মঙ্গলবার, ২৩ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

পদ্মা সেতুর স্বপ্নপূরণ

নিজস্ব প্রতিবেদক

পদ্মা সেতুর স্বপ্নপূরণ

পদ্মা সেতু এখন আর স্বপ্ন নয়। একদিন যা ছিল স্বপ্ন আজ তা সত্যি। বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে স্বপ্ন সত্যি হলো। দৃশ্যমান হলো পদ্মা সেতু। বহুল কাক্সিক্ষত এ সেতুর সর্বশেষ স্টিলের কাঠামো (স্প্যান) বসানো পর। সঙ্গে সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায় পদ্মার দুই পাড়। আর এভাবেই পুরো বিশ্ব প্রত্যক্ষ করল বাঙালি জাতির অসম্ভবকে সম্ভব করার অপূর্ব মুহূর্ত। গতবছর ডিসেম্বরে ৪১তম এ স্প্যান সেতুর ১২ ও ১৩ নম্বর খুঁটির (পিলার) ওপর বসানোর সঙ্গে সঙ্গে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার পদ্মা সেতুর পুরোটাই দৃশ্যমান হয়। সর্বশেষ স্প্যানটির এক পাশে টাঙানো হয় বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা। অন্য পাশে চীনের পতাকা। ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পদ্মা সেতুর জাজিরা প্রান্তে ৩৭ ও ৩৮ নম্বর পিলারের ওপর প্রথম স্প্যান (স্প্যান-‘৭-এ’) বসানোর মধ্য দিয়ে দৃশ্যমানতা শুরু হয় স্বপ্নের পদ্মা সেতুর। বাকি ৪০টি স্প্যান বসাতে তিন বছর দুই মাস লাগল। বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে শেষ স্প্যানটি (৪১তম) বসানোর মধ্য দিয়ে পুরো সেতুর অবকাঠামো দৃশ্যমান হয়। সড়ক ও রেলের স্লাব বসানো সম্পন্ন হলে সেতু দিয়ে যানবাহন ও ট্রেন চলাচল করতে পারবে। এতে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার সঙ্গে সারা দেশের সরাসরি সংযোগ স্থাপন হওয়ার পথ উন্মুক্ত হবে। করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি এবং বর্ষায় অত্যধিক স্রোত পদ্মা সেতুর কাজে কিছুটা গতি কমিয়ে দিয়েছিল। বিরূপ পরিস্থিতির ধকল কাটিয়ে গত বছর ১১ অক্টোবর ৩২তম স্প্যান বসানোর পর অনুকূল আবহাওয়া পাওয়া যায়। পরে কারিগরি কোনো জটিলতা না থাকায় বাকি স্প্যানগুলো বসানো সম্ভব হয়। সাধারণত সেতু স্টিলের অথবা কংক্রিটের হয়। কিন্তু পদ্মা সেতুটি হচ্ছে স্টিল ও কংক্রিটের মিশ্রণে। সেতুর মূল কাঠামোটা স্টিলের, যা স্প্যান হিসেবে পরিচিত। খুঁটি ও যানবাহন চলাচলের পথ কংক্রিটের। প্রতিটি স্প্যানের দৈর্ঘ্য ১৫০ মিটার। ৪২টি খুঁটির সঙ্গে স্প্যানগুলো জোড়া দেওয়ার মাধ্যমে পুরো সেতু দৃশ্যমান হয়। পদ্মার মূল সেতু অর্থাৎ নদীর অংশের দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। অবশ্য দুই পাড়ে আরও প্রায় ৪ কিলোমিটার সেতু আগেই নির্মাণ হয়ে গেছে। একে বলা হয় ভায়াডাক্ট। এর মধ্যে স্টিলের কোনো স্প্যান নেই। পদ্মা সেতু দ্বিতলবিশিষ্ট। স্টিলের স্প্যানের ওপর দিয়ে চলবে যানবাহন। এ পথ তৈরির জন্য কংক্রিটের স্লাব বসানোর কাজ চলছে। এটা সম্পন্ন হলে পিচঢালাই করা হবে। পুরো কাজ শেষ হলে যানবাহন চলাচলের পথটি হবে ২২ মিটার চওড়া এবং তা চার লেনের। মাঝখানে থাকবে বিভাজক। স্প্যানের ভিতর দিয়ে চলবে ট্রেন। সেতুতে একটি রেললাইনই থাকবে। তবে এর ওপর দিয়ে মিটারগেজ ও ব্রডগেজ দুই ধরনের ট্রেন চলাচলেরই ব্যবস্থা থাকবে। ভায়াডাক্টে এসে যানবাহন ও ট্রেনের পথ আলাদা হয়ে মাটিতে মিশেছে।

সেতুর ইতিকথা : পদ্মা সেতুর জন্য অপেক্ষা প্রায় দুই যুগের। ১৯৯৮ সালে এ সেতুর প্রাক্-সম্ভাব্যতা যাচাই হয়। ২০০১ সালের ৪ জুলাই পদ্মা সেতু নির্মাণে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর রাজনৈতিক পট ও সরকার পরিবর্তনের কারণে থেমে যায় পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের কাজ। চারদলীয় জোট সরকারের সময় এ সেতু নির্মাণে তেমন কোনো কাজ হয়নি। তবে জাপানের দাতা সংস্থা জাইকা বিস্তারিত সমীক্ষার পর ২০০৪ সালে মাওয়া-জাজিরা প্রান্তে সেতু নির্মাণের পরামর্শ দেয়। সেনাশাসিত ফখরুদ্দীন সরকারের সময় ২০০৭ সালে একনেকে পদ্মা সেতু প্রকল্প পাস হয়। তখন এ প্রকল্প ব্যয় ছিল ১০ হাজার ১৬২ কোটি টাকা। ২০১১ সালে ব্যয় বাড়িয়ে করা হয় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে দ্বিতীয় দফা সংশোধনের পর ব্যয় দাঁড়ায় ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। এরপর প্রকল্প প্রস্তাব সংশোধন না করে ২০১৮ সালের জুনে আবারও ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। প্রকল্প শেষ হওয়ার আগে আরেক দফা প্রস্তাব সংশোধন করতে হতে পারে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ পুনরায় সরকার গঠনের পর আবারও পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু হয়। জমি অধিগ্রহণ, ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের কাজ শুরু হয়। চুক্তি হয় বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকাসহ কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। কিন্তু মাঝপথে থেমে যায় পদ্মা সেতুর কাজ। বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। অনেকের ধারণা ছিল, এ সরকারের পক্ষে আর এ সেতু নির্মাণ করা সম্ভব হবে না। একপর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা দেন পদ্মা সেতু নির্মাণ হবে নিজেদের টাকায়। যেমন কথা তেমন কাজ। শুরু হয় দেশবাসীর বহুল প্রত্যাশিত পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের কাজ।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর