মুসলিম শাসকদের মধ্যে যেমন শীর্ষে, তেমনি পৃথিবীর ইতিহাসেও অন্যতম সেরা শাসক তিনি। সুলতান সুলেমান খান। অটোমান বা উসমানীয় সাম্রাজ্যের সুলতান। সুলতান সুলেমানকে নিয়ে অনেক গল্প লেখা হয়েছে। নির্মিত হয়েছে আলোচিত-সমালোচিত টিভি সিরিয়াল মুহতাশিম ইউজিয়েল। আমাদের এ উপন্যাসের ভিত্তি সেই টিভি সিরিজ বা উপন্যাস নয়। মূলত ইতিহাসের নানা বইপত্র ঘেঁটে সুলতান সুলেমানের আমলটি তুলে ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে। ইতিহাসাশ্রয়ী এ উপন্যাসের মূল ভিত্তি অটোমানদের ইতিহাস। বাকিটুকু লেখকের কল্পনা। এই বইমেলার শেষ সপ্তাহে অন্বেষা প্রকাশনা থেকে বাজারে আসবে পুরো উপন্যাসটি। রকমারির প্রতি শনিবারের এ বিশেষ আয়োজনে আজ ছাপা হলো ২৮তম পর্ব।
[পূর্ব প্রকাশের পর]
বাবার সঙ্গে খেলছে শাহজাদা মুস্তফা। অনেক দিন বাবাকে পায়নি। আজ যেন পুরোটাই পুষিয়ে নিচ্ছে। ‘আনন্দ যা করার এখনই করে নাও বেটা। কারণ এরপর আর সুযোগ মিলবে না। অটোমানদের পরবর্তী ত্রাতা তোমাকেই হতে হবে।’ ছেলের সঙ্গে খেলতে খেলতে মনে মনে বললেন সুলতান।
কিছুক্ষণ বাদেই হেতিজা সুলতান এলেন মুস্তফাকে নিতে। ওর মক্তবের সময় হয়ে গেছে। মুস্তফার বয়স এখন সাড়ে নয় বছর। এর মধ্যেই সে কোরআন তেলাওয়াত, গণিত এবং বর্শা নিক্ষেপে বেশ দক্ষ হয়ে উঠেছে। শুধু তাই নয় খেলাধুলায়ও সে অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি পারঙ্গম। ভালো করে স্নেহের দৃষ্টিতে মুস্তফার দিকে তাকালেন সুলেমান। অবিরাম লাফাচ্ছে সে। মুস্তফার মাথার চুল অবিকল তার মায়ের মতো উজ্জ্বল। আচার-আচরণেও অনেকটাই মায়ের মতো। খুব একটা বাপঘেঁষা নয়। তবে কাছে পেলে বাবাকে ছাড়তে চায় না সেও। নিজের সন্তান সুলেমানের মতো দেখতে হয়নি। এ নিয়ে সুলতানের মনে গোপন একটা আফসোস আছে। তবে সেই আফসোসটা তিনি ছাড়া আর কেউ জানে না! কিন্তু কিছু করার নেই। এটাই যে এখানকার নিয়ম!
টিউলিপ বাগানের দিকে একা একাই হাঁটছিলেন সুলতান সুলেমান খান। গ্রীষ্ম বুঝি এসেই পড়ল। বছরের এই সময়টাতে তুর্কীরা সাধারণত যুদ্ধে ব্যস্ত থাকে। সুলতান সেলিম খান থাকাকালে প্রতি বছর এই সময়েই অভিযানে যাওয়া হতো। তবে এবারের হিসাবটা একটু ভিন্ন। সবেমাত্র সফল অভিযান থেকে ফিরেছে ওরা। তা ছাড়া এবারের যুদ্ধযাত্রা একটু বেশিই লম্বা হয়ে গেছে। তাই সুলতান বলে দিয়েছেন এ বছর আর কোনো যুদ্ধ নয়। কিন্তু ক’দিন বাদেই শিকারে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। এর মধ্যেই শিকারের প্রস্তুতিও গ্রহণ করেছেন। ইব্রাহিম আর মাতরাকচিকে সঙ্গে নিয়ে মাঠের ভিতর তীর ধনুক আর বর্শা চালানোর অনুশীলন করেন। প্রস্তুতির সুবিধার জন্য মাঠের ভিতর কিছু মূর্তি বসানো হয়েছে। এই মূর্তিগুলো বেলগ্রেড থেকে নিয়ে আসা মালামালের সঙ্গে ছিল। সবই গ্রীক দেবদেবীদের। এগুলোকে লক্ষ্য হিসেবে ব্যবহার করতে অন্যরকম লাগে সুলেমানের। এই অভিনব ধারণাটা অবশ্য এসেছে পারগালি ইব্রাহিমের মাথা থেকে। নিজের ছোঁড়া বর্শায় যখন জিউসের মূর্তি দুই ভাগ হয়ে গড়াগড়ি খায় সেটা আনন্দ লাগার মতো বিষয় বৈকি!
আয়শা হাফসা সুলতান প্রাসাদের বরান্দায় বসেছিলেন। দূর থেকে মাকে দেখতে পেয়ে সেদিকে এগিয়ে গেলেন সুলতান। মায়ের হাতে চুমু খেয়ে হাতটা নিজের কপালে ঠেকালেন।
‘আল্লাহ তোমায় অনেক অনেক বছর বাঁচিয়ে রাখুক।’
‘কেমন আছো, আম্মা?’
‘আছি। বুড়ো হয়ে যাচ্ছি না। এখন কী আর ভালো থাকা যায়? দিন যত যাবে ততই খারাপ থাকতে হবে।’
‘কী যে বল না আম্মা। কে বলেছে তুমি বুড়ো হয়ে যাচ্ছো? কী এমন বয়স হয়েছে তোমার?’
‘বয়স হয়নি? বলছিস কিরে! আমার নাতি বড় হয়ে যাচ্ছে! কদিন বাদে ওরই বিয়ে হবে!’
হাসতে হাসতে বললেন আয়শা।
একজন দাসী এসে কয়েকটা ফলের বাটি, শরবত এবং গোলাপজল দিয়ে গেল।
‘আমার সুলতানের কী খবর শুনি। রোডস তো জয় করা হলো। এবার কী? মাথায় কোনো পরিকল্পনা আছে?’
‘জান তো আমি বলে দিয়েছি এ বছর আর কোনো যুদ্ধ হবে না। অনেক সৈন্য হারিয়েছি। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণটা কম নয়। রাজকোষের অবস্থা যদিও খারাপ নয়, তবু সব গুছিয়ে নেওয়ার জন্য একটু সময় দরকার।’
‘এটা তুই মন্দ বলিসনি। সবকিছুর পেছনেই দরকার শক্ত পরিকল্পনা। নইলে কোনো কাজেই সাফল্য আসে না।’
‘ঠিক বলেছো আম্মা। তবে আরেকটা বিষয় আছে।’
‘সেটা কী?’
‘না থাক।’
সুলতান থেমে গেলেন।
‘অস্বস্তি কেন? মায়ের কাছে কোনো দ্বিধা রাখতে নাইরে বাপ বলে ফেল।’
‘আসলে এখনই আরেকটা অভিযানের চিন্তা আমাকে অসুস্থ করে দিচ্ছে।’
সুলতানের কণ্ঠে দীর্ঘশ্বাস।
‘এখনই কেন হবে? সময় নে। তবে একটা কথা ভুলে গেলে চলবে না যে সুলতান ইসলামের পতাকা বইতে চায় না, সৈন্যরাও কিন্তু তাকে সুলতান হিসেবে চাইবে না। এটাই অটোমানদের সবচেয়ে বড় ঐশ্বর্য।’
শরবতের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে বললেন আয়শা।
‘আমি সেটা জানি আম্মা। আমি কিন্তু পতাকার জন্য জীবনও দিতে পারি। যুদ্ধ তো কোনো বিষয়ই না।’
‘তোর প্রতি সে বিশ্বাস আমার আছে।’
‘তুমি শুধু দোয়া করো।’
‘তাতো বটেই। আরেকটা কথা বাবা।’
‘বল আম্মা।’
‘আমি ভাবছি একটু মানিসা থেকে ঘুরে আসব। এখানে আর ভালো লাগছে না।’
‘কেন আম্মা? কোনো সমস্যা?’
‘না। সমস্যা হবে কেন? এমনি। তুই ছিলি না অনেক দিন। তাই চিন্তায় ছিলাম। এখন তুই ফিরেছিস। আমি নিশ্চিন্ত আছি। ভাবলাম বেড়িয়ে আসলে মন্দ হয় না।’
‘তাহলে আমি শিকার থেকে ফিরলে ঘুরে এসো। ’
‘আচ্ছা। ফল নে।’
পুত্রের দিকে ফলের বাটি এগিয়ে দিয়ে বললেন আয়শা। মায়ের কথা রাখলেন সুলতান। দুটো আঙুর মুখে পুরলেন তিনি।
‘আরেকটা কথা তোকে বলব বলব করেও বলা হয়নি।’
‘কোন কথা?’
‘হেতিজার কথা।’
‘কেন? হেতিজার আবার কী হলো?’
‘কিছু হয়নি। বয়স হয়ে যাচ্ছে না ওর? অল্প বয়সে বিধবা হয়েছে। ওর দিকে তাকানোই যায় না। এভাবে আর কতদিন?’
‘তাই তো। ওর বিয়ের ব্যাপারটা তো আমার মাথায়ই আসেনি। তুমি কী ওর বিয়ের কথা বলছো?’
‘এছাড়া আর কী বলব?’
‘ওর সঙ্গে কথা বলেছো? ওর কী মতামত?’
‘ও আবার কী বলবে? আমি ওর মা। আমি কী ওর কষ্টটা বুঝি না? আজকাল কেমন যেন মন খারাপ করে থাকে। উদাস উদাস। এসব দেখলে কী আর ভালো লাগে। তা ছাড়া ওকে নিয়ে তো আমাদেরই ভাবা উচিত তাই না?’
‘তা অবশ্য ঠিক। ’
‘তোমার ভাবনায় কী তেমন কেউ আছে নাকি?’
‘নাহ। সেরকম কেউ নেই। তবে খুঁজতে হবে।’
‘ঠিক আছে তাহলে আমি খোঁজ করব। তুমিও কিছু পেলে আমাকে জানাবে।’
‘তাড়াতাড়ি করতে হবে কিন্তু।’
‘আচ্ছা সমস্যা নেই।’
হুররেম খাতুনের স্বপ্ন আর বাধা মানে না। এত বড় ঘর এত সুযোগ-সুবিধা তার ওপর আবার শাহজাদার মা হচ্ছেন— সব যেন স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। সেই স্বপ্নে আরেকটু রং ছড়ানোর জন্যই বুঝি হুররেমের ঘরে উঁকি দিলেন হেতিজা সুলতান। হুররেমকে দেখতে এসেছেন তিনি। হুররেম ছুটে এসে কুর্নিশ করতে চাইল হেতিজাকে। হেতিজা হাত ধরে মানা করলেন। হুররেমকে বিছানায় বসালেন।
‘কেমন আছো?’
‘জি। ভালো।’
হুররেমের পেটের কাছে হাত রাখলেন হেতিজা। মুচকি হেসে বললেন—
‘ভিতরের মানুষটার কী খবর?’
‘আর বল না..’
‘কেন কী হয়েছে?’
‘ভীষণ রকম দুষ্টু হবে। সারাক্ষণ শুধু লাথি মারে।’
‘তাই নাকি!’
হাসতে হাসতে বলল হেতিজা।
কিছুক্ষণ গল্প করার পর হাতের মুঠো থেকে একটা তাবিজ বের করল সে। তারপর সেটা হুররেমের হাতে দিল।
‘এটা নাও। এটা খুব পবিত্র জিনিস। এটা সঙ্গে রাখলে তোমার ওপর কারও নজর লাগবে না।’
খুশিতে চোখ চকচক করে উঠল হুররেমের। খুশি হওয়ার কারণ দুটি। প্রথমত সুলতানের বোন তাকে দেখতে এসেছে। আবার সেই সঙ্গে তার সুবিধা অসুবিধার কথা ভেবে তাবিজও নিয়ে এসেছে। হেতিজার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল হুররেম।
‘অনেক ধন্যবাদ। এটা আমি সব সময় নিজের কাছে রাখব।’
‘তাই করো। আর তা ছাড়া মা তোমার জন্য পাহারা সুযোগ সুবিধা সবই দ্বিগুণ করে দিয়েছেন।’
‘আমি তার কাছেও কৃতজ্ঞ সুলতানা। তাকেও ধন্যবাদ জানাবেন।’
‘নিশ্চয়ই। নিজের দিকে খেয়াল রেখো।’
‘দোয়া করবেন আমার জন্য।’
আজ রাতে পারগালির সঙ্গে খাবার খেতে বসেছেন সুলতান। হ্যাডক, চিংড়ি এবং আরেক রকম সামুদ্রিক মাছ রান্না হয়েছে। সকালেই বসফরাস থেকে ধরা হয়েছে এগুলো। বেশ তৃপ্তি ভরে খেলেন দুজনেই। এরপর এলো হোসাফ। সঙ্গে সাইপ্রাস ওয়াইন। সুলতানের মদের অভ্যাস নেই। তবে মাঝে মাঝে পান করার ক্ষেত্রে উত্তেজনা অনুভব করেন। এর বাইরে তার জীবনে খুব বেশি বৈচিত্র্য নিয়ে। একেবারে ঘড়ি ধরে নিয়ম মেনে চলে জীবন। কখনো কখনো সবকিছু খুব একঘেয়ে লাগে তার। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে এভাবেই চলে এসেছে সুলতানদের জীবন।
খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠার আগেই তৈরি থাকেন একজন নাপিত। নাপিতের কাছ থেকে মাথা কামানোর পর গোসল। তারপর পোশাক বিভাগের প্রধান পোশাক নিয়ে হাজির হন। সব পোশাকে থাকে ঘৃতকুমারী গাছের সুবাস। তারপর মাথায় বেঁধে দেওয়া হয় পাগড়ি। সপ্তাহের পাঁচ দিন তিনি সকালে উঠে তার রাজপরিষদের সঙ্গে ফজরের নামাজ আদায় করেন। শক্রবার তিনি হায়া সাফিয়া মসজিদে প্রধান উজিরের ইমামতিতে রাজপ্রাসাদের সবাইকে নিয়ে জুমার নামাজ পড়েন। প্রতিদিন বিকালের দিকে একটু বিশ্রাম নেন। তবে ব্যস্ততা থাকলে ঘুমের সময় থাকে না। কিন্তু অটোমান রাজপ্রাসাদের রীতি অনুসারে সুলতান ক্লান্ত হন বা না হন, তাকে ঘুমাতেই হয়। শুধু তাই নয়, সুলতান যেন নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারেন এজন্য ছয়-সাত জন বোবাকালা রক্ষী সব সময় তাকে পাহারা দেয়।
বিশেষ কোনো আয়োজন হলেই সুলতানের সঙ্গী হন পারগালি ইব্রাহিম। এটা নতুন কিছু নয়। সেই ছোটবেলা থেকেই যেন সুলেমানের জীবনে এ এক অলিখিত নিয়মে পরিণত হয়েছে। রোডস অভিযানের সময় তারা একই তাঁবুতে ঘুমিয়েছেন। নাওয়া-খাওয়া সব একসঙ্গেই সেরেছেন। এমনকি একে অন্যের কাপড়-চোপড় পর্যন্ত ব্যবহার করেছেন। এ নিয়ে রাজপরিষদের অনেকেই দারুণ ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে ওঠে। এমনিতেই খাস কামরা প্রধান হওয়ার পর সবাই বলেছিল একজন ক্রীতদাসকে কেন এ দায়িত্ব দেওয়া হবে। তেমনি যুদ্ধের সময়ও ক্রীতদাসের সঙ্গে প্রকাশ্যে সুলতানের এমন ওঠাবসা সহজভাবে নিতে পারেনি অনেকেই। কিন্তু কিছু করার নেই। ইব্রাহিম সুলতানের বন্ধু। স্ত্রী, মা এমনকি উজিরের সঙ্গে যে বিষয়টা নিয়ে সুলতান আলাপ করতে পারেন না বা করেন না, ইব্রাহিমের সঙ্গে সেটাও বলে ফেলেন নিমিষে। রাজ্য পরিচালনার এই সময়ে এসে সুলতান ইব্রাহিমের ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল। অনেক ক্ষেত্রে পীরে মেহমুদ পাশার চেয়েও ইব্রাহিমের পরামর্শ বেশি নেন সুলতান। এই একটা জায়গায় অটোমানদের আলাদা খ্যাতি আছে। একজন খ্রিস্টান দাস নিজের মেধা দিয়ে আর আত্মবিশ্বাস দিয়ে ইসলামিক সাম্রাজ্যের এত উপরে উঠে আসতে পারে। বিজয়ী ফাতিহ বলেছিলেন ‘অটোমান সাম্রাজ্য হলো একটা বাতির মতো। যেখানে পিতা থেকে পুত্রের দায়িত্ব হলো পৌত্তলিকদের অন্তরে ইসলামের আলো জ্বালানো।’
সুলতান আর ইব্রাহিম নিবিষ্ট মনে সাইপ্রাসের তরল উপভোগ করছে। ইব্রাহিমের জন্য ভায়েলিন আনা হয়েছে। দুর্দান্ত বাজায় ইব্রাহিম। আরেক চুমুক দিতে দিতে সুলতান বললেন—
‘খাওয়াটা কেমন হলো ইব্রাহিম? তোমার কী ভালো লাগেনি?’
‘না। তা কেন হবে। আমি দারুণ উপভোগ করেছি। আর অনেক দিন পর এটাও ভাল্লাগছে।’
সুরার পাত্রটা উঁচিয়ে সুলতানকে দেখালেন ইব্রাহিম।
‘হুমম। আচ্ছা ইব্রাহিম, তোমার কখনো আফসোস হয় না?’
‘কেন বলুনতো জাঁহাপনা?’
‘এই যে সব ছেড়েছুড়ে এখানে পড়ে আছো। আত্মীয়স্বজন-রক্ত কারো কোনো খোঁজ নেই।’
‘তা হবে কেন জাঁহাপনা। আপনি এবং আপনারাই তো আমার সব। আজকের রাতের কথাই ধরুন না। এত ভালো ভোজ, এত ভালো মদ। আফসোসের কী আছে? আর আপনার এমন ভালোবাসা ক’জনের ভাগ্যে জুটেছে? আমি তো এক প্রকার মহাসৌভাগ্যবান মানুষ। বাইরের একজন হয়েও আপনার খাস কামরা প্রধান হতে পেরেছি।’
‘কিন্তু কখনো তোমার অন্য কিছু হতে ইচ্ছে করেনি। মনে হয়নি ডাকাতদের কবলে না পড়লে তোমার জীবন কোথায় যেত? কী করতে তখন?’
‘আসলে আমি জানি না কেমন হতো। কারণ এসব ভাবার আগেই তো পাল্টে গেছে আমার জীবন।’
‘ছোটোবেলার কথা মনে নেই কিছু?’
‘আছে তো। অনেক কিছুই মনে আছে। সকাল, দুপুর, বিকাল, রাত সারাবেলা মাছ খেতাম। বাবা মাছ ধরতেন। সঙ্গে আমি আর আমার ভাইও। বাবার সঙ্গে সমুদ্রে যেতাম। আবার সঙ্গেই সৈকতে বসে জাল বুনায় সহযোগিতা করতাম।’
‘খুব মজার ছিল তাই না?’
‘হয়তো। হয়তো আমি এখনও সেখানেই থেকে যেতাম। মাছ ধরতাম আর জাল বুনতাম। এখানে বরং ভালোই আছি। রাজকীয় হালে। সুলেমানের এত কাছাকাছি।’
একটা দীর্ঘশ্বাস অনুভব করল ইব্রাহিম। কিন্তু সেটি বেরুতে দিলেন না। আরেকটু পানীয় গিলে ফেললেন ঢোক করে।
‘কেন তোমার মনে হয় না যে জীবনটা আরও সাধারণ হলে ভালো হতো। এত নিয়ম, এত দায়িত্ব, রাজসভা, বিরক্তি আসে না।’
‘না।’
‘জীবনটা সাধারণ হলে কেমন হতো?
‘হয়তো অনেক বেশি মূল্যহীনও হতো।’
‘তার মানে কী বলতে চাও। এইসব যুদ্ধবিগ্রহ, রাজনীতি, খুনোখুনি এসব তোমার ভালো লাগে।’
‘হুজুর, ভালো লাগে সেটাও কিন্তু বলিনি। কিন্তু আপনার পাশে থাকতে ভালো লাগে। আপনার পাশে থেকে ইতিহাসের অংশ হতে পেরে ভীষণ ভালো লাগছে।’
‘বাবা-মা’র কথা মনে পড়ে না।’
‘পড়ে। কিন্তু খুব বেশি না।’
‘এটা বাজাবে না?’
‘বাজাব।’
‘হুমম বাজাও।’
‘এখনই?’
‘হুমম।’
ইব্রাহিম ভায়োলিন বাজাতে শুরু করে। চারদিকে সুনসান নীরবতা। অনেক দূর পর্যন্ত চলে যাচ্ছে ভায়োলিনের সুর। হঠাৎ করেই ইব্রাহিমকে থামিয়ে দিলেন সুলেমান।
‘একটু থামো ইব্রাহিম! একটু!’
সুলতানের নেশাতুর কণ্ঠ যেন জড়িয়ে আসছে।
‘আপনার কী খারাপ লাগছে সুলতান।’
‘উহু উহু। আমি ঠিক আছি। তোমাকে একটা কথা বলতে চাই।’
‘কী কথা?’
‘তুমি কী আমার বোন হেতিজা সুলতানকে চেন?’
‘চিনি তো। ছোটবেলা থেকেই দেখেছি উনাকে।’
‘এ কয়দিনের মধ্যে দেখোনি।’
‘মাফ করবেন হুজুর। উনি সুলতানা। ওভাবে দেখিনি। কখনো দেখা হলেও কুর্নিশ করে কেটে পড়েছি। তা হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন?’
‘আছে।’
‘বলুন না।’
‘ওর একটা বিয়ে হয়েছিল জানো তুমি?’
‘জানি জাঁহাপনা।’
‘এত অল্প বয়সে বোন আমার বিধবা হয়ে গেছে। ওর দিকে তাকানো যাচ্ছে না। ওর একটা বিয়ে দেওয়া দরকার। সেজন্য আমি বিশ্বস্ত কাউকে খুঁজছি।’
এবার ইব্রাহিমের কাছে পরিষ্কার হলো ঠিক কী কারণে হেতিজার কথা জিজ্ঞেস করেছেন সুলতান। তাহলে কী সুলতান তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিতে চাচ্ছেন। ভাবতে গিয়ে চমকে উঠল ইব্রাহিম। এটা কেমন কথা? সামান্য দাস হবে রাজকন্যার পতি। নিজের ভাবনার লাগাম টানলেন ইব্রাহিম।
‘হুজুর কী কাউকে পেয়েছেন?’
‘না এখনো পাইনি। তোমার ভাবনায় কেউ আছে?’
‘সে রকম কাউকে তো দেখছি না। তবে আপনি বললে খোঁজ লাগাব।’
‘না। খোঁজ লাগাতে হবে না। আমার কাছে খোঁজ আছে। কিন্তু সে রাজি হয় কিনা ভাবছি।’
‘কী বলছেন আপনি হুজুর। হেতিজা সুলতানের সম্বন্ধকে কে অস্বীকার করবে। তিনি রূপে গুণে অনন্যা। সুবিশাল অটোমান সাম্রাজ্যের শাহজাদী তিনি। তার সঙ্গে সম্পর্ক করতে কে না চাইবে?’
‘তুমি বলছো ইব্রাহিম?
‘জি হুজুর।’
‘নিশ্চিত তো’
‘আলবৎ।’
‘তাহলে তুমি রাজি?’
সহজভাবে তাকিয়ে আছেন সুলেমান। ইব্রাহিমের হাত থেকে পড়ে গেছে ভায়োলিন। সুলতান কী বলছেন!
পরবর্তী পর্ব আগামী শনিবার