প্রাকৃতিক অনাবিল সৌন্দর্যের আধারে নির্মিত দেশের প্রথম ও একমাত্র রাঙামাটির ডিসি বাংলো জাদুঘর। সবুজ অরণ্য নৈসর্গিক আবেশ আর দর্শনীয় স্থান হিসেবে ডিসি বাংলো এলাকা যেমন পর্যটকদের মনজয় করেছে। তেমনি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে নতুন প্রজন্মে জন্য পার্বত্যাঞ্চলে প্রাচীন ইতিহাসের অনেক স্মৃতি চিহ্ন ও সংস্কৃতি সংরক্ষিত ডিসি বাংলো জাদুঘর। রাঙামাটির নানিয়ারচরের বুড়িঘাটের বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ল্যান্স নায়েক মুন্সি আব্দুর রউফের স্মৃতিসেৌধের আলোচিত্র ও জেলা প্রশাসক এল এইচ নিবলেটের স্মৃতিস্তম্ভসহ ঐতিহ্যময় সংস্কৃতি সংরক্ষিত নিদর্শনগুলো স্থান পেয়েছে এ ডিসি বাংলো জাদুঘরে।
পাহাড়ের বুকে লুকিয়ে থাকা অজানা সব ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে ২০১২ সালের ২৬ মার্চ দেশের প্রথম এবং একমাত্র ডিসি বাংলো জাদুঘরটি রাঙামাটিতে নিমার্ণ করেছে তৎকালীন জেলা প্রশাসক সৌরেন্দ্র নার্থ চক্রবর্তী। রাঙামাটির ডিসি বাংলো জাদুঘরটি পরিদর্শন করেই পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা অর্জন করা সম্ভব।
রাঙামাটি শহরের জিরো পয়েন্টে অত্যন্ত আকর্ষণীয় স্থান ডিসি বাংলো। শহরের সবচেয়ে পূর্ব প্রান্তে এ বাংলোর অবস্থান। শুধুমাত্র সংযোগ সড়ক ছাড়া বাংলোর আর সবদিকেই ঘিরে রেখেছে কাপ্তাই হ্রদের স্বচ্ছ জলরাশি। বাংলোর বৃক্ষরাজি অসংখ্য পাখপাখালির কলতানে মুখরিত। শীতের মেৌসুমী পাখি আর দেশীয় শালিক-টিয়া ও বাদুরের জন্যে বাংলোটি অভয়াশ্রম। ১৮৬৮ সালে রাঙামাটিতে জেলা সদর স্থানান্তরের পর নির্মিত হয় এ বাংলো। কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের পর ১৯৬২ সালে রাঙামাটি শহর হ্রদের পানিতে তলিয়ে গেলেও পাহাড়ের চুড়ায় অবস্থানের কারণে বাংলোটি টিকে আছে। ফলে বর্তমান এটি শহরের সবচেয়ে প্রাচীনতম বাড়ি হিসেবে পরিচিত লাভ করেছে। বাংলোর পিছনে হ্রদের উপর সেতুতে দাঁড়িয়ে মনোমুগ্ধকর প্রকৃতির সাথে একাকার হয়ে মিশে যাওয়া অতি সহজ।
ডিসি বাংলো এলাকায় সবার দৃষ্টি কাড়ে যে স্থাপত্যটি সেটিই নবমির্মিত ডিসি বাংলো জাদুঘর। অপরূপ স্থাপত্য শৈলী সমৃদ্ধ জাদুঘরটি মাত্র চারমাস আগে ২৬ মার্চ পূর্ণতা পায়। পার্বত্য চট্টগ্রামের জীবনাচার, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি তুলে ধরতে ইতোমধ্যেই সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে ডিসি বাংলো জাদুঘর। বর্তমানে এখানে প্রাচীন বেশ কিছু সামগ্রী সংরক্ষণ করে প্রতিষ্ঠা করেন ডিসি বাংলো জাদুঘর। যা দেশের আর কোথাও নেই। এ জাদুঘর থেকে নতুন প্রজন্ম পার্বত্য চট্টগ্রামের অজানা অনেক ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারবে।
চারদিকে লেক পরিবেষ্টিত রাঙ্গামাটি জেলা গড়ে উঠেছে ছোট বড় অসংখ্য পাহাড়ের সমন্বয়ে। পাহাড়গুলো সবুজ বনবাদাড়ে ঘেরা। পাহাড়, বন আর স্বচ্ছ জলধারা মিলে সৃষ্টি হয়েছে রাঙ্গামাটির নৈসর্গিক আবেশ। যেখানে চাকমা, মারমা, তঞ্চঙ্গ্যা, ত্রিপুরা, মুরং, বোম, খুমি, খেয়াং, চাক, পাংখোয়া, লুসাই, অসমীয়া ও গুর্খা, সুজে সাওতাল, রাখাইন সর্বোপরি বাঙালীসহ ১৪টি জনগোষ্ঠীর বসবাস। ভৌগোলিক বৈচিত্রময় সেৌন্দর্য এবং বিভিন্ন ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, সংস্কৃতির সম্মিলনযোগ করেছে এক ভিন্নমাত্রা। পার্বত্য চট্টগ্রামের নৃতাত্ত্বিক নিদর্শন সামগ্রী নিয়ে এ জাদুঘরে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রাচীন সব জিনিসত্রের আলোকচিত্রসহ রাঙ্গামাটির ধ্বংসাবশেষের পাথর, ১৮৬৬ সালে প্রথম টাইপ রাইটার, গান্টার চেইন, রাঙামাটি জেলা প্রশাসনের প্রচীন ঐতিহ্য টেবিল ও চেয়ার, পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা সৃষ্টির সময় থেকে রাঙামাটি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ছোট আলমিরা, ১৯৫৩ সাল থেকে সংরড়্গিত ক্যলেন্ডার বা বর্ষপঞ্জি, রাঙমাটি জেলা প্রশাসকের বিংশ শতাব্দীর প্রাচীন ঘড়ি, সাইটভ্যান, কম্পাস, প্লেইন টেবিল স্ট্যান্ডসহ, বিংশ শতাব্দীর টাইপ রাইটারসহ স্বাধীনতার পর থেকে জেলা প্রশাসকদের সব ছবিসহ নানান দুলর্ভ স্মৃতি চিহ্ন সংরক্ষণ করা হয়েছে।
ডিসি বাংলো জাদুঘরে আলোক চিত্রের মধ্যে স্থান পেয়েছে ৩০৮ বছরের পুরনো চাপালিশ গাছ, জেলা প্রশাসক এল, এইচ নিবেলেট এর স্মৃতি সত্মম্ভ, ঝুলনত্ম সেতু, গিরিনির্ঝও শুভলং ঝর্ণা, সীমানেত্ম আর্কাইভ শহীদ বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্স নায়ক মুন্সী আব্দুর রউফ, নানিয়ারচর বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ স্মৃতিসৌধ, রাঙামাটি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, গিরিশোভা ভাসমান রেসেত্মারা, রাজবন বিহার বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান, রাঙামাটি পার্বত্য জেলার হাতি, কোচপানা ডিসি বাংলোর পাশে হ্রদঘেরা এক টুকরো দ্বীপ, হ্রদের উপর নয়ন অভিরাম ডিসি বাংলো, পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠান, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালে ১২ ফেব্রুয়ারি রাঙামাটি বিসিক কার্যলয়ে পরিদর্শন কালে তার নিজ হস্তে মন্তব্য লিপিবদ্ধ, চাকমা রাজবাড়ী, পাখির চোখে কাপ্তাই হ্রদ ও পাহাড়, গোধূলী মুহূর্তে কাপ্তাই হ্রদ ও পাহাড়, হ্রদে সূর্যযদয় ও মাছ ধরার দৃর্শয, রাঙামাটির কাজু বাদাম একটি সম্ভাবনাময় শিল্প, চাঁদের গাড়ি আধুনিক যুগের আদিম যান, ১৯৭৫ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান রাঙামাটি সফর (বাংলার বাণী ও ইত্তেফাক পত্রিকার কাটিং), রাঙামাটির কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্টিলওয়ে, ১৯৭৫ সালে ১৪ জুন শেখ মুজিবুর রহমান রাঙামাটি বেতবুনিয়া উপগ্রহ ভ্থ-কেন্দ্র উদ্ধোনের আমন্ত্রণ পত্র, পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার সৃষ্টির পর ১৮৬০সাল থেকে ১৯০৯ পর্যন্ত দায়িত্ব পালনকারী জেলা প্রশাসকদের নামের তালিকা, রাঙামাটি জেলায় ১৯৭১ সাল থেকে ২০১২সাল পর্যনত্ম জেলা প্রশাসকদের নামের তালিকা ও স্বাক্ষর বোর্ডসহ বেশ কিছু ঐতিহ্যবাহী জিনিসপত্র এ জাদুঘরে স্থান পেয়েছে।
এ ব্যপারে রাঙামাটি জেলা প্রশাসনের সহকারি জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট (এডিএম) মো. ওবাইদুল হক বলেন, জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে দেশের প্রথম ও একমাত্র ডিসি বাংলো জাদুঘর নির্মিত হয়েছে রাঙামাটিতে। সংরক্ষণের অভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রাচীন অনেক ঐতিহ্যবাহী স্মৃতিচিহ্ন খুজে পাওয়া না গেলেও এ জাদুঘরে সংরক্ষণ করা হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসকদের প্রাচীন ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে ঐতিহ্যময় অনেক জিনিসপত্র। যা আজকের প্রজন্মের কাছে আশার আলো হয়ে থাকবে।
রাঙামাটি শহরের মাত্র ৬ কিলোমিটার পথ শেষে ডিসি বাংলো এলাকা। মূল শহর থেকে মাত্র ১০০ টাকা অটোরিক্সা ভাড়ায় সহজে যাওয়া যায় ঐতিহ্যবাহী ডিসি বাংলো জাদুঘরে। তবে জাদুঘরটি পর্যটকদের জন্য উম্মুক্ত থাকলেও জেলা প্রশাসকের অনুমতি পর জাদুঘরটি ঘুরে দেখা যায়।