জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও নতুন নতুন আবিষ্কার প্রতিনিয়ত পৃথিবীকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বের অভূতপূর্ব বিকাশ ও আধুনিকায়নের ক্ষেত্রে জ্ঞানের অবদান অনস্বীকার্য। সময়ের ধারাবাহিকতা ও আবিষ্কারের নেশায় মুসলিম জ্ঞানসাধকরা পিছিয়ে ছিলেন না। তারা নিজ মেধা-মননে বিশ্বদরবারে নিজেদের উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। বিশ্বখ্যাত কয়েকজন মুসলিম জ্ঞানসাধক ও বিজ্ঞানীর কথা লিখেছেন- মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ। আজ রইল শেষ পর্ব।
মুসা আল-খাওয়ারিজমি
পুরো নাম আবু জাফর মুহাম্মদ বিন মুসা আল-খাওয়ারিজমি। তাঁকে ‘বীজগণিতের জনক’ বলা হয়। তিনি ছিলেন একজন ফার্সি বহুবিদ্যা বিশারদ; যিনি গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান ও ভূগোলের ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে প্রভাবশালী অবদান রেখেছেন। উজবেকিস্তানের খোরাসান প্রদেশের খাওয়ারিজমিতে আনুমানিক ৭৮০ সালে তাঁর জন্ম। উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পর মৃত্যু পর্যন্ত খলিফা মামুনের গ্রন্থাগার ‘বাইতুল হিকমাহ’-এর প্রধান গ্রন্থাগারিক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সেখানে বিজ্ঞান ও গণিত বিষয়ে গবেষণা করতেন। বীজগণিতে তাঁর সবচেয়ে বড় অবদান ‘দি কম্পেন্ডিয়াস বুক অব ক্যালকুলেশন বাই কমপ্লেশন অ্যান্ড ব্যালিন্সিং’ নামক অমর বই। এর মূলকপি আজও অক্সফোর্ডে সংরক্ষিত। তাঁর লেখা ‘আল জাবর ওয়াল মোকাবিলা’ থেকে বীজগণিতের ইংরেজি নাম ‘আল-জেবরা’ শব্দের উৎপত্তি। তিনিই প্রথম পাটিগণিতে (০) শূন্যসহ অন্যান্য সংখ্যার ব্যবহার শুরু করেন। তাঁর মাধ্যমে ইউরোপীয়রা শূন্যের ব্যবহার শেখে। তাঁর লেখা বইয়ের সংখ্যা অনেক। এগুলোর অধিকাংশ ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। অনেকগুলোর অস্তিত্ব এখন পাওয়া যায় না। আনুমানিক ৮৫০ সালে ৭০ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়।
ইবনে খালদুন
পুরো নাম আবু জায়েদ আবদুর রহমান ইবনে মুহাম্মদ ইবনে খালদুন আল-হাদরামি। তিনি আধুনিক সমাজবিজ্ঞান, ইতিহাস ও অর্থনীতিশাস্ত্রের জনকদের অন্যতম। ২৭ মে ১৩৩২ সালে তিউনিশিয়ার তিউনিসে তাঁর জন্ম। জীবনের বড় একটি অংশ উত্তর আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে পার করেন তিনি। এরপর আন্দালুসে চলে যান। সেখানে কিছুদিন অবস্থান করে তিউনিসিয়া ফিরে আসেন। তাঁর জীবন অনেক ঘটনাবহুল। তিউনিসিয়ায় যখন বাস করেন, তখন সে অঞ্চল ছিল রাজনৈতিকভাবে খুবই অস্থিতিশীল। ক্ষমতার পালাবদল দ্রুত হচ্ছিল। ইবনে খালদুনও বিভিন্নভাবে এতে প্রভাবিত হন। তিনি তাঁর জীবনী অসাধারণভাবে লিখে গেছেন। ইমাম ফখরুদ্দিন রাজির মেটাফিজিক্সকে ঐতিহাসিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেন। তাঁর লেখা বইয়ের সংখ্যা খুব বেশি নয়; তবে বিখ্যাত বই ‘কিতাবুল ইবার’ তাঁকে জনপ্রিয় করে তোলে। জ্ঞানের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সোশ্যাল অ্যান্টলজির প্রতিষ্ঠা তাঁকে বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসে প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে। ১৯ মার্চ ১৪০৬ সালে মিসরের কায়রোতে তাঁর মৃত্যু হয়।
ইবনে সিনা
পুরো নাম আবু আলী আল হুসাইন আবদুল্লাহ ইবনে সিনা। তাঁকে ‘আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান ও ক্লিনিক্যাল ফার্মাকোলজির জনক’ বলা হয়। মাত্র ১৯ বছর বয়সে তিনি বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, অর্থনীতি, রাজনীতি, গণিতশাস্ত্র, জ্যামিতি, ন্যায়শাস্ত্র, খোদাতত্ত্ব, চিকিৎসাশাস্ত্র ও কাব্য-সাহিত্য ইত্যাদি বিষয়ে অসীম জ্ঞানের অধিকারী হন। ৯৮০ সালে উজবেকিস্তানের বিখ্যাত শহর বোখারার আফশোনা গ্রামে তাঁর জন্ম। বাল্যকাল থেকেই তিনি অসামান্য মেধার অধিকারী ছিলেন। মাত্র ১০ বছর বয়সে পবিত্র কোরআন মুখস্থ করেন। ১৬ বছর বয়সে চিকিৎসাবিদ্যায় আত্মনিয়োগ করেন। তিনি বিনামূল্যে অসহায় রোগীদের চিকিৎসা করতেন। এতে দ্রুত তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। তিনি চিকিৎসায় নতুন নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করতে থাকেন। ১৮ বছর বয়সে একজন পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসকের মর্যাদা লাভ করেন। রোগ নিরাময়ে তিনি ওষুধের ওপর গুরুত্ব দিতেন। যৌবনে খাওয়ারিজমের তাবারিস্তানের মামুনীয় আমিরের ব্যক্তিগত চিকিৎসক হন। ৯৯৭ সালে তিনি তাঁকে সুস্থ করে তোলেন। আমির কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তাঁর জন্য রাজদরবারের লাইব্রেরি উন্মুক্ত করে দেন। মাত্র অল্প কয়েক দিনে তিনি অসীম ধৈর্য ও অগাধ একাগ্রতার সঙ্গে লাইব্রেরির সব বই মুখস্থ করে ফেলেন। হায়ারসানিয়ায় অবস্থানকালে তিনি তাঁর বিশ্ববিখ্যাত বই ‘আল কানুন ফিত তিব্ব’ লিখতে শুরু করেন। ১৪ খণ্ডের এ বইটি তাঁকে অমর করে রেখেছে। যাকে ‘চিকিৎসাশাস্ত্রের বাইবেল’ বলা হয়। ১০৩৭ সালে ৫৭ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়।
ইবনুল হাইসাম
পুরো নাম আবু আলী আল হাসান ইবনে আল হাসান ইবনুল হাইসাম। তাঁকে ‘আলোকবিজ্ঞানের জনক’ বলা হয়। পশ্চিমারা তাঁকে ‘আল হ্যাজেন’ নামে চেনেন। তিনি ছিলেন আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান পদ্ধতির প্রবক্তা। এ ছাড়া অ্যানাটমি বা অঙ্গ ব্যবচ্ছেদ বিজ্ঞান, জোতির্বিজ্ঞান, গণিত, চিকিৎসাবিজ্ঞান, প্রকৌশলবিদ্যা, চক্ষুবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, অর্থনীতি, দর্শন এবং সর্বোপরি বৈজ্ঞানিক গবেষণার পদ্ধতিগত উন্নয়নে তাঁর ছোট-বড় অবদান রয়েছে। ৯৬৫ সালে ইরাকের বসরা শহরে তাঁর জন্ম। শিক্ষা শেষে বসরা শহরের গভর্নর নিযুক্ত হন। তখন বিজ্ঞান ও অন্যান্য গবেষণায় মনোনিবেশ করেন তিনি। পদার্থবিজ্ঞানের ওপর তাঁর লেখা সাত খণ্ডের বই ‘আল মানাজির’ বা ‘বুক অব অপটিকস’কে নিউটনের প্রিন্সিপিয়া ম্যাথম্যাটিকার সমকক্ষ ধরা হয়। যা এখনো বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পাঠ্য। তাঁর সম্মানে চাঁদের একটি জ্বালামুখের নাম ‘আল হ্যাজেন’ রাখা হয়েছে। অ্যারিস্টটল-পরবর্তী সময়ে এত বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী অল্প কজন বিজ্ঞানীর মধ্যে তিনি অন্যতম। তাঁর লেখা বইয়ের সংখ্যা দুই শতাধিক। যার মধ্যে ৯৬টি বৈজ্ঞানিক। তবে সেগুলোর মধ্যে বর্তমানে সামান্য বা সম্পূর্ণরূপে টিকে আছে মাত্র ৪৬টি। আনুমানিক ১০৪০ সালে প্রায় ৭৫ বছর বয়সে মিসরের কায়রোতে তাঁর মৃত্যু হয়।
ইমাম গাজালি
পুরো নাম আবু হামিদ মুহাম্মদ ইবনে মুহাম্মদ আত-তুসি আল-গাজালি। তিনি মুসলিম বিশ্বের অন্যতম একজন শিক্ষাবিদ। আনুমানিক ১০৫৮ সালে ইরানের খোরাসানের তুস নগরীতে তাঁর জন্ম। তাঁর পিতা মুহাম্মদ তখনকার সময়ে একজন স্বনামধন্য সুতা ব্যবসায়ী ছিলেন। গাজল অর্থ সুতা। নামকরণের এ সামঞ্জস্যতা তাঁর বংশকে ‘গাজ্জালি’ নামে পরিচিত করেছে। কারও মতে, তিনি হরিণের চোখবিশিষ্ট অপরূপ সুদর্শন ছিলেন। গাজাল অর্থ হরিণ। তাই বাবা-মা তাকে শৈশবে আদর করে ‘গাজ্জালি’ বলে ডাকতেন। উভয় বর্ণনানুসারে তাঁকে গাজালি বা গাজ্জালি বলা হয়। তিনি তাঁর সময়ে ইরানের শিক্ষা নিয়ে বেশ কাজ করেন। জ্ঞান-অন্বেষণের জন্য বেশ কিছু দেশ ভ্রমণ করেন। ছোটবেলায়ই তিনি তাঁর বাবাকে হারান। তাঁর শিক্ষাজীবন ও বাল্যকাল তুস নগরীতে কাটে। মুসলিম দর্শন, ফিকহ, ধর্মতত্ত্ব বিষয়ে তিনি সর্বকালের স্মরণীয় মনীষীদের একজন। ইমাম গাজালির আধ্যাত্মিক জ্ঞানের প্রতি ছিল অগাধ তৃষ্ণা। নেজামিয়া মাদরাসার অধ্যাপনা তাঁর এ জ্ঞান পিপাসা নিবারণ করতে পারেনি। তাই অল্প সময়ে অধ্যাপনা ছেড়ে সৃষ্টি-রহস্যের সন্ধানে বেরিয়ে পড়েন। ১০ বছর তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল ভ্রমণ করেন। বিভিন্ন এলাকায় সাধারণ মুসলমানদের সঙ্গে মেলামেশা করে তাদের জীবনধারা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। দীর্ঘকাল সাধনার মাধ্যমে নিজের আত্মা পরিশুদ্ধ করতে থাকেন। তিনি ইসলামের আকিদা-বিশ্বাস ও মূলনীতিগুলোর যুক্তিসম্মত ব্যাখ্যা দেন। পুরোনো জরাজীর্ণ শিক্ষাব্যবস্থার সমালোচনা করেন। একটি নতুন শিক্ষাব্যবস্থার পরিকল্পনা করেন। সে সময় পর্যন্ত মুসলমানদের মধ্যে যে শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলন ছিল, তার মধ্যে বেশ ত্রুটি দেখা যাচ্ছিল। ইমাম গাজালি এ ভুলগুলো দূর করে সামঞ্জস্য ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। সমকালীন লোকেরা তাঁর এ মহান কর্মকাণ্ডের ঘোর বিরোধিতা করে। অবশেষে সব মুসলিম দেশে এ নীতির স্বীকৃতি লাভ করে। পরবর্তীকালে যতগুলো শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়, তার সবই তাঁর নির্ধারিত পথেই প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানকাল পর্যন্ত আরবি মাদরাসাগুলোর কারিকুলামে যেসব বই অন্তর্ভুক্ত, এর প্রাথমিক নকশা তাঁর হাতে তৈরি। তিনি জনসাধারণের নৈতিক চরিত্র পূর্ণরূপে পর্যালোচনা করেন। ওলামা-মাশায়েখ, আমির-বাদশাহ ও জনসাধারণের প্রত্যেকের জীবনপ্রণালি অধ্যয়নের সুযোগ পান। নিজে পরিভ্রমণ করে প্রাচ্যজগতের একটি অংশের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেন। তাঁর লেখা ‘এহইয়াউ উলুমিদ্দিন’ বইটি সেই অধ্যয়নের ফল। ১৯ ডিসেম্বর ১১১১ সালে ৫৩ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়।