একটি শহরের ভূ-প্রাকৃতিক দৃশ্য, স্থাপত্যশৈলী, পরিচ্ছন্নতা, শান্তিপূর্ণ জীবনযাত্রাসহ ইত্যাদি বিষয়ের ওপর তার সৌন্দর্য নিরূপণ করা হয়। কিন্তু বিশেষ কোনো রঙের ব্যবহারে শহরের স্থাপনাগুলোকে যদি রঙিন করা হয় তখন তা হয়ে ওঠে ভিন্নতার অধিকারী। পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে আছে এমন কিছু রঙিন শহর। যাদের রঙের জাদুময়তা সবাইকে মুগ্ধ করে। এমনকি বিশ্বের কাছে আলাদা গ্রহণযোগ্যতাও অর্জন করে। কিছু শহর ইউনেস্কো থেকে পেয়েছে বিশ্ব পর্যটন কেন্দ্রের মর্যাদা। চোখ জুড়ানো এসব শহর কিন্তু এক দিনে তৈরি হয়নি। রঙিন শহরগুলোর রঙিন হয়ে ওঠার পেছনে রয়েছে অজানা কাহিনী। বৈচিত্র্যময় রূপের পসরা সাজিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এসব নগরীর পরিচয় ও রঙিন হওয়ার পেছনে থাকা অজানা কাহিনী নিয়ে আজকের রকমারি।
হলুদ শহর খই আন
পৃথিবীর মানচিত্রে ছোট্ট একটি দেশ ভিয়েতনাম। দেশটির উপকূলীয় এলাকায় অবস্থিত ছিমছাম ছোট্ট শহর খই আন। তেমন কোনো জাঁকজমক না থাকলেও ঐতিহ্যবাহী এই শহরের রয়েছে আকর্ষণ করার মতো অমোঘ শক্তি। এখানকার দালানকোঠায় কেবলই হলুদ রং। দিনের চেয়ে রাতে শহরটি বেশি মনোহরি রূপে আবির্ভূত হয়। নদীর তীরে থাকা নৌকার লণ্ঠনের আলোয় অদ্ভুত সুন্দর দেখায় হলুদ সে শহরটি। ১৭-১৮ শতকে ভিয়েতনামের এই শহরটি বিখ্যাত বাণিজ্যনগরী হিসেবে পরিচিত ছিল। বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে বিদেশিরা এসে এখানে ব্যবসা করত। ইউরোপীয়, চীনা ও জাপানিদের কলোনি গড়ে উঠেছিল। তাই বাড়িগুলো তৈরির সময় ইউরোপীয়, চীনা ও জাপানি স্থাপত্যের সংমিশ্রণ ঘটে। তবে বাড়িগুলোর স্থাপত্যশৈলী যাই হোক, দালানকোঠার বাইরের দেয়ালের রং কিন্তু হালকা হলুদ। এর কারণ বিশ্লেষণে নানারকম মতপার্থক্য দেখা যায়। তবে বাস্তবসম্মত ব্যাখ্যা হলো, হালকা হলুদ রং কম তাপ শোষণ করে। আর ভিয়েতনামের উষ্ণ আবহাওয়ায় বাড়িগুলো শীতল রাখার জন্যই হলুদ রং করা হয়েছে। শহরটিতে পুরনো দিনের তৈরি প্রায় এক হাজার বাড়ি এখনো টিকে আছে। সৌন্দর্যের কারণে ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো ভিয়েতনামের এই হলুদ শহরকে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা দেয়। এর মধ্যে ৮৪৪টি ইউনেস্কোর সংরক্ষিত ইমারতের তালিকায় স্থান পেয়েছে। এই বাড়িগুলো এখন জাদুঘর অথবা শিল্পীদের ওয়ার্কশপ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। নদীর তীরঘেঁষা শহরটি নৌকায় চড়ে ঘুরে ঘুরে দেখা যায়। দোকান ও রেস্তোরাঁগুলো গভীর রাত পর্যন্ত খোলা থাকে।
রঙিন বাড়ির শহর সেইন্ট জন’স
বিশ্বের অনেক শহর আছে, যেগুলোর প্রায় অধিকাংশ ঘিঞ্জি ইমারতে ভরা। সারি সারি দাঁড়িয়ে থাকা ভবনের ঘরগুলোকে কবুতরের খোপ বললেও ভুল হবে না। সেখানে বাহারি রঙে সাজ-সজ্জার দালানকোঠা তো কল্পনারও অতীত। এমন শহরে বসবাসকারী কাউকে সারি সারি রঙিন বাড়ির কোনো শহরে নিয়ে গেলে ভাবতে পারেন, তিনি হয়তো স্বপ্ন দেখছেন। অথচ কানাডার নিউফাউন্ডল্যান্ড প্রদেশে বাস্তবেই আছে সেইন্ট জন’স নামের রঙিন বাড়ির শহর। এই শহরের ইতিহাস শুরু হয়েছে ১৪০০ সালের গোড়ার দিকে। ফান্ড উপসাগরের তীরে অবস্থিত সুন্দর এই শহরটির জনপ্রিয়তার মূল কারণ শহরের কেন্দ্রস্থলে দাঁড়িয়ে থাকা পরিকল্পিত সারিতে রঙিন বাড়ি। চমৎকার স্থাপত্যকলায় শোভিত এই শহরটি পৃথিবীর সেরা রঙিন শহরগুলোর একটি। শহরজুড়ে ছড়িয়ে থাকা এসব বর্ণিল বাড়ির কারণে শহরের একটি অংশের নামই হয়ে গেছে ‘জেলিবিন রো’। যদিও এই নামে সেখানে কোনো রাস্তা নেই, তবু স্থানীয়রা শহরের এই অংশটি বোঝাতে এই নাম ব্যবহার করে। শহরের বর্ণময়তার পেছনে রয়েছে জাহাজের ক্যাপ্টেনদের অবদান। শোনা যায়, দূর সমুদ্র থেকে নিজের বাড়িটিকে যাতে সহজেই চিহ্নিত করা যায় তাই ক্যাপ্টেনরা যে কোনো একটি বিশেষ রঙে নিজেদের বাড়িটিকে রাঙিয়ে তুলত। আর এরই ফলাফল বহু বর্ণিল এই রঙিন শহর। উজ্জ্বল রঙের বাড়িগুলো কুয়াশাচ্ছন্ন পরিবেশেও দূর থেকে ঝলমলেরূপে আবির্ভূত হতো। এই শহরটি তাই পর্যটকদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। কানাডা ঘুরে দেখতে গেলে কেউই এই শহরে যেতে ভোলেন না।
গোলাপি রঙে মোড়া রাজস্থান
গোলাপি তো ভালোবাসার রং। কিন্তু সেই রঙে যদি অফিস, হাসপাতাল, স্কুল, ঘরবাড়ি এমনকি পুরো শহরের ইমারত মুড়ে থাকে তবে কেমন হবে? রাজস্থানের রাজধানী জয়পুর গোলাপি রঙে মোড়া তেমনি এক শহর। রাজস্থানের দক্ষিণ-পশ্চিমে গুজরাট, পশ্চিমে পাকিস্তান, দক্ষিণ-পূর্বে মধ্যপ্রদেশ ও উত্তরে পাঞ্জাব। তেমন কোনো গাছপালা চোখে পড়ে না। পাথরের পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে বাড়ি। জয়পুর শহরের রাস্তার দুই পাশের সুরম্য ভবনগুলোর অধিকাংশই উজ্জ্বল গোলাপি বা ফিঁকে পিঙ্ক বর্ণে রঞ্জিত। দেখে মনে হবে, এই নগরীর নামকরণ সার্থক হয়েছে। বেশ পরিকল্পিত, পরিচ্ছন্ন, সুসজ্জিত, পিঙ্ক বর্ণে বর্ণিল একটি ছিমছাম ছবির মতো নগরী জয়পুর। আজমির থেকে জয়পুর যাওয়ার প্রশস্ত রাস্তার মধ্যভাগের সুদীর্ঘ আইল্যান্ড লতা-গুল্ম ও ছোট বৃক্ষ শোভিত। করবী ও বাগানবিলাস গাছগুলো গোলাপি ও লাল ফুলের সম্ভারে সাজানো। এ ছাড়াও চারপাশে রয়েছে নাম না জানা মরু উদ্ভিদের সমাহার। সে সব ছোট ঝোপ থেকেই বের হয়ে দৌড় দেয় ময়ূর। এখানকার মানুষের পোশাক-পরিচ্ছেদ দেখলেও মনে হবে এটি বুঝি রাজা মানসিংহের রাজ্য। এখানকার নারী-পুরুষের পোশাক বেশ ঝলমলে। রাজস্থানি নারীদের বাহারি গয়না, জগেজাড়া খ্যাতি চুড়ি, শাড়ি, গলার হার, হাতের বাজু, কোমরের বিছা, পায়ের নূপুর সবখানেই ঝিকমিক করে ঝলমলে পাথর আর কাচ।
রং-বেরঙের শাড়ি আর লেহেঙ্গায় অসাধারণ সুন্দরী হয়ে ওঠে রাজস্থানী নারীরা। গোড়ালি পর্যন্ত লম্বা কুচি দেওয়া স্কার্ট, ওপরে টপস, মাথা ও বুকের ওপর ওড়না। পুরুষদের পোশাকেও রয়েছে বৈচিত্র্য। ধুতি, লম্বা ফতুয়ার সঙ্গে রং-বেরঙের পাগড়ি ভিন্ন বৈচিত্র্য দিয়েছে পুরুষকে। আর জাঁদরেলি গোঁফ তো রয়েছেই। ভারতের ‘থর’ মরুভূমির অধিকাংশই রাজস্থানের অন্তর্গত।
যোধপুরের নীল শহর
ভ্রমণপিপাসুদের সন্ধানে থাকে বিশ্বের সব দর্শনীয় স্থানের খোঁজ। পছন্দের সেই তালিকা থেকে বাদ যায় না ভারতের রাজস্থান প্রদেশের যোধপুরের নাম। বিশেষ করে এশিয়ার দক্ষিণাঞ্চলীয় পর্যটকদের তালিকায় যোধপুরের নাম থাকে অবধারিতভাবেই। প্রশ্ন জাগতে পারে যোধপুরের প্রতি সবার এত আকর্ষণ কেন? এর উত্তর খুঁজতে গেলে বেরিয়ে আসবে নানা কারণ। পর্যটকদের কাছে ভারতের রাজস্থান প্রদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর এই যোধপুরের পরিচিতি আছে ‘ব্লু-সিটি’ হিসেবে। শহরটির স্থানীয় দালানকোঠার বড় একটি অংশ নীল রঙে রাঙানো। যেদিকে তাকাবেন শুধু নীল রং-ই চোখে পড়বে। কেউ বলে না দিলেও নীলের ছড়াছড়ি দেখে আপনা থেকেই শহরটির নাম দিয়ে বসবেন ‘ব্লু-সিটি’। কিন্তু বাড়িগুলোর কেন এই নীল রং, তা নিয়ে লোকের মাঝে প্রচলিত আছে নানা আখ্যান। সবচেয়ে জনপ্রিয় ও প্রচলিত আখ্যানটি হলো, এই রঙের ব্যবহার শুরু হয়েছিল ভারতের বিতর্কিত বর্ণপ্রথা থেকে। জানা গেছে, এক সময় যোধপুরের পুরান শহরের ব্রাহ্মণরা নিজেদের অন্যদের থেকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করার জন্য নিজেদের ঘরবাড়িতে নীল রঙ ব্যবহার করতে শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে এটিই যেন সেই এলাকার রীতিতে পরিণত হয়। অন্যরাও রীতিটি অনুসরণ করে নিজেদের বাড়িতে নীল রং লাগাতে শুরু করেন। এভাবে সবার মধ্যেই প্রথাটি অভ্যস্ততায় পরিণত হয়। তবে যোধপুরের এই নীল হয়ে ওঠার পেছনে কেউ কেউ অন্য একটি কারণকে উল্লেখ করেন। উইপোকার হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যও এই প্রথার সৃষ্টি হতে পারে বলে অনেকে মনে করেন। তাদের মতে, এক সময় শহরের ঘরগুলোতে প্রচুর উইপোকার আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে তারা রঙের সঙ্গে পোকানিধনকারী উপাদান মিশিয়ে ঘরে লাগানো শুরু করেন। রঙের ক্ষেত্রে প্রাধান্য পায় সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক বৃক্ষজাত নীল রং। আবার এমনও জানা গেছে, মরুভূমির বুকে নীল রঙের ব্যবহার প্রখর রোদের তাপ থেকে শহরটিকে দিত প্রশস্তির ছোঁয়া। তবে ‘ব্লু সিটি’ হওয়ার পেছনে কারণ যাই হোক, বাহারি নীল রঙের দালান এবং এর সঙ্গে রং-বেরঙের ঐতিহ্যবাহী পোশাকধারী রাজস্থানি নারী-পুরুষের মেলা সহজেই পর্যটকদের মনোযোগ আকর্ষণ করে। এখানকার বাড়ির প্রধান দরজা সাধারণত সব সময় খোলা থাকে। পর্যটকদের সঙ্গে ভ্রমণ গাইড থাকলে যে কোনো বাড়ির ছাদে ওঠে যাওয়া সেখানকার জন্য খুব সাধারণ ব্যাপার। ব্লু-সিটির প্রান্তঘেঁষে পাহাড়ের কোলজুড়ে গড়ে ওঠা শহর থেকে ৪১০ ফুট উঁচুতে দাঁড়িয়ে আছে রাজকীয় মেহরানগর দুর্গ। এ ছাড়াও আছে যশোবন্ত ঠাডা আর উমেইদ ভবন দুর্গ। ভারতের বড় দুর্গগুলোর মধ্যে মেহরানগর দুর্গ অন্যতম। দুর্গে হেঁটে বেড়ানোর জায়গাগুলোতে এমনভাবে ছাওয়া যে, এক উত্তপ্ত মরুভূমির ওপর তৈরিকৃত একটি দুর্গে পর্যটকরা দীর্ঘক্ষণ হেঁটেও ক্লান্ত হয়ে পড়ে না কখনই।
সূর্য রঙা ইজামাল
ম্যাক্সিকোর ইজামাল নামক স্থানকে বলা হয় জাদুর শহর। কিন্তু কি জাদু আছে এই শহরে? এখানকার ঘরবাড়ি দালানকোঠা সবই কী ক্ষণে ক্ষণে রং বদলায় নাকি একাধিক রঙের আদিখ্যেতায় জাদুময় আবহ বিরাজ করে? কৌতূহল যতই তুঙ্গে থাকুক, উত্তর জেনে অবাকই হবেন। কারণ ইজামাল মাত্র একটি রঙেই হয়ে উঠেছে আভিজাত্যপূর্ণ শহর। সূর্য রঙা হলুদে আঁকা এখানকার প্রত্যেকটি বাড়ি। দৃষ্টি জুড়ানো হলুদময় শহরে দৃষ্টি রাখা মানেই উষ্ণ অনুভূতির সৃষ্টি। এখানকার রাস্তঘাটও আলাদাভাবে আপনার মনোযোগ কাড়বে। পাথুরে রাস্তাগুলোর পাশে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে লাইমস্টোন চার্চ এবং সরকারি ভবন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ১৬ শতকের সান এন্থোনিও দ্য পাদুয়ার বাসিলিকা ভবনটি। এটি শহরের মধ্যমণি আর একই সঙ্গে ইতিহাস এবং মিথলজির জন্য বিশ্বখ্যাত।
রঙিন লা বোকা, বুয়েন্স আয়ার্স, আর্জেন্টিনা
হাজার রঙে রঙিন আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েন্স আয়ার্সের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে লা বোকা শহরটি। এই শহরটির খ্যাতির জন্য উজ্জ্বল রঙে রাঙানো ঐতিহ্যবাহী কাঠের বাড়িঘর যেমন বিখ্যাত তেমনি প্রশংসনীয় প্রশস্ত রাস্তাঘাটের কারণে। প্রতিটি দালান আলাদা শৈল্পিক রুচিতে আঁকা হয়েছে। প্রতিটি বাড়ির দেয়াল দেখলে মনে হবে ভিতরে বসবাসকারী মানুষের মনে শিল্পবোধকে এমন উজ্জ্বল রঙে প্রদর্শন করছে।
এ ছাড়াও শহরটি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে উন্মুক্ত জাদুঘরের জন্য। শহরজুড়ে হরেক শিল্পীর বসবাস। বিভিন্ন শিল্পকলা প্রদর্শনী হয় রাস্তার পাশেই। আর তার ব্যাকগ্রাউন্ড হিসেবে তো শহরের রঙিন বাড়িগুলো আছেই। এ ছাড়াও পথে হাঁটতে হাঁটতেই দেখতে পাওয়া যাবে অনেক ম্যুরাল, গ্রাফিতি, ফটোগ্রাফ আর পেইন্টিংয়ের প্রদর্শনী। এসব প্রদর্শনী মূলত শহরের বাসিন্দাদের শৌখিনতার চর্চাকে গতিময় রাখার অন্যতম পন্থা।
কাঠের বর্ণিল বাড়ির শহর লংইয়ারব্যান
কাঠের বর্ণিল বাড়ির শহর নরওয়েজিয়ান দ্বীপপুঞ্জ সালবার্ডের লংইয়ারব্যান। এটি পৃথিবীর সর্ব উত্তরের জনসংখ্যা অধ্যুষিত একটি শহর। পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধে অবস্থিত হওয়ায় শহরটির ভূ-ভাগ প্রায় সারা বছরই তুষারাবৃত থাকে। স্যাঁতসেঁতে হওয়া থেকে রক্ষা পেতে মাটি থেকে কিছুটা ওপরে কাঠের প্লাটফর্মের ওপর ঘরগুলো তৈরি করা হয়। দুই হাজার ৪০ জনের এই শহরে যাতায়াতের জন্য সারা বছরই স্নো-স্কুটারই ভরসা। নৈসর্গিক ভূ-প্রকৃতির পাশাপাশি শহরজুড়ে রঙের ছোঁয়া যে কারও নজর কেড়ে নেয় সহজেই।
নীল দালানের শেফশাওয়ান, মরক্কো
নজরকাড়া নীল দালান আর রাস্তাঘাটের জন্য সুখ্যাতি রয়েছে মরক্কোর উত্তর-পশ্চিমে রিফ পর্বতে অবস্থিত ছোট্ট সুন্দর শেফশাওয়ান শহরটির। ১৯৩০ সালের দিকে সর্বপ্রথম ইহুদিরা তাদের বাড়িগুলোকে নীল রঙে রাঙানো শুরু করে। ইহুদিদের প্রাচীন ইতিহাস আর ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে এখন পর্যন্ত তারা তাদের বাড়িঘর নীল রং করে। ইহুদি ধর্মে নীল রংকে আকাশ ও স্বর্গের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাদের ধারণা এই নীল রং মানুষের আধ্যাত্মিক চেতনা জাগিয়ে রাখে। আবহাওয়ার আর্দ্রতা বেড়ে গেলে শেফশাওয়ানকে নীল জলের অথৈ সমুদ্র মনে হয়। ৪০ হাজার জনসংখ্যা অধ্যুষিত এই শহরের পরিবেশ অত্যন্ত শান্ত।
ঝলমলে বো-ক্যাপ, দক্ষিণ আফ্রিকা
ঝলমলে রঙে রাঙা শহর হিসেবে ঐতিহাসিকভাবে বিখ্যাত দক্ষিণ আফ্রিকার রাজধানী কেপটাউনের সিগন্যাল পর্বতের পাদদেশের বো-ক্যাপ। অঞ্চলটির মূল সৌন্দর্য এর উজ্জ্বল রঙের বাড়িঘর আর পাথরের খোয়া বাঁধানো দীর্ঘ সংকীর্ণ রাস্তা। এখানকার বাড়িগুলো জর্জিয়ান আর ওলন্দাজ স্থাপত্যশৈলীর মিশেলে তৈরি। ইতিহাস বলে ১৬শ ও ১৭শ শতকে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ওলন্দাজরা অনেক দাস কিনে এই অঞ্চলে নিয়ে আসে। ক্রীতদাসরা এখানে কেপ মালয় নামে পরিচিত ছিল। কিন্তু তাদের বসবাসের জন্য পর্যাপ্ত ঘরবাড়ি বানানোর প্রয়োজন পড়ে। ১৭৬০ সালের দিকে অনেক বাড়ি তৈরি করে সে সব ক্রীতদাসদের কাছে ভাড়া দেওয়া হয়।
পরবর্তীতে তারা এই বাড়িগুলো কিনে নানারকম উজ্জ্বল রঙে রাঙিয়ে তোলে। ক্রীতদাসরা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে উজ্জ্বল রংগুলো তাদের স্বাধীনতার প্রকাশ করছে। বো-ক্যাপ জাদুঘরটি শহরের সবচেয়ে পুরনো দালান হিসেবে নিজের মৌলিকত্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এখনো।
রং বাহারি উইলেমস্ট্যাড, কুরাস্যাও
রং বাহারি দালানকোঠা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে উইলেমস্ট্যাড শহরটি। কুরাস্যাওয়ের এই রাজধানী শহরটি এতটাই মনোমুগ্ধকর যে, তা ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের একটি অংশে পরিণত হয়েছে। রঙিন সরকারি ভবন, শপিং মল, রেস্টুরেন্ট, বাণিজ্যিক ভবন, ব্যক্তিমালিকানাধীন রঙিন ঘরবাড়ির পাশাপাশি শহরের খ্যাতি রয়েছে সমৃদ্ধ ইতিহাসের জন্য। ছোট্ট এই শহরে সর্বমোট ৭৫০টি রঙিন কাঠামো রয়েছে। রঙিন শহরটির সামনে স্বচ্ছ জলের উৎসটি শহরটিকে কাল্পনিকতার রূপ দান করেছে।
ধবধবে সাদার শহর সান্তোরিনি
গ্রিসের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত ধবধবে সাদায় নয়নাভিরাম দ্বীপ সান্তোরিনি। এই দ্বীপে রয়েছে ১৫টি ঐতিহ্যবাহী, ছবির মতো সুন্দর গ্রাম। সাদা বাড়িগুলোর ভিতর দিয়ে একেবেঁকে চলা খোয়া বাঁধানো সংকীর্ণ রাস্তা যেন গ্রামের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে দ্বিগুণ। এখানকার যে কোনো বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে উপভোগ করা যায় দ্বীপের আগ্নেয়গিরি আর সূর্যাস্তের অপরূপ সৌন্দর্য। ধারণা করা হয় যে, ১৯শ শতক থেকে সান্তোরিনিতে এই সৌন্দর্য চর্চা অব্যাহত রয়েছে।
রঙিন বাড়ির পোতাশ্রয় নিহ্যাভন
ধরুন আজ আপনার ছুটি। ইচ্ছা হলো নৌকা ভ্রমণের। যেমন ইচ্ছা তেমন কাজ। নৌকায় চেপে বসলেন, মাঝি আপনাকে নিয়ে এগিয়ে চলছে জলপথে। হঠাৎ করেই অনুভূতিতে কিছুটা ঘোরের আবেশ। জলপথের দুই পাশে চমৎকার সব রঙিন বাড়িঘর। লাল, নীল, হলুদ, সবুজসহ নানা রং-নকশার এসব বাড়ি কাঠের তৈরি। বাড়ির সামনে পাথরে বাঁধানো রাস্তা। প্রতিটি বাড়ির সামনে সারি বেঁধে নোঙর করা নৌকা। পুরোটাই যেন হাতে আঁকা কল্পরাজ্যের ছবির মতো। কিন্তু না, এটি মোটেও আপনার ঘোর নয়। আপনি যদি ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনের পোতাশ্রয় এলাকা নিহ্যাভনে যান, বর্ণনার সঙ্গে ঠিক ঠিক মিলে যাওয়া এমন দৃশ্যই দেখতে পাবেন। আর হবেইবা না কেন, নিহ্যাভনের বেশির ভাগ বাড়িই ছিল শিল্পীদের আবাসস্থল। এই শহরের বাড়িগুলো ১৭শ শতকে তৈরি। ছবির মতো এমন দৃশ্য দেখতে বেড়েছে পর্যটকের আনাগোনা, তৈরি হয়েছে পর্যটন নগরীতে। তাই তো বেশির ভাগ বাড়ি রেস্টুরেন্ট বা ক্যাফেতে পরিণত হয়েছে। শহরের সবচেয়ে পুরনো বাড়ি যেটি ১৬৬১ সালে তৈরি। সেটি আজও মৌলিক রূপে বিদ্যমান রয়েছে।
ব্যুরানো, ইতালি
সম্পূর্ণ শহরে জলাশয়ের দুই পাশে রয়েছে সারি সারি বহু বর্ণিল বাড়িঘর। শহরের মাঝ বরাবর বয়ে চলা হালকা সবুজ রঙের জলাধার। যেখানে চারটি দ্বীপ সেতু দিয়ে সংযুক্ত রয়েছে। ছোট্ট সুন্দর এই শহরটি মূলত ইতালির ব্যুরানো দ্বীপপুঞ্জ। জলাধারে যখন বাড়িগুলোর ছায়া পড়ে তা দেখলে মনে হয় যেন স্বর্গের সৌন্দর্য নেমে এসেছে এই শহরের বুকে। শীতকালে ঘন কুয়াশার কারণে বাড়িগুলোকে আলাদা করে চেনা যায় না। তাই শহরে বসবাসকারী জেলেরা নিজেদের বাড়িগুলোকে বিভিন্ন উজ্জ্বল রঙে রাঙিয়ে রাখত। বিশ্বাস করা হয় যে, সে থেকেই এই ঐতিহ্যের সূচনা হয়। বর্তমানে এই শহরের বাড়িগুলো রং করা হয় একটি নির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুযায়ী। কেউ তার বাড়ি রং করতে চাইলে সরকারের অনুমতি নিতে হয়। শহরের সৌন্দর্য অক্ষুণ্ন রাখতে সরকার থেকেই রং নির্দেশ করা হয়। থাকে তাই এই ব্যবস্থা।