রবিবার, ১৯ মে, ২০১৯ ০০:০০ টা

মানবাধিকার কমিশনের তদন্তে পুলিশের গাফিলতি

ভুয়া ঠিকানায় মামলা

মাহবুব মমতাজী

বিনা অপরাধে কোলের শিশুকে নিয়ে হাজত খাটতে হয়েছে ভোলার বোরহানউদ্দিনের বিউটি বেগমকে। গ্রামে জমি-জমা নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে স্বামী-শ্বশুরসহ ৭ জনের সঙ্গে তাকেও আসামি করেন প্রতিবেশী আলী হোসেন। আর ঘটনাস্থল দেখানো হয় পুরান ঢাকার লালবাগ। অথচ তদন্ত কর্মকর্তার মিথ্যা প্রতিবেদনের কারণে কোলের শিশুকে নিয়ে কারাবাসের নিদারুণ দুর্ভোগ পোহাতে হয় বিউটি বেগমকে। পরে অবশ্য তিনি জামিনে মুক্তি পান। পরবর্তীতে বিউটি বেগমের বিরুদ্ধে করা মামলার অভিযোগ খতিয়ে দেখে সেখানে গাফিলতি খুঁজে পায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। সরেজমিন মামলার তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লিখিত ঠিকানা ভুয়া বলে প্রমাণ পায় কমিশনের তদন্ত কমিটি। তদন্তে দেখা যায়, বাদী সাজানো ঘটনায় নিজের ভুয়া ঠিকানা দিয়ে আসামিদের  বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করেছেন। জানা যায়, মারধরের অভিযোগ এনে গত বছরের ৪ আগস্ট বিউটি বেগমসহ ৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন আলী হোসেন। আর মারধরের ঘটনাস্থল দেখানো হয় পুরান ঢাকার লালবাগ রোডের ১৬৫ নম্বর বাসার সামনের রাস্তায়। এ ছাড়া বিউটিসহ অভিযুক্তদের ঠিকানা দেখানো হয় নবাবগঞ্জ বাজারের পাশে ২০২ নম্বর বাসায়। তদন্ত কর্মকর্তা লালবাগ থানার এসআই গোলাম রাব্বানীর দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদনেও একই ঠিকানা উল্লেখ করা হয়। অথচ ঘটনাস্থলের ঠিকানায় খোঁজ নিয়ে দেখা যায় সেগুলো অন্য মানুষের ঠিকানা। লালবাগের স্থানীয়রা জানান, লালবাগ রোডের ১৬৫ নম্বর বাসার বাড়িওয়ালার নাম মোস্তফা। সেখানে কোনো ভাড়াটিয়া থাকেন না। আলী হোসেন নামে ওই এলাকায় কোনো লোক নেই বলেও জানান তারা। মারধরের কোনো ঘটনার কথা স্থানীয় দোকানদারও দেখেননি বা শোনেননি বলে জানান। গত ১৮ মার্চ বিষয়টি জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের দৃষ্টিগোচর হলে কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক তাৎক্ষণিক দুই সদস্যের কমিটি গঠন করেন। কমিশন সূত্র জানায়, বাদী আলী হোসেন নিজের ঠিকানা এবং আসামি বিউটি বেগমসহ ৭ জনের নামে ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করে ঢাকা সিএমএম আদালতে মিথ্যা মামলা করেন। বিচারক ঘটনার প্রাথমিক সত্যতা নিরূপণে তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য লালবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) নির্দেশ দেন। পরবর্তীতে লালবাগ থানার ওসি তদন্তের দায়িত্ব দেন এসআই গোলাম রাব্বানীকে। এসআই গোলাম রাব্বানী কোনো প্রকার তদন্ত ছাড়াই মিথ্যা মামলার বাদী আলী হোসেনের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা আছে মর্মে প্রতিবেদন দেন। বিচারক ওই তদন্ত প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আলী হোসেনের মামলাটি আমলে নেন এবং আসামিদের প্রতি ওয়ারেন্ট ইস্যু করেন।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্য এবং কমিশনের পরিচালক আল মাহমুদ ফায়জুল কবীর ও উপ-পরিচালক মোহাম্মদ গাজী সালাউদ্দিন গত ২১ মার্চ তদন্ত শেষে প্রতিবেদন জমা দেন। এ প্রতিবেদনে বলা হয়, আলী হোসেন আদালতের সামনে অসত্য তথ্য পরিবেশন করে সি.আর.৪৭৮/১৮ নম্বর মামলাটি করেন। বাদীর আইনজীবীও যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করেননি এবং আলী হোসেনের চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থাপত্র আছে কিনা তা যাচাই করেননি। সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয়- তদন্ত কর্মকর্তা এসআই গোলাম রাব্বানী আদালতের নির্দেশ যথাযথভাবে পালন না করেই এবং ঘটনাস্থলে না গিয়েই কাল্পনিকভাবে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। আলী হোসেন তার মামলায় উল্লেখ করেন যে- মারধরের শিকার হয়ে গত বছরের ২৬ জুন তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। অথচ মানবাধিকার কমিশনের তদন্ত কমিটি ঢামেক হাসপাতালের রেজিস্ট্রার যাচাই করে দেখেন যে- ওই নামের কোনো ব্যক্তি ওইদিন কোনো ধরনের চিকিৎসা নেননি। এ অবস্থায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশন মামলার অভিযোগকারী আলী হোসেনকে দ্রুত গ্রেফতার করে মিথ্যা মামলা করা ও নির্দোষ মানুষকে বিনা অপরাধে কারাভোগ করানোর অভিযোগে আইনের আওতায় আনার সুপারিশ করেছে। এ ছাড়া ওই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই গোলাম রাব্বানীর বিরুদ্ধে কর্তব্য কাজে অবহেলার জন্য বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেওয়ার সুপারিশ করেছে। একই সঙ্গে আইনজীবীরা যেন মামলা গ্রহণের ক্ষেত্রে ভুয়া অভিযোগের বিষয়ে অধিকতর সতর্ক থাকেন সে ব্যাপারে ঢাকা আইনজীবী সমিতির কাছে অনুরোধপত্র পাঠাতে সুপারিশ করা হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে লালবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সুবাস কুমার পাল জানান, এসআই গোলাম রাব্বানীর বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে এবং তার বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে।

সর্বশেষ খবর