সৌরপ্রযুক্তি : পেরোভস্কাইট
এই প্রযুক্তিতে এখন বিশ্বজুড়ে সৌর প্যানেলে ব্যবহৃত উপাদান সিলিকনের সঙ্গে পেরোভস্কাইট উপাদানগুলোকে একত্রিত করা হয়, যাতে সৌর প্যানেলের সূর্যালোককে বিদ্যুতে রূপান্তরের দক্ষতা আরও ব্যাপক আকারে বৃদ্ধি পায়
বিশ্ব যখন নবায়নযোগ্য শক্তির দিকে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে, তখন একটি উপাদান বিজ্ঞানী ও শিল্প উভয়ের মনোযোগ কাড়ছে- পেরোভস্কাইট (Perovskite)। কেউ কেউ বলছেন, এটি সৌরশক্তির জগতে পরবর্তী বিপ্লব আনতে পারে। তবে, আশার পাশাপাশি রয়েছে বাস্তবতার চ্যালেঞ্জও।
পেরোভস্কাইট কী এবং কেন এটি বিশেষ?
পেরোভস্কাইট মূলত একটি খনিজ পদার্থ, যা প্রথম আবিষ্কৃত হয় ১৮৩৯ সালে ইউরেশিয়ার উরাল পর্বতমালায়। কিন্তু আজকের পেরোভস্কাইট নামটি বোঝায় এমন কৃত্রিম উপাদানকে, যার স্ফটিক কাঠামো ওই প্রাকৃতিক খনিজটির মতো। এটি ব্রোমিন, ক্লোরিন, সিসা (lead) এবং টিনের মতো সহজলভ্য উপাদান দিয়ে তৈরি করা যায়। এর বৈশিষ্ট্য হলো-এটি সূর্যালোকের বিস্তৃত বর্ণালিকে শোষণ করে বিদ্যুতে রূপান্তর করতে সক্ষম, যা প্রচলিত সিলিকন সৌরকোষের চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর। এই কারণেই গবেষকরা একে বলছেন, ‘এটি এক বিস্ময়কর উপাদান’।
অক্সফোর্ড পিভি ও নতুন প্রযুক্তির দিগন্ত
যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উদ্ভূত সংস্থা অক্সফোর্ড পিভি এই প্রযুক্তিকে শিল্প পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার নেতৃত্ব দিচ্ছে। তাদের গবেষণাগারে তৈরি হচ্ছে ট্যান্ডেম, পেরোভস্কাইট সৌর কোষ, যেখানে পেরোভস্কাইট ও সিলিকনকে একত্র করে একটি কোষে যুক্ত করা হয়। এই ‘ট্যান্ডেম প্রযুক্তি’ সূর্যের বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যরে আলোকে আরও কার্যকরভাবে ব্যবহার করে, ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের দক্ষতা বেড়ে যায় ৪৭% পর্যন্ত- যেখানে প্রচলিত সিলিকন প্যানেল সাধারণত ২১-২৩% দক্ষতা দেয়। অক্সফোর্ড পিভি জানিয়েছে, তাদের ট্যান্ডেম প্যানেলগুলো একই জায়গায় বেশি শক্তি উৎপন্ন করতে পারে, যার ফলে বিদ্যুতের খরচ প্রায় ১০% পর্যন্ত কমে আসে।
সৌরশক্তির বাজারে নতুন প্রতিযোগিতা
বিশ্বে বর্তমানে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রায় ৭% আসে সৌরশক্তি থেকে এবং এই হার প্রতি বছরই দ্রুত বাড়ছে। শুধু ২০২৪ সালেই এর প্রবৃদ্ধি ছিল ২৯%। এই প্রেক্ষাপটে পেরোভস্কাইটের আগমন সৌরশক্তির বাজারে নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছে। ট্যান্ডেম কোষগুলো শুধু সোলার ফার্মেই নয়, বরং ভবিষ্যতে বাড়ির ছাদ, বৈদ্যুতিক গাড়ি এমনকি স্যাটেলাইটেও ব্যবহারের উপযোগী হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
সুবিধা ও সম্ভাবনা
০১. উচ্চদক্ষতা : পেরোভস্কাইট আলোর বিস্তৃত অংশকে ব্যবহার করে, ফলে একই আকারের প্যানেলে বেশি শক্তি উৎপাদন সম্ভব।
০২. পাতলা ও নমনীয় গঠন : এগুলো এতটাই হালকা যে, জানালার কাচ বা গাড়ির ছাদেও প্রয়োগ করা যায়।
০৩. কম খরচে উৎপাদন : কাঁচামাল সহজলভ্য ও উৎপাদন প্রক্রিয়া তুলনামূলকভাবে সস্তা, যা সৌরশক্তিকে আরও গণমুখী করতে পারে।
০৪. অতিরিক্ত শক্তি উৎপাদন : বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা বেশি হওয়ায় বাণিজ্যিক ব্যবহারে এর লাভজনকতা বাড়বে।
রয়েছে চ্যালেঞ্জ ও বিতর্ক সব আশার মাঝেও আছে কিছু গুরুতর প্রশ্ন।
► স্থায়িত্ব : পেরোভস্কাইট এখনো আর্দ্রতা ও উচ্চ তাপমাত্রার প্রতি সংবেদনশীল। এতে দ্রুত অবনতি হতে পারে, যা স্থায়িত্বে প্রভাব ফেলে।
► সিসার উপস্থিতি : অনেক পেরোভস্কাইট কোষে সিসা ব্যবহৃত হয়, যা একটি বিষাক্ত পদার্থ। যদিও গবেষকরা বলছেন, ব্যবহৃত সিসার পরিমাণ অতি সামান্য এবং পুনর্ব্যবহারের মাধ্যমে ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।
► পরিবেশগত প্রভাব : উৎপাদনের বাড়তি প্রক্রিয়ার কারণে পেরোভস্কাইট ট্যান্ডেম প্যানেলের পরিবেশগত প্রভাব সাধারণ সিলিকন প্যানেলের তুলনায় প্রায় ৭% বেশি। তবে, একই পরিমাণ শক্তি উৎপাদনে কম প্যানেল লাগায় এই প্রভাব অনেকাংশে সমান হয়ে যায়।
ল্যাব থেকে মাঠে : বাস্তবতার পরীক্ষা
অক্সফোর্ড পিভির ল্যাবে প্রতিনিয়ত ‘ত্বরিত বার্ধক্য পরীক্ষা’ চলছে-যেখানে তাপ, আর্দ্রতা ও আলোতে ট্যান্ডেম কোষগুলোর দীর্ঘমেয়াদি স্থায়িত্ব যাচাই করা হচ্ছে। গবেষকরা বলছেন, এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো বাস্তব জগতে এই প্যানেলগুলোর কর্মক্ষমতা প্রমাণ করা। ক্যালিফোর্নিয়ার সংস্থা ক্যালক্স (Caelux) ও জার্মানির ট্রিনাসোলারের মতো কোম্পানিগুলোও এই প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছে। ২০২৫ সালের শুরুতে অক্সফোর্ড পিভি তাদের প্রথম ১০০ কিলোওয়াট ট্যান্ডেম সৌর প্যানেলের ব্যাচ যুক্তরাষ্ট্রের একটি সৌর ফার্মে স্থাপন করেছে, যার দক্ষতা ২৪.৫%।
মহাকাশ থেকে গাড়ি পর্যন্ত
পেরোভস্কাইট ট্যান্ডেম প্রযুক্তি এখন শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্যই নয়, ইলেকট্রিক গাড়ি ও স্যাটেলাইট ক্ষেত্রেও আলোচনায়। গবেষকরা মনে করেন, গাড়ির ছাদে ট্যান্ডেম প্যানেল বসালে ব্যাটারিতে অতিরিক্ত রিজার্ভ চার্জ যোগ করা যাবে। মহাকাশে পেরোভস্কাইট প্যানেল গ্যালিয়াম আর্সেনাইডের মতো কার্যকারিতা দিলে খরচ অনেক কম, যা পরবর্তী প্রজন্মের স্যাটেলাইটে বড় পরিবর্তন আনতে পারে।
ভবিষ্যতের দিগন্ত
পেরোভস্কাইট এখনো ‘পরীক্ষার পর্যায়ে’ থাকলেও বিশেষজ্ঞদের মতে এটি সৌরশক্তির নতুন মানদণ্ড তৈরি করবে। অক্সফোর্ড পিভি আশা করছে, তাদের গবেষণার অগ্রগতিতে প্রতি বছর দক্ষতা ১% করে বাড়বে। ক্যালক্সের প্রধান নির্বাহী স্কট গ্রেবিয়ালের ভাষায়, ‘মানুষ আসলে জানতে চায়, পুরো প্রকল্পে কত শক্তি উৎপন্ন হবে। পেরোভস্কাইট সেই উত্তর দিচ্ছে-বেশি আলো, বেশি শক্তি।’
তথ্যসূত্র : বিবিসি