছে, শক্তের ভক্ত নরমের যম। আমরা বোধহয় বেশি নরম হয়ে পড়েছিলাম। ঘটনা ঘটার পর প্রতিকার না হলে আর সেটা মেনে নিলে ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতেই থাকে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সেটাই ঘটেছে। কিন্তু এ অন্যায় আর মেনে নেওয়া যায় না। আমরা প্রতিবেশীর সঙ্গে বন্ধুত্ব চাই। কিন্তু অবশ্যই সেটা আমাদের স্বার্থের পরিপন্থি হলে নয়। হত্যার মতো বিষয়ে তো নয়ই। দেশে এখন অন্তর্বর্তী সরকার। সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা, সীমান্তে মানুষ হত্যা বন্ধ হোক। সেজন্য যে যে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া দরকার নিন!
লেখক : কথাশিল্পী, গবেষক