গল্প
তুমি দাঁড়িয়ে ছিলে খোলা জানালায়। লম্বালম্বি শিকগুলোর দুটি শিক ধরে। একটি শিক ছুঁয়ে ছিল তোমার বাঁ পাশের তুলতুলে গাল। চোখ দুটি তাকিয়ে ছিল দূরে। অপলক। উদাস। কিছু দেখছিলে বলে মনে হচ্ছে না। হয়তো অসীমে দৃষ্টি ভাসিয়ে মনটাকে ছোটাচ্ছিলে স্মৃতির তেপান্তরে। সেখানে আমি ছিলাম কি? মনে হয় না। আমার স্মৃতিজুড়ে তোমার খুব দাপুটে উপস্থিতি। কিন্তু তোমার স্মৃতিতে আমার না থাকারই কথা। আমার ওপর তোমার নির্মোহ দৃষ্টি সে কথাই বলেছে আমাকে।
দূরের বা কাছের কারো কোনো অপমানে, লাঞ্ছনায় ভীষণ কষ্ট পেয়ে মনটাকে অতীতের কোনো ভালো-লাগা-ঘটনার পেলব সুখে ভুলিয়ে রাখছিলে কি? অনেকেই এভাবে অতীতচারী হয়ে বর্তমানের যন্ত্রণা থেকে রেহাই পেতে চায়। পারে কি? হয়তো পারে। হয়তো পারে না। আরো মন দিয়ে দেখতে থাকলাম তোমার ছবিটা। তোমার চুলগুলো উড়ছিল। এক গোছা চুল তোমার মাথা থেকে উড়ে এসে বাঁ চোখের চশমা আধাআধি ঢেকে নাকের ওপর এসে পড়েছিল। তুমি তখন নিজেকে মানিয়ে নিতে, সংসারে ধরে রাখতে স্মৃতির ঝাঁপিতে বুঁদ হয়ে আছো। অস্তিত্ব সংকটে দিশাহারা, বিপর্যস্ত। হয়তো।
হয়তো বলছি, কারণ আমি নিশ্চিত নই। আমি কি আদৌ কখনো কোনো কিছুতেই নিশ্চিত হতে পেরেছি? না, পারিনি। সন্দেহ আর সংশয়ের এঁদোজলে হাবুডুবু খেতে খেতেই জীবনের এটুকু পথ পেরিয়ে এসেছি। এই যে এখন তোমাকে নিয়ে এত্তোকিছু ভাবছি, তারও সবটাই সংশয়ের কাঁটায় ভরা। বহু বহুদিন তোমার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখিনি। ইচ্ছে করেই। ভয়ে। প্রত্যাখ্যানের ভয়। উপেক্ষা আর অবহেলাকে নিত্যসঙ্গী করে কঠোর বাস্তবতার নির্দয় পিচ্ছিল পথ খামচে আঁকড়ে ধরে এখনো টিকে আছি। জীবনের তিরিশটি বছর পেরিয়ে এসে আমার অনেকটা নিশ্চিত করেই জানা হয়ে গেছে, প্রবল বিরুদ্ধস্রোত উজিয়ে উজিয়েই জীবনের বাকিটা পথ পেরুতে হবে। এর মধ্যেই হাতে-পায়ে-গায়ে-গতরে-মেধায় লড়ে লড়ে এগিয়ে যেতে হবে। এতোদিন তোমাকে নিয়ে ভেবে ভেবেই সব ধরনের কষ্ট সয়ে এসেছি। তোমাকে নিয়ে ঘর বাঁধার ফানুস উড়িয়ে নিজেকে জীবনে ধরে রেখেছি। চরম কষ্টের সময় নিজেকে ধরে রেখেছি এ কথাগুলো আওড়াতে আওড়াতে : ‘আমার ... আমাকে সুস্থ রাখে, সুন্দর করে, স্নিগ্ধ করে, প্রাজ্ঞ করে, কর্মঠ করে, আত্মনিয়ন্ত্রণের শক্তি দেয়।’ সবটাই আমার কল্পনা। বলতে পারো সাবলীল দুঃখবিলাস।
তোমার এই ছবি আজ কেন যেন তোমার দিকে টেনে নিচ্ছে। প্রবলভাবে। ভাবতে ভাবতে এক সময় মরিয়া হয়ে সিদ্ধান্তটা নিয়েই নিলাম। দীপু তোমার এই ফটোটা আমাকে দিয়েছিল। একই মেসে থাকি আমি আর দীপু। চাকরি করি দুটি ভিন্ন অফিসে। ও অবশ্য কী এক জাদুমন্ত্রবলে ক্যারিয়ারে ওপরে ওঠার সিঁড়িটাতে পা রাখতে পেরেছে। তোমার কি এখন সেই দিনগুলোর কথা মনে আছে, কলেজে পড়ার সময় যখন তোমার ভাই বিজয়ের সঙ্গে আমি আর দীপু তোমাদের বাড়িতে গিয়ে আড্ডা মারতাম। তোমাকে প্রথম দেখার পর থেকেই তুমি আমার মনের মধ্যে ঢুকে পড়েছিলে। কাউকে জানতে দিইনি। কিন্তু একদিন মেসে খুব বৃষ্টির ভেতর ছুটির অলস সময় কাটাতে কাটাতে মুখ ফসকে কথাটি দীপুকে বলে ফেলেছিলাম। দীপু অনেকক্ষণ স্থির তাকিয়ে ছিল আমার দিকে। কতোটুকু কী মাপতে পেরেছিল জানি না, তবে প্রাথমিক ধাক্কাটা সামলেও ওর টেবিলে গিয়ে একটি ডায়েরির ভেতর থেকে তোমার এই ছবিটা এনে আমার হাতে দিয়ে বলেছিল, ‘নে, তোর যা হাবভাব দেখছি তাতে এটা হয়তো তোর খুব কাজে লাগবে। আমিই তুলেছিলাম ছবিটা। প্রিন্ট করে এক কপি অবশ্য বিজয়কেও দিয়েছিলাম। এখন তোর কথা শুনে মনে হলো, বাকি ছবিটা তোর কাছে থাকাই ভালো। আমার আর এটার কোনো দরকার নেই।’
তার পর থেকেই একলা থাকার সময়টাতে তোমার এই ছবি আমার বাতিঘর হয়ে আছে। গত বছর ছোট বোনটাকে বিয়ে দেয়ার পর থেকেই মা আমাকে জুটি বাঁধাতে উঠেপড়ে লেগেছেন। ছুটিছাটায় বাড়িতে গেলেই সদ্যপ্রয়াত বাবার কথা পেড়ে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করতে থাকেন। নতুন চাকরিটা পোক্ত হওয়ার পর থেকে তাই তোমাকে নিয়ে রঙিন স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকছি। অবশেষে সিদ্ধান্তটা পাকা করে এক ছুটির দিনে বিজয়দের বাড়ি যাওয়ার ট্রেনে চেপে বসলাম।
তুমি আর বিজয় সৎ মায়ের লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সয়ে দিন কাটাচ্ছিলে জানতাম। মনের ভেতর একটা দিগি¦জয়ী ভাব খেলা করছিল- তোমাকে রাক্ষসপুরী থেকে মুক্ত করতে যাচ্ছি।
বিজয়দের বাড়িটা খুঁজে পেতে কষ্ট হলো না। বাড়িতেই ছিল বিজয়। আমাকে দেখে খুশিতে জড়িয়ে ধরে বুকে চেপে রাখল টানা পাঁচ মিনিট। তারপর মিষ্টি আর দইয়ের ব্যাগ দুটো ভেতরে নিয়ে গেল। একটু পরে বছর দুয়েকের ফুটফুটে এক মেয়েকে কোলে নিয়ে ফিরে এসে বলল, ‘এতোদিন পরে মনে পড়ল? কতোজনের কাছে যে তোর কথা জিগাইছি!’ ওর কোলের তুলতুলে মেয়েটির গাল টিপে দিয়ে বললাম, ‘তোদের এভাবে চমকে দেবো বলেই আগে থেকে কিছু বলিনি।’ তারপর ছোট্ট মেয়েটার দিকে ইঙ্গিত করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তা বিয়ে করলি কবে?’ বিজয়কে আর উত্তর দিতে হলো না। ওর হো-হো-হো হাসির মাঝেই তুমি এসে ঘরে ঢুকলে। সঙ্গে সঙ্গে বিজয়ের কোলে থাকা মেয়েটা তোমার দিকে ঝুঁকে হাত বাড়িয়ে ‘মা-মা’ বলে ডেকে উঠল।
সারা জীবনের জন্য কেবলই ছবি হয়ে গেলে তুমি আমার কাছে।