সোমবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

সমুদ্রের বিরল প্রাণী

সমুদ্র গভীর, অসীম এবং রহস্যে পরিপূর্ণ। এই রহস্যের বেশির ভাগই এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। সাগরের গভীরে কেবল অন্ধকার ও প্রাচীন জাহাজই নয়, এখানে রয়েছে অসংখ্য অদ্ভুত জীবনও। সমুদ্রতলে এমন শত শত প্রাণী রয়েছে; যারা শারীরিকভাবে দেখতে অদ্ভুত,  তবে অত্যন্ত দর্শনীয়। লিখেছেন - আবদুল কাদের

 

ডাম্বো অক্টোপাস

ওয়াল্ট ডিজনির বিখ্যাত অ্যানিমেটেড কার্টুন ডাম্বোর কথা মনে পড়ে! এই অ্যানিমেটেড মুভির মূল চরিত্র হাতির নামানুসারেই অক্টোপাসটির নামকরণ করা হয়েছে। এই চমকপ্রদ নামকরণের কারণ এদের বিশালাকৃতির গোলাকার কান, যার মাধ্যমে এরা সাঁতার কাটতে পারে। যদিও এরা তালিকায় থাকা অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণীর মতো ভয়ংকর নয়, তবে এরা পৃথিবী নামক গ্রহে থাকা বিরলতম সামুদ্রিক প্রাণীদের মধ্যে একটি। এরা এতটাই ছোট আকৃতির অক্টোপাস যে, তারা সর্বোচ্চ ২০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। এটি মূলত অক্টোপাসের একটি সাবজেনাস প্রজাতির অন্তর্গত, যারা সমুদ্রতলের প্রায় ৩ হাজার থেকে ৫ হাজার মিটার গভীরতা পর্যন্ত জীবনধারণ করতে পারে। বৈজ্ঞানিকভাবে এরা গ্রিম্পোটিউথিস থেকে আলাদা, তবে এরা সাধারণত অক্টোপাসের ক্রম মোলাস্ক সেফালোপডের প্রজাতির সঙ্গে মিলে যায়। সাধারণত পানির ৯ হাজার ৮০০ ফুট থেকে ২৩ হাজার ফুট নিচে এদের পাওয়া যায়। সাগরের এত গভীরে তাপমাত্রা একেবারেই কম। এত শীতল পরিবেশে ডাম্বো অক্টোপাসরা কীভাবে মানিয়ে নেয়, বিজ্ঞানীরা তা এখনো পুরোপুরি জানেন না। তবে সাগরতলে পানির এত চাপ কীভাবে সামলায় তা জানতে পেরেছেন। এদের নরম-জেলির মতো শরীরটা এ ক্ষেত্রে ঢাল হিসেবে কাজ করে। আর সহজেই এরা আকৃতি বদল করতে ও ভেসে থাকতে পারে। নানা রঙের ডাম্বো অক্টোপাস আছে। কোনোটা সাদা, কোনোটা লাল, কোনোটা আবার বাদামি। এমনকি গোলাপিও হয় কারও কারও রং। অন্য অক্টোপাসদের মতো এরাও রং বদলাতে পারে। রং বদলে গভীর সাগরের সঙ্গে একেবারে মিশে যেতে পারে। এতে বড় প্রাণীরা তাকে আর খুঁজে পায় না। সাগরের এত গভীরে ডাম্বোদের খুব বেশি শত্রুও নেই। মাঝেমধ্যে হাঙর আর কিলার হোয়েলরা ঝামেলা পাকায়। ডাম্বো অক্টোপাসরা সাধারণত খুব বেশি দিন বাঁচে না। বড় জোর তিন থেকে পাঁচ বছর। বেশি বেশি ডাম্বোর জন্ম না হলে কবেই এরা বিলুপ্ত হয়ে যেত। ফিলিপাইন, নিউজিল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়ার সমুদ্র উপকূলের মতো জায়গায় এদের দেখা যায়।

 

দ্য ব্ল্যাক শ’লোয়ার

দ্য ব্ল্যাক শ’লোয়ার। মুখের অবয়বে এরা অনেকটা পিরানহার মতোই। তবে এরা স্থানীয়দের কাছে চিয়াসমোডন নাইজার নামে বেশি পরিচিত। এরা এমন এক সামুদ্রিক মাছ, যারা নিজেদের শিকারকে সম্পূর্ণরূপে গ্রাস করে ফেলার মতো অসাধারণ ক্ষমতা রাখে। সাধারণত গভীর জলেই এদের বসবাস। সামুদ্রিক মাছটি নিজের প্রায় দ্বিগুণ আকারের অথবা তার দশ গুণ বেশি ওজনের যে কোনো প্রাণীকে গ্রাস করে ফেলতে পারে। বোঝাই যাচ্ছে, এদের পাকস্থলি অনেক বেশি প্রশস্ত হওয়ার মতো ক্ষমতা রাখে। এদের আকার দেখে ধোঁকা খাবেন না, আকারে ছোট হলেও এরা কিন্তু বিশাল সমুদ্রের সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাণী হিসেবে বিবেচিত।

 

সাইমোথোয়া এক্সিগুয়া

সাইমোথোয়া এক্সিগুয়া। এরা কিন্তু জিহ্বা-খাদক নামে বেশি পরিচিত। মূলত এরা আইসোপড শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত একটি ক্ষুদ্র পরজীবী। এরা সমুদ্রগর্ভের অদ্ভুত প্রাণী, যারা অন্য মাছের মুখের ভিতরে থাকে। এরা সাধারণত অন্য মাছের জিহ্বা শোষণ, পচন এবং সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে থাকে। এমনকি এরা আক্রান্ত মাছের জিহ্বার সঙ্গে নিজেদের প্রতিস্থাপন করে। পরজীবীটি যত বড় হতে থাকে জিহ্বায় রক্ত সংবহন তত কমতে থাকে এবং এক সময় তা বিকল হয়ে যায়। তখন পরজীবীটি নিজেকে জিহ্বার পেশিগুলোতে আটকে মেকি-জিভ বা ছদ্মবেশী জিভ (Pseudo Tongue) হিসেবে কাজ করে। এরা শুধু মাছের মুখে ঢুকে এর জিহ্বা ভক্ষণ করেই বেঁচে থাকে না, মাছের শরীরের ভিতর বংশবৃদ্ধিও করে!

 

ফ্রিলড হাঙ্গর

ফ্রিলড হাঙর কার্পেট হাঙর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তবে এরা দেখতেও ভীষণ অদ্ভুত প্রকৃতির। এদের বৈজ্ঞানিকভাবে ক্ল্যামিডোসেলাকাস অ্যাঙ্গুইনিয়াস বলা হয়। দাঁতের কারণে এদের এই কঠিন নাম হয়েছে। কারণ এই হাঙরের মুখে ৩০০টি দাঁত রয়েছে। দাঁতগুলোও মুখের ভিতর ফ্রিলের মতো সাজানো থাকে। এই হাঙর মাছটি ৬.৬ ফুট লম্বা। এই মাছ শিকারের সময় তার ওজন এবং দাঁতের শক্তিশালী ব্যবহার করে। কখনো কখনো এটি তার আকারের দ্বিগুণ হাঙরকেও শিকার করে। এই হাঙর মাছটি ৮০ মিলিয়ন বা ৮ কোটি বছর ধরে এভাবেই রয়েছে, নেই কোনো পরিবর্তন। জানা গেছে, আটলান্টিক এবং প্রশান্ত মহাসাগরের অনেক গভীরতায় বিশেষ এই প্রাণীটির বসবাস।

 

ব্লবফিশ

অদ্ভুত দেখতে মাছটির বৈজ্ঞানিক নাম Psychrolutes Marcidus। তবে স্থানীয়দের কাছে এরা সাধারণত ব্লবফিশ নামেই পরিচিত। সমুদ্রতলের প্রায় ১ হাজার ২০০ মিটার গভীরতায় এদের বসবাস। সমুদ্রতলের এই গভীরতার চাপ সাগরের পৃষ্ঠের তুলনায় ১২০ গুণ বেশি হয়ে থাকে। অধিক চাপের ফলে ব্লবফিশ দেখতে একটি জেলটিনাস ভরের মতো দেখায়। শারীরিকভাবে এরা খুব কম পেশির অধিকারী মাছ। নামের মতোই এরা দেখতে থলথলে। এই মাছটিকে ভূপৃষ্ঠে আনার পর অতিরিক্ত চাপের কারণে এদের শরীর ভেঙে পড়ে। তাই তো এরা পৃথিবীর সবচেয়ে কুৎসিত প্রাণী হিসেবে বিবেচিত। বিজ্ঞানীরা বলছেন, অস্ট্রেলিয়া এবং তাসমানিয়ার সমুদ্র উপকূলে এদের পাওয়া যায়।

 

নর্দান স্টারগেজার

সমুদ্রতলের সবচেয়ে অদ্ভুত প্রাণী নর্দান স্টারগেজার। এদের বৈজ্ঞানিক নাম হলো- Astroscopus Guttatus। প্রাণীটি সাধারণত সমুদ্রতলে ঘাপটি মেরে থাকে। যার ফলে এদের সৈকতে থাকা বালির ভাস্কর্যের মতো দেখায়। এরা প্রচন্ড ধৈর্যশীল, কারণ এরা শিকারকে আক্রমণ করার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকে। শিকার কাছে এলেই এরা লাফ দিয়ে উঠে শিকার ধরে থাকে। এদের পছন্দের খাবারের মধ্যে রয়েছে ছোট মাছ, কাঁকড়া এবং ক্রাস্টেসিয়ান। গভীর জলে এদের বাস। মাছটির চোখ মাথার ওপর বসানো, থ্যাবড়া মুখটাও ওপর দিকে বাঁকানো। মনে রাখতে হবে, মাছটি কিন্তু প্রচন্ড রকমের বিষাক্ত।

 

স্পটেড ওয়াবেগং

স্পটেড ওয়াবেগং বিশ্বের বিরল হাঙরগুলোর (কার্পেট হাঙর) মধ্যে অন্যতম। শারীরিকভাবে এরা অন্যান্য হাঙরের মতো ভয়ঙ্কর নয়। তবে হাঙরের এই প্রজাতিটি অন্যান্য হাঙরের মতোই শিকারি। এদের শরীর সাধারণত চ্যাপ্টা আকৃতির, গাঢ় স্যাডল, সাদা আকৃতির দাগ কিংবা সাদা দাগের প্যাটার্নে হয়ে থাকে। এরা প্রায় ১০০ মিটার গভীরতায় অগভীর উপকূলীয় জলে বাস করে। হাঙরের এই প্রজাতিটি অস্ট্রেলিয়ার উপক্রান্তীয় এবং নাতিশীতোষ্ণ জলে ব্যাপকভাবে বিচরণ করে থাকে। হাঙরটি সমুদ্রতলের যে কোনো পরিবেশের সঙ্গে মিশে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে। এই বৈশিষ্ট্য অন্যান্য হাঙরের চেয়ে এদের করেছে আলাদা। এর মাধ্যমে এরা নিজেদের রক্ষা করতে পারে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর