বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি বন্ধু

তানভীর আহমেদ

মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি বন্ধু

বাংলাদেশের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই বহির্বিশ্বের নাগরিকদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অংশগ্রহণ ছিল। নিরস্ত্র বাঙালিদের হত্যা, নির্যাতনের খবর কেউ পৌঁছে দিয়েছিলেন কলম হাতে, কেউ ক্যামেরা হাতে, কেউ কবিতায়, কেউ কণ্ঠে গান তুলে। মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়ানো কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে আজকের রকমারি-

 

বীরপ্রতীক ওডারল্যান্ড

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ও সাহসী অবদান রাখার জন্য বীরপ্রতীকপ্রাপ্ত ওডারল্যান্ড ছিলেন একজন ডাচ্-অস্ট্রেলিয়ান কমান্ডো অফিসার। ঢাকায় বাটা স্যু কোম্পানির প্রোডাকশন ম্যানেজার হিসেবে ওডারল্যান্ড ১৯৭০ সালের শেষ দিকে প্রথম ঢাকায় আসেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপরই ওডারল্যান্ড যেন নিজের মধ্যে আবিষ্কার করেন নতুন এক যুদ্ধের মুখোমুখি প্রাক্তন-সৈনিক ওডারল্যান্ডকে। অপারেশন সার্চলাইটের সময় তিনি লুকিয়ে সে রাতের ভয়াবহতার কিছু ছবি তুলে পাঠান আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে। আর এভাবেই তিনি বাঙালির প্রাণের বন্ধু হয়ে ওঠেন। শুধু এ দেশের স্বাধীনতার জন্য আর নিরীহ মানুষকে হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে নিজের মানবিক তাড়নাতেই সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে লড়তে থাকেন পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে। আগস্ট মাসের দিকে তিনি টঙ্গীতে বাটা কোম্পানির ভিতরে গেরিলা ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্য-ওষুধ এবং আশ্রয় দিয়েও তিনি সাহায্য করেছিলেন। টঙ্গী ও এর আশপাশ এলাকায় বেশ কয়েকটি সফল গেরিলা হামলার আয়োজকও ছিলেন তিনি। স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি মুক্তিযুদ্ধে এ বীরোচিত ভূমিকার জন্য বীরপ্রতীক খেতাবে ভূষিত হন।

 

প্রাণের বন্ধু ইন্দিরা গান্ধী

ইন্দিরা গান্ধী। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রাণের বন্ধু। বাংলাদেশে যখন নিরস্ত্র-নিরীহ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদাররা তখন অসংখ্য বাঙালি প্রাণ বাঁচাতে সীমান্তের ওপারে গিয়ে পেয়েছিলেন জীবনের নিরাপত্তা। ১৯৭১ সালে শরণার্থী শিবিরে মানবিক বিপর্যয় দেখতে এসেছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। প্রায় এক কোটি লোক জীবন বাঁচাতে আশ্রয় নিয়েছেন ভারতের বিভিন্ন এলাকায়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বাংলাদেশের সবচেয়ে আপন মানুষ হয়ে ওঠেন তিনি। সীমান্তের ওপারে বাংলাদেশের নিরীহ মানুষকে খাদ্য ও বাসস্থান দিয়ে সর্বোচ্চ সহায়তা করেন। ইন্দিরা গান্ধীর জš§ ভারতের রাজনীতিতে সবচেয়ে প্রভাবশালী, ঐতিহ্যবাহী নেহরু পরিবারে ১৯১৭ সালের ১৯ নভেম্বর। বাবা জওহরলাল নেহরু এবং মা কমলা দেবী। সব মিলিয়ে প্রায় ১৫ বছর ভারত শাসন করেছেন ইন্দিরা গান্ধী। ১৯৩৮ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ইন্দিরা গান্ধী ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দেন। ইন্দিরা গান্ধী বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ে যোগদান করেন। রবিঠাকুরই তার নাম রাখেন ‘প্রিয়দর্শিনী’। ১৯৬৪ সালে বাবার মৃত্যুর পর তিনি রাজ্যসভার সদস্য হন এবং লালবাহাদুর শাস্ত্রীর কেবিনেটে তথ্য ও যোগাযোগমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৬ সালে ইন্দিরা গান্ধী ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রাজনীতিতে আবির্ভূত হন। ইন্দিরা গান্ধীকে মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রাখার জন্য ২০১১ সালের ২৫ জুলাই বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সম্মাননা ‘স্বাধীনতার সম্মাননা’ দেওয়া হয়। ইন্দিরা গান্ধীর পক্ষে সম্মাননা গ্রহণ করেন তার পুত্রবধূ সোনিয়া গান্ধী।

 

কনসার্ট ফর বাংলাদেশ

রবিশঙ্কর আর জর্জ হ্যারিসন। বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের কথা সুরের মূর্ছনায় বিশ্ববাসীকে প্রথম জানান দিয়েছিলেন তারাই। কনসার্ট ফর বাংলাদেশ থেকেই বিশ্ববাসীকে আবেগী নাড়া দেয়, নিরস্ত্র বাঙালিদের নৃশংসভাবে হত্যাযজ্ঞ বাস্তবে উপস্থাপন করেন তারা। একাত্তরে বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের পৈশাচিকতা দেখে ভারতের সেতারসম্রাট বিখ্যাত শিল্পী রবিশঙ্কর ঠিক করলেন, কিছু করতে হবে তাকে। তার বন্ধু বিখ্যাত বিটলস ব্যান্ডের অন্যতম সদস্য জর্জ হ্যারিসনও এতে সায় দেন। ১ আগস্ট ১৯৭১ নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ারে বসল পৃথিবীর ইতিহাসে স্মরণীয় এক ঐতিহাসিক কনসার্ট। সেখানেই বাংলাদেশের জন্য বাজালেন সেতারসম্রাট রবিশঙ্কর, সরোদসম্রাট ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ, তবলার কিংবদন্তি শিল্পী আল্লারাখা খাঁ। তারপর একে একে গান গাইলেন বিটলসের জর্জ হ্যারিসন, রিঙ্গো স্টার, লিওন রাসেল, বিলি প্রিস্টন আর কিংবদন্তি গায়ক বব ডিলান। কিংবদন্তি গিটারিস্ট এরিক ক্ল্যাটনও গিটার বাজিয়েছিলেন কনসার্টটিতে। সব শেষে জর্জ হ্যারিসন গাইলেন তার সেই বিখ্যাত গান ‘বাংলাদেশ’। ১৯৭১ সালের সেই রবিবার নিউইয়র্ক সিটির ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে প্রায় ৪০ হাজার দর্শকের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত হয় এ কনসার্ট। এই কনসার্টের একটি শ্রেষ্ঠ বিক্রীত লাইভ অ্যালবাম, একটি বক্স-থ্রি রেকর্ড সেট এবং অ্যাপল ফিল্মসের কনসার্টের তথ্যচিত্র নিয়ে ১৯৭২ সালের বসন্তে চলচ্চিত্রাকারে প্রকাশ করা হয়। এই অনুষ্ঠানের গানের একটি সংকলন কিছুদিন পরেই ১৯৭১ সালে  বের হয় এবং ১৯৭২ সালে এই অনুষ্ঠানের চলচ্চিত্রও বের হয়।

কনসার্ট ও অন্যান্য অনুষঙ্গ হতে প্রাপ্ত অর্থ সাহায্যের পরিমাণ ছিল প্রায় ২ কোটি ৪৩ হাজার ৪ শত ১৮.৫১ মার্কিন ডলার। যা ইউনিসেফের মাধ্যমে শরণার্থীদের সাহায্যার্থে ব্যয় হয়।  সেতারবাদক পন্ডিত রবিশঙ্করই প্রথম তার বন্ধু জর্জ হ্যারিসনের সঙ্গে এই কনসার্ট আয়োজনের আলাপ করেছিলেন। পাঁচ সপ্তাহের মধ্যে অনুষ্ঠানের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়। জর্জ হ্যারিসন প্রথমে তার প্রাক্তন দল দ্য বিটলসের সদস্যদের যোগ দিতে বলেন। পল ম্যাকার্টনি অবশ্য সরাসরি অস্বীকৃতি জানান, কারণ তখন মূলত দলের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক ছিল না। জন লেনন অনুষ্ঠানে আসতে রাজি ছিলেন কিন্তু তিনি সে সময় আদালতে তার সন্তানের ব্যাপারে তার স্ত্রী ইয়োকো ওনোর সঙ্গে আইনি লড়াই চালাচ্ছিলেন বলে শেষ পর্যন্ত আসতে পারেননি। আর মিক জ্যাগার তখন ছিলেন দক্ষিণ ফ্রান্সে। ভিসা-সংক্রান্ত জটিলতার কারণে তার পক্ষেও আসা সম্ভব হয়নি। শেষ পর্যন্ত বিটলসের একমাত্র রিঙ্গো স্টার তাদের সঙ্গে যোগ দিতে সক্ষম হন। সঙ্গে আরও যোগ দেন বব ডিলান, এরিক ক্ল্যাপটন, বিলি প্রিস্টন, হ্যারিসনের নতুন দল ব্যাড ফিঙ্গারের যন্ত্রীদল ও আরও অনেকে।

 

 

 

 

 

 

সায়মন ড্রিং

কলম আর ক্যামেরা হাতে নিজের জীবনবাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে নিরীহ বাঙালির পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন সাংবাদিক সায়মন ড্রিং। একাত্তর সালে সায়মন ড্রিংয়ের বয়স ছিল মাত্র ২৭ বছর। তিনি তখন নামকরা পত্রিকা ডেইলি টেলিগ্রাফের একজন সাংবাদিক। অন্যদিকে তখন আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পাকিস্তানি সামরিক সরকার ২৫ মার্চ বিশ্বের বড় বড় সংবাদ মাধ্যমগুলোর ৪০ সাংবাদিককে বাংলাদেশে আসার অনুমতি দিয়েছে। সেই সুযোগে টেলিগ্রাফের সাংবাদিক হিসেবে বাংলাদেশে আসেন সায়মন ড্রিং। পাকিস্তানি সেনাদের নির্যাতনের চিত্র তিনি তুলে ধরেন বিশ্ববাসীর সামনে। এক সময় সাংবাদিকদের জন্য অবস্থা প্রতিকূলে চলে গেলে তিনি দেশত্যাগ না করে লুকিয়ে থাকেন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে। তিনি ২৭ তারিখে পাকিস্তানি বাহিনীকে ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে আসেন শহরে। ঢাকার বুকে তখন হত্যা, ধ্বংস আর লুটপাটের চিহ্ন। এর প্রত্যক্ষ ছবিগুলো নিয়ে তিনি পালিয়ে চলে যান ব্যাংককে। আর সেখান থেকে প্রকাশ করলেন ‘ট্যাংকস ক্রাশ রিভল্ট ইন পাকিস্তান’। বিশ্ববাসীর সামনে তিনি তুলে ধরলেন নির্মম বাস্তবতাকে। তার পাঠানো খবরেই নড়েচড়ে বসে পুরো বিশ্ব।

 

লেয়ার লেভিন

পাকিস্তানি সেনাদের বর্বরতার কাহিনী বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দেবেন- এ মন্ত্রেই একাত্তর সালে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে  লেয়ার লেভিন ক্যামেরা হাতে ঘুরে বেড়িয়েছেন ‘মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা’র সঙ্গে। তারা একটি ট্রাকে ঘুরে বেড়াতেন ভারতের বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে আর মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে। সুযোগ পেলে দেশের ভিতরের মুক্তাঞ্চলেও চলে আসতেন। আর সেখানে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধা ও গেরিলাদের দেশাত্মবোধক গান শুনিয়ে, পুতুলনাচ দেখিয়ে উজ্জীবিত করতেন। প্রায় ২০ ঘণ্টার ক্যামেরা ফুটেজ তৈরি করলেন তিনি। তারপর ফিরে গেলেন যুক্তরাষ্ট্রে। শুরু করলেন ডকুমেন্টারি তৈরির কাজ। কিন্তু টাকার অভাবে শেষ করতে পারলেন না ডকুমেন্টারিটি। পরে অবশ্য আমাদের দেশের আরেকজন বিখ্যাত পরিচালক তারেক মাসুদ আর তার স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ লেভিনের কাছ থেকে ফুটেজগুলো নিয়ে তৈরি করেন ‘মুক্তির গান’।

 

অ্যালেন গিন্সবার্গ

কবি এবং কাব্য বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আলোড়ন তুলেছিল। সেই কবির নাম অ্যালেন গিন্সবার্গ। তিনি একজন মার্কিন কবি। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের ওপর তিনি লিখেছিলেন একটি দীর্ঘ কবিতা। কবিতাটির নাম ছিল- ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’। তার কবিতাটি ছুঁয়ে যায় হাজারো মানুষের হৃদয়। নিপীড়িত মানুষের হাহাকার মেশানো, যুদ্ধের বাস্তব চিত্র কবিতার অক্ষরে অক্ষরে জানান দিয়ে যায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দৃশ্য। তার কবিতা শুনে ও পড়ে অশ্র“সজল হয়ে পড়ে হাজারো মানুষ। বাংলাদেশের পক্ষে একাত্ম হয়ে ওঠেন বিশ্বের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অগণিত সাহিত্যপ্রেমিক। তার কবিতাটির কয়েকটি লাইন এখনো অনেকের মুখে মুখে চলে আসে। ‘মিলিয়নস অব সোলস নাইন্টিন সেভেন্টিওয়ান, হোমলেস অন যশোর রোড আন্ডার গ্রে সান, অ্যা মিলিয়ন আর ডেড, দ্য মিলিয়নস হু ক্যান, ওয়াক টুওয়ার্ড ক্যালকাটা ফ্রম ইস্ট পাকিস্তান’। কবিতার ইস্ট পাকিস্তান বা পূর্ব পাকিস্তানই হলো বর্তমান বাংলাদেশ। তার এ কবিতার সূত্র ধরেই বিখ্যাত গায়িকা মৌসুমী ভৌমিক কবিতাটির কিছু অংশ বাংলায় অনুবাদ করে তৈরি করেছেন তার ‘যশোর রোড’ গানটি।

 

অকৃত্রিম বন্ধু এডওয়ার্ড কেনেডি

বিশ্বের মানবতাবাদী মানুষ বাঙালির ন্যায্য অধিকার আদায়ের সংগ্রামে, মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করেছিলেন। তাদেরই একজন মহান ব্যক্তিত্ব, বাংলাদেশিদের অকৃত্রিম বন্ধু যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি। এডওয়ার্ড কেনেডি ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে গণহত্যার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন। পাকিস্তান বাহিনীর পাশবিকতা থেকে বাঁচার জন্য মানুষ ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। এক কোটি শরণার্থীর দুর্দশা স্বচক্ষে পর্যবেক্ষণ করে ফিরে এসে কেনেডি সিনেট জুডিশিয়ারি কমিটির কাছে বিস্তারিত রিপোর্ট করেছিলেন ‘ক্রাইসিস ইন সাউথ এশিয়া’। ইতিহাসে এই রিপোর্টটির গুরুত্ব অনেক। এ রিপোর্টে কেনেডি পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর নির্বিচার গণহত্যার কথা বলেছেন, বাংলাদেশের মানুষের দুর্দশার কথা তুলে ধরেছেন মার্কিন প্রশাসনের সামনে। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও তিনি বিভিন্ন দেশে গিয়ে বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য সাহায্য চেয়েছেন। ১৯৭২ সালে এডওয়ার্ড কেনেডি সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশে আসেন। ঢাকায় তিনি একটি শোভাযাত্রায় অংশ নেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষণ দেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে কাজ করে গেছেন জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত।

 

পল কনেট দম্পতি

বাংলাদেশে নিরীহ জনমানুষের ওপর অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে নির্মম হত্যাকা-ের বিরুদ্ধে লন্ডনে জনমত গড়ে তোলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছিলেন পল কনেট দম্পতি। পাকিস্তানি বাহিনী বাংলাদেশে নিরীহ মানুষের রক্ত ঝরাচ্ছে- এ খবরে তারা আর চুপ করে বসে থাকতে পারেননি। মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন, বাংলাদেশে খাদ্যসামগ্রী ও ওষুধপথ্য পাঠানোর জন্য তারা ‘অপারেশন ওমেগা’ নামে একটি সংস্থা করেন। লন্ডনের ক্যামডেন এলাকায় তারা ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’ নামে একটি কার্যালয় খোলেন। পাকিস্তানি সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে এবং বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য জনমত গঠন করতে ১ আগস্ট লন্ডনের ট্রাফালগার স্কয়ারে বিশাল জনসভার আয়োজন করেন তারা। এ ছাড়া বাংলাদেশে ত্রাণ কার্যক্রম চালাতে পল নিজেই চলে আসেন। পলের সঙ্গে তার স্ত্রী এলেন কনেটও বাংলাদেশে এসেছিলেন। ট্রাফালগার স্কয়ারে বিশাল জমায়েত শেষে একটি অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে ভারতে আসেন।

সেখান থেকে জীবনের ঝুঁঁকি নিয়ে ঢোকেন বাংলাদেশে। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনী তাকে গ্রেফতার করে। পরে পাকিস্তানের সামরিক আদালত তাকে দুই বছরের কারাদ- দেয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি মুক্তি পান।

 

জোসেফ ও’কনেল

মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত বন্ধু জোসেফ ও’কনেল টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ম গবেষণা বিভাগের প্রফেসর ইমেরিটাস এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্ব ধর্ম ও সংস্কৃতি বিভাগের সম্মানিত অধ্যাপক ছিলেন। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃৃতির প্রতি গভীর অনুরাগের বশে তিনি ও তার সহধর্মিণী ক্যাথলিন ও’কনেল দীর্ঘদিন ধরে বাংলা চর্চা করেছেন। জোসেফ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে জনমত গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রাখেন। বিদেশে যে কজন বন্ধু বাংলাদেশের সংস্কৃতি, ভাষার প্রতি সত্যিকারের দরদ দেখিয়েছিলেন তাদের একজন তিনি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তিনি দেশের বাইরে বিভিন্ন জায়গায় জনমত তৈরি করেন।

 

 

মার্ক টালি

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং পাকবাহিনীর গণহত্যার সংবাদ বিশ্ববাসীর সামনে প্রচারে অনন্য ভূমিকা পালনকারী ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং করপোরেশনের (বিবিসি) বিশিষ্ট সাংবাদিক মার্ক টালি। একাত্তরের বিবিসি বলতে তৎকালীন সবাই মার্ক টালিকেই জানত। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রেডিওর এরিয়াল তুলে শর্টওয়েভ স্টেশনের নব ঘুরিয়ে স্থির হয়ে সকাল-সন্ধ্যা বিবিসিতে কী বলছেন মার্ক টালি, তা শোনার জন্য উৎকণ্ঠিত থাকত পুরো দেশ। নিত্যদিনের প্রাণবন্ত খবরের সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে হাজির হতেন মার্ক টালি। একদিন বাংলাদেশে স্বাধীন হলো। পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেওয়া উপহার পেয়ে অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন সাংবাদিক স্যার উইলিয়াম মার্ক টালি। এ বিরল উপহারটিকে তিনি তার জীবনের মহামূল্যবান সম্পদ হিসেবে উল্লেখ করেন।

 

কিশোর পারেখ

কিশোর পারেখ ভারতীয় ফটোগ্রাফার। বাংলাদেশের মুক্তিদ্ধের যে ক’জন সফল ক্যামেরা যোদ্ধা মুক্তিযুদ্ধের চিত্র সেলুলয়েডবন্দী করেছিলেন তাদের একজন কিশোর পারেখ। মুক্তিযুদ্ধের সময় পারেখ ছিলেন ব্যতিক্রম যিনি কোনো অ্যাসাইনমেন্ট ছাড়াই স্বেচ্ছায় বাংলাদেশে এসে মুক্তিযুদ্ধের ছবি তুলেছিলেন। ঢাকায় অবস্থানকালীন একজন সিভিলিয়ান হয়ে সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রের ছবি তোলা খুব কঠিন ব্যাপার ছিল। তাই তিনি পাকিস্তান আর্মির পোশাক জোগাড় করে ঐতিহাসিক কাজগুলো সাহসিকতার সঙ্গে সম্পন্ন করেছিলেন। ছবি তুলতে গিয়ে তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে ধরাও পড়েছিলেন। মাত্র ৮ দিনে তার তোলা ৬৭টি ছবি মুক্তিযুদ্ধের এক অসামান্য দলিল হয়ে আছে। এ ছবিগুলো অবলম্বন করে পরে তিনি ‘বাংলাদেশ : এ ব্রুটাল বার্থ’ নামে একটি অ্যালবাম প্রকাশ করেন।

সর্বশেষ খবর