৪ জুন, ২০২১ ১৮:২৩

পাখা গ্রামের হাতপাখায় চলছে সংসার

আবদুর রহমান টুলু, বগুড়া:

পাখা গ্রামের হাতপাখায় চলছে সংসার

চৈত্রের তাপদাহ এখনো কমেনি। বগুড়ায় দিনে ও রাতে প্রচন্ড গরম অনুভূত হচ্ছে। দিনে গরম থাকলেও রাতে সেই অনুপাতে কিছুটা কম অনুভূত হচ্ছে। প্রচন্ড গরমের মধ্যে বিদ্যুৎ চলে গেলে সাধারণ মানুষের কাছে এখনো হাত পাখা ভরসা হয়ে আছে। গ্রামীণ জনপদে গরমের কারণে হাতপাখা বিক্রির হিড়িক পড়ে গেছে। বগুড়ার কাহালু উপজেলার কয়েকটি গ্রামে প্রতিদিন তৈরি হাজার হাজার হাত পাখার জন্যই মুখেমুখে নাম হয়েছে 'পাখা গ্রাম'। পাখা গ্রামের নারী ও পুরুষ মিলিয়ে হাতপাখা তৈরী করেই এখন চালাচ্ছে সংসার। গরম আবহাওয়ার কারণে এখন ব্যস্ত সময়পার করছে পাখার কারিগড়রা। 

জানা যায়, জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষ দিকে হলেও বগুড়ায় বেশ গরম আবহাওয়া বিরাজ করছে। পথে ঘাটে অনেকেই ঘেমে যাচ্ছেন। দিনে রোদের তীব্রতা থাকায় সেই গরম আরো বেশি অনুভূত হচ্ছে। গরমের কারণে বাজারে চাহিদা থাকায় তালপাতা দিয়ে তৈরী হাতপাখা এখন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি হচ্ছে। বগুড়ার কাহালু উপজেলার আড়োলা, যোগীর ভবন, বাগোইল, আখরাইল গ্রামের প্রায় সহস্রাধিক নারী পুরুষ হাত পাখা তৈরীর কাজ করে যাচ্ছে। হাতপাখা তৈরী করে গ্রামের সাধারণ মানুষগুলো পেয়েছে অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা। প্রতিনিয়ত হাতপাখা তৈরী করে সংসার পরিচালনা করে থাকে বলে অনেকেই গ্রামগুলো পাখার গ্রাম বলে ডেকে থাকে। 

কাহালু উপজেলার আড়োলা গ্রামের পাখা কারিগররা জানান, ফাল্গুন মাস থেকে শুরু করে আশ্বিন মাস পর্যন্ত পুরো ৯ মাস জুড়েই তালপাখা তৈরীর কাজ করে থাকেন। বাকি কার্তিক, অগ্রাহায়ন, পৌষ মাস পর্যন্ত কৃষি কাজে ব্যবহৃত বাঁশের তৈরী জিনিসপত্র এবং তালপাখা তৈরী মৌসুমের জন্য বিভিন্ন এলাকা থেকে তালপাতা সংগ্রহ করে মজুদ রাখে। হাতপাখা তৈরীর মানুষগুলো ৫/৬ প্রকারের পাখা তৈরী হয়ে থাকেন। প্রকারভেদে এগুলির নাম দেওয়া হয়েছে হর্তন, ঘুরকি, তেওয়াল ঘুরকি, ডাগুর পাখা, পকেট পাখা ইত্যাদি। তবে শহর অঞ্চলে নকশি করা পাখা বেশি বিক্রি হয় সুঁই সুতায়র সাথে নকশা করা পাখা বেশি বিক্রি হয়। সাধারণত এই পাখাগুলো অর্ডার নিয়ে ২০০ থেকে ৫০০ টাকাতে বিক্রি হয়। পাখাগুলোতে ফুল, ফল, দৃশ্যসহ বিভিন্ন প্রকৃতির অবয়ব ফুটিয়ে তোলা হয় সুতা দিয়ে। 

পাখা কারিগরদের সাথে কথা বলে জানা যায়, এক সময়ের বিখ্যাত আড়িয়াল মেলাকে কেন্দ্র করে এখানকার মানুষ পাখা তৈরীর কাজ শেখে। এ ছাড়াও প্রাচীন যোগীর ভবন মন্দিরে পূজা আর্চনার জন্য আসা বিভিন্ন দেশের হিন্দু ধর্মাম্বলীর লোকজনের সরগরম ছিল। ঐ সময় গ্রাম গঞ্জে বিদ্যুতের ব্যবহার ছিল না। বিদ্যুত বিহীন অবস্থায় মানুষ যখন ওষ্ঠাগত তখন একমাত্র ভরসা ছিল তালপাতার পাখা। বর্তমানে দেশের বিদ্যুৎ ঘাটতিতে লোড শেডিংয়ের ফলে তাল পাখার কদর দিন দিন বেড়েই চলেছে। রংপুর, দিনাজপুর, গাইবান্ধা, জয়পুরহাট, নওগাঁ, নাটোর, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, টাঙ্গাইলসহ দেশের বিভিন্ন জেলার ব্যবসায়ীরা এখান থেকে পাইকারী দরে তালপাখা ক্রয় করে নিজ নিজ অঞ্চলে বিক্রি করছে বলে তারা জানান। 

কাহালু উপজেলার আতালপাড়ার পাখা তৈরীর নারী শ্রমিকরা জানান, আদিকাল থেকেই আতালপাড়া গ্রামের শতকরা ৮০ ভাগ পরিবারই এ পেশাকে আকড়ে ধরে আছে। এখন গ্রীস্মকাল হওয়ায় প্রতিদিন নতুন নতুন অর্ডার বাড়ছে হাতপাখার। সাধারণ পাখা তৈরী করতে সব মিলিয়ে ১৫ থেকে ২০ টাকা খরচ হয়। কিছুদিন আগেও খরচ হতো ১২ থেকে ১৫ টাকা। কিন্তু এখন বাঁশ, তালাপাতা, সুতার দাম বৃদ্ধির কারণে তৈরীর খরচও বেড়ে গেছে। নারী শ্রমিকরা জানান, তারা পরিবারের সদস্যদের সাথে মিলিয়ে কাজ করে সংসার পরিচালনা করেন। আর যখন বেশি অর্ডার পড়ে তখন প্রতিবেশি শ্রমিকদের ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা দিন মুজরিতে কাজে নেওয়া হয়। যারা শ্রমিক হিসেবে কাজ করে তারা প্রতি মাসে ৭ থেকে ৯ হাজার টাকা আয় করতে পারে।

পাখার ব্যবসায়ীরা জানান, তারা গ্রামের বাড়ি বাড়ি ঘুরে পাখাগুলো পাইকারি দরে শতকরা হিসেবে কিনে নেয়। এই পাখাগুলো বগুড়াসহ উত্তরের ১৬ জেলায় বিক্রি হয়। করোনাকালেরর জন্য কিছুটা কম বিক্রি হচ্ছে। আবার নিজস্বভাবে পরিবহন খরচ দিয়ে গ্রামীণ জনপদে নিয়ে যেতে পারলে আবার বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। 

বিডি প্রতিদিন/হিমেল

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর