শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ১৯ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

যেভাবে ২০০ বিলিয়ন ডলার খোয়ালেন ইলন মাস্ক

আবদুল কাদের

যেভাবে ২০০ বিলিয়ন ডলার খোয়ালেন ইলন মাস্ক

ছিলেন বিশ্বের শীর্ষ ধনী। করোনায় শীর্ষ ধনীরা যখন কপাল চাপড়াচ্ছিলেন তখন ইলন মাস্ক গড়ে তোলেন টাকার পাহাড়। ২০২১ সালে তাঁর সম্পদ বেড়ে ৩৪০ বিলিয়ন ডলার হয়েছিল! কিন্তু ভাগ্যের ফের, মাত্র এক বছরেই তাঁর লস হয়েছে প্রায় ২০০ বিলিয়ন ডলার। হারিয়েছেন বিশ্বের সেরা ধনীর তকমা। উল্টো লস খাওয়ার লজ্জার রেকর্ড গড়েছেন তিনি। বর্তমানে ১৪৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মালিক তিনি। তাঁর ২০০ বিলিয়ন ডলার খোয়ানোর ঘটনা নিয়ে আজকের রকমারি-

 

এক বছরে হাওয়া ২০ হাজার কোটি ডলার

কয়েক বছরের মধ্যে বিশ্বের ধনী ব্যক্তিদের তালিকায় প্রথম সারিতেই চলে এসেছে ইলন মাস্কের নাম। টেসলার সিইও মাস্কের সম্পত্তি হু হু করে বেড়েছিল। তবে এবার জোর ধাক্কা খেলেন সেই মাস্ক। এক লাফে ২০০ বিলিয়ন ডলার হারান তিনি। বিশ্বের ইতিহাসে এত বড় ক্ষতি নাকি এই প্রথম। ব্লুমবার্গের বিলিয়নিয়ার ইনডেক্সে উঠে এসেছে ইলন মাস্কের এই বিপুল ক্ষতি। ২০২১-এর জানুয়ারিতে অ্যামাজনকর্তা জেফ বেজোসের পরই ছিলেন মাস্ক, যিনি ২০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি সম্পত্তির মালিক ছিলেন। গাড়ি সংস্থা টেসলার শেয়ার কমে যাওয়াতেই এই বিপত্তি, এমনটা মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। সম্প্রতি ১৩৭ ডলার কমেছে সেই শেয়ার। গত ২৭ ডিসেম্বর ১১ শতাংশ শেয়ার হারিয়েছে টেসলা। যুক্তরাষ্ট্রে ৭৫০০ ডলার ছাড় দিচ্ছে টেসলা। এ ছাড়া সাংহাইয়ে এই সংস্থা গাড়ি তৈরির সংখ্যাও কমিয়েছে। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি হিসেবে নাম উঠে এসেছিল মাস্কের। ডিসেম্বর মাসে তাঁকে টপকে গেছেন ফরাসি ব্যবসায়ী বার্নার্ড আর্নল্ট। টেসলার ধাক্কার সঙ্গে সঙ্গে টুইটার নিয়েও বিতর্কে জড়িয়েছেন ইলন মাস্ক। তবে টেসলা নিয়ে সমস্যার কথা মানতে নারাজ সিইও মাস্ক। বিশ্বের দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে ২০২১ সালের জানুয়ারিতে ২০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার ব্যক্তিগত সম্পদের মাইলফলক ছুঁয়েছিলেন মার্কিন ধনকুবের ইলন মাস্ক। সম্প্রতি টুইটারের নিয়ন্ত্রণ নেন ইলন মাস্ক। তারপর থেকেই একাধিক বিতর্কের মুখে পড়তে হয়েছে ইলন মাস্ককে। সম্প্রতি টুইটারে সংস্থার মধ্যে একটি অভ্যন্তরীণ ভোট হয়। যেখানে তিনি বিশ্বের মানুষের কাছে জানতে চান টুইটারের সিইও পদে তাঁর থাকা উচিত কি না। আর সেই ভোটের ফলাফলে বড় ধাক্কা খান মাস্ক। দেখা যায়, বিশ্বের বেশির ভাগ মানুষই বিশ্বের সবচেয়ে বড় ব্লিগিং সাইটের সিইও পদে মাস্ককে চান না। আর এর পরেই জল্পনা তৈরি হয়েছে, তাহলে মাস্ক কি টুইটের সিইও পদ ছেড়ে দেবেন? আর এই জল্পনার মধ্যেই জানা যায়, তিনি নয়া সিইও খুঁজছেন। আবার এও শোনা যাচ্ছে, তিনি আরও একটি সংস্থা কিনতে চলেছেন। আর এর মধ্যেই বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তির বড় ধাক্কা। এক লাফে ২০০ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়েছে তাঁর। তাও আবার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই। যা টেসলাকর্তার কাছে বড় ধাক্কা বলেই মনে করা হচ্ছে। যদিও এ বিষয়ে মাস্কের তরফে কোনো বার্তা দেওয়া হয়নি।

 

কে এই ইলন মাস্ক

প্রযুক্তি ও ব্যবসার খোঁজখবর রাখেন অথচ ইলন মাস্কের কথা জানেন না, এমন মানুষ বোধহয় কম।

ইলন মাস্ক দক্ষিণ আফ্রিকার বংশোদ্ভূত আমেরিকান উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী; যিনি ১৯৯৯ সালে এক্স ডটকম (যা পরবর্তীতে পেপ্যাল নামে পরিচিত পায়), ২০০২ সালে স্পেসএক্স ও ২০০৩ সালে টেসলা মোটরস প্রতিষ্ঠা করেন। বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে ইলন মাস্ক তাঁর জীবনের প্রথম প্রতিষ্ঠান জিপ টু (এমন একটি সফটওয়্যার যা খবরের কাগজের জন্য ইন্টারনেট গাইড হিসেবে ব্যবহার করা হতো) বিক্রি করে ধনকুবের বনে যান। ২০১২ সালের মে মাসে তিনি খবরের কাগজের শিরোনামে উঠে আসেন যখন তাঁর কোম্পানি স্পেসএক্স প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্রে অর্থের বিনিময়ে ভ্রমণে ইচ্ছুক যাত্রী প্রেরণ করে।

২০১৬ সালে সোলার সিটি কেনার মধ্য দিয়ে তিনি তাঁর অর্জনের পাল্লা আরও ভারী করেন। ট্রাম্প প্রশাসনের শুরুর দিনগুলোয় উপদেষ্টা হওয়ার প্রস্তাব গ্রহণ করে শিল্প ও বাণিজ্যের জগতে একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা হিসেবে নিজের অবস্থান পাকা করেন।

 

গাড়ির দাম কমিয়েছে টেসলা

২০২৩ সালের শুরুতে এক ঢিলে দুই পাখি শিকার করলেন ইলন মাস্ক। বিশ্বব্যাপী বৈদ্যুতিক গাড়ির দাম ২০ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়েছে টেসলা। বৈদ্যুতিক গাড়ির জগতে টেসলার প্রতিদ্বন্দ্বীদের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জের সৃষ্টি করেছে এই ডিসকাউন্ট। গেল বছরে রেকর্ড ১৩ লাখ ইউনিট গাড়ি বিক্রি করেছে টেসলা। তবে প্রধান নির্বাহীর লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী গাড়ি সরবরাহ করতে ব্যর্থ সংস্থাটি। এ অবস্থায় মূল্য ছাড়ের নীতি গ্রহণ করছে গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানটি। চীনসহ এশিয়ার বাজারের পর এবার সংস্থাটি যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানিতে গাড়ির দাম কমিয়েছে। অবশ্য ধেয়ে আসা অর্থনৈতিক মন্দা এবং যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভসহ বিশ্বব্যাপী কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর সুদহার বাড়ার কারণে গাড়ি বিক্রির প্রবৃদ্ধি ঠিক রাখতে কিছুদিন আগেই প্রয়োজনে লাভ কমিয়ে গাড়ি বিক্রি বাড়ানোর ইঙ্গিত দিয়েছিলেন টেসলার প্রধান নির্বাহী ইলন মাস্ক। বর্তমানে বাজারে গাড়ির দাম অত্যধিক বেশি উল্লেখ করে এই দাম গ্রাহক পর্যায়ে চাহিদা কমিয়ে দিতে পারে বলেও সতর্ক করেছিলেন তিনি। গত সপ্তাহে এশিয়ার বাজারে গাড়ির দাম কমানোর ঘোষণা দেয় টেসলা। এরপর ক্রমান্বয়ে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার বাজারে গাড়ির দাম কমানোর ঘোষণা দেওয়া হয়। গাড়ির দাম কমিয়ে আসলে ইলন মাস্ক এক ঢিলে দুই পাখি মারার বন্দোবস্ত করলেন, এমনটাই মনে করছেন বিশ্লেষকরা। দাম কমে যাওয়ায় লাভ কম হলেও টেসলার গাড়ি বিক্রির প্রবৃদ্ধি অটুট থাকবে, আবার দাম কমানোর কারণে চাপের মুখে পড়বে প্রতিদ্বন্দ্বী বৈদ্যুতিক গাড়ি নির্মাতা কোম্পানিগুলো। টেসলার দামের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নিজেদের গাড়ির দাম কমানোয় চাপে পড়বেন তারা। এতে অনেক কোম্পানি লোকসানে পড়বে। ইলন মাস্ক এমন এক সময় টেসলার গাড়ির দাম কমানোর সিদ্ধান্ত নিলেন যখন জেনারেল মোটরস বা টয়োটার মতো অটোমোবাইল কোম্পানিগুলো ব্যাপকভাবে বিনিয়োগ শুরু করেছে। টেসলার ডিসকাউন্টের কারণে আগে যেসব মানুষের জন্য বৈদ্যুতিক গাড়ি কেনাটা দুঃসাধ্য ছিল তারাও এখন সহজেই বৈদ্যুতিক গাড়ি কিনতে পারবেন। সবচেয়ে বেশি সুবিধা পাবেন মার্কিন ও ফরাসি ক্রেতারা। কারণ কিছু কিছু মডেলের বৈদ্যুতিক গাড়ি কেনার ক্ষেত্রে বিশেষ ফেডারেল ট্যাক্স সুবিধা পাবেন এ দুটি দেশের ক্রেতারা। টেসলার সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া গাড়িগুলোর মধ্যে রয়েছে মডেল থ্রি সেডান ও মডেল ওয়াই ক্রসওভার এসইউভি। এই গাড়ি দুটিতে টেসলা দাম কমিয়েছে ৬ থেকে ২০ শতাংশ। দাম কমানোর পর এখন টেসলার মডেল ওয়াই যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আগের ৬৫ হাজার ৯৯০ ডলার থেকে হ্রাস পেয়ে এখন পাওয়া যাবে ৫২ হাজার ৯৯০ ডলারে। এ দুটি মডেলের পাশাপাশি টেসলা যুক্তরাষ্ট্রে তাদের মডেল এক্স লাক্সারি ক্রসওভার এসইউভি এবং মডেল এস সেডানের দামও কমিয়েছে। ইউরোপে সম্প্রতি কমতে থাকা মূল্যস্ফীতির সঙ্গে এই দাম কমানোর সম্পর্ক আছে বলে দাবি করেন টেসলার এক মুখপাত্র। জার্মানিতে মডেল থ্রি এবং মডেল ওয়াই গাড়িগুলোর দাম এক শতাংশ থেকে ১৭ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়েছে টেসলা। দেশটিতে সবচেয়ে জনপ্রিয় মডেল ওয়াই আগের দাম থেকে ৯ হাজার ১০০ ইউরো কমে এখন বিক্রি হচ্ছে ৪৪ হাজার ৮৯০ ইউরোতে। এ ছাড়া ফ্রান্সে মডেল থ্রি গাড়ি কিনলে অতিরিক্ত ৫ হাজার ইউরো ফ্রান্স সরকারের ইভি স্কিমের আওতায় ভর্তুকি পাবেন ক্রেতারা। দাম কমানোর মাধ্যমে টেসলার জনপ্রিয় ৫ সিটের মডেল ওয়াই গাড়িগুলোও মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের ট্যাক্স সুবিধার আওতায় চলে আসবে। এর আগে মডেল ওয়াইয়ের লং রেঞ্জ ভার্সনের গাড়িগুলো এ ট্যাক্স সুবিধার আওতার বাইরে ছিল। এদিকে ইলন মাস্কের টেসলার দাম কমিয়ে দেওয়ায় বিপাকে পড়েছে টেসলার প্রতিদ্বন্দ্বী গাড়ি কোম্পানিগুলো। ইউরোপের ডয়েচ ব্যাংক এক হিসাবে জানিয়েছে, দাম কমানোর ফলে টেসলার মডেল ওয়াই গাড়িগুলোর দাম প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ফোর্ড-এর মাসটাং ম্যাক ই মডেলের থেকে ১৮ হাজার ডলার দাম কম পড়বে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, মাস্কের দাম কমানোর পদক্ষেপে যদিও টেসলার মুনাফা কমে যাবে কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রতিষ্ঠানের প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে এবং এই পদক্ষেপ প্রতিদ্বন্দ্বীদের ব্যাপক অসুবিধায় ফেলবে। টেসলার শেয়ারের দর পড়ে গেলেও প্রতিদ্বন্দ্বীদের শেয়ারের দর আরও বেশি করে পড়বে। ইতোমধ্যেই মার্কিন অটোমোবাইল জায়ান্ট জেনারেল মোটরস ও ফোর্ড-এর শেয়ারের দর যথাক্রমে ৪ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ৬ শতাংশ কমে গেছে। তবে দাম কমানোয় বিশ্বজুড়ে টেসলার বিক্রি চলতি বছর ১২ থেকে ১৫ শতাংশ বেড়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এদিকে সম্প্রতি যারা টেসলার গাড়ি কিনেছেন তারা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন টেসলার এই দর কমানোর ঘোষণায়। ডিসকাউন্ট না পাওয়ায় নিজেদের বঞ্চিত মনে করছেন। বিশেষত গত বছরের ডিসেম্বরে যারা গাড়ি কিনেছেন তাদের ক্ষোভ আরও বেশি। চীনে টেসলার বিক্রয় কেন্দ্রের সামনে জড়ো হয়ে রীতিমতো ক্ষোভ ঝেড়েছেন টেসলার গাড়ির মালিকরা।

 

স্টক মার্কেটে কারসাজিতে ফাঁসলেন

টুইটার অধিগ্রহণের পর থেকে সময়টা একেবারেই ভালো যাচ্ছে না শীর্ষ ধনকুবের ইলন মাস্কের। টুইটার কেনার পর টুইট করে জানান, কীভাবে বদলাবেন এই কোম্পানি। সেই থেকে শুরু, একের পর এক বিতর্কে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন তিনি। এবার স্টক মার্কেটে কারসাজির অভিযোগে মঙ্গলবার বিচারব্যবস্থার মুখোমুখি হচ্ছেন ইলন মাস্ক। মামলাটি ক্যালিফোর্নিয়া থেকে টেক্সাসে সরিয়ে নেওয়ার জন্য বিচারককে অনুরোধ জানিয়েছিলেন মাস্ক। কিন্তু এই আবেদন খারিজ করে দেন ফেডারেল বিচারক। জানা গেছে, ২০১৮ সালের আগস্টে তৎকালীন টেসলার সিইও ইলন মাস্ক একটি টুইট করেন। সেখানে তিনি বলেন, টেসলাকে ব্যক্তিগতভাবে প্রাইভেট কোম্পানিতে নেওয়ার জন্য তাঁর কাছে পর্যাপ্ত তহবিল রয়েছে। এর ফলে তখন কোম্পানির শেয়ারের দাম হু হু করে বেড়ে যায়। টুইটারে পোস্টের মাধ্যমে বিলিয়ন ডলার খরচ করার অভিযোগে শেয়ারহোল্ডাররা মাস্কের বিরুদ্ধে মামলা করেন।

 

টুইটারে সর্বনাশ

এখনো টুইটার নিয়ে ব্যস্ত ইলন মাস্ক। টানছেন অযথা বিতর্কও। টেসলা নিয়ে খুব একটা সিরিয়াসও নন তিনি। বিনিয়োগকারীদের অনেকেই এমনটা ভাবছেন। আর সে কারণেই টেসলার শেয়ার বিক্রি করে টাকা তুলে নিচ্ছেন তাঁরা। ইলন নিজেও টেসলার শেয়ার বিক্রি করে টুইটার কিনে নেন। একটু পেছন ফিরে তাকালে দেখব, ২০২১ সালের এপ্রিলে টুইটার গভর্নিং বোর্ডে যোগ দেন মাস্ক। পরের ছয় মাসে যা ঘটেছিল সে রকম ঘটনা সিলিকন ভ্যালি খুব কমই দেখেছে। টুইটারের মালিকানা বদল নিয়ে চুক্তি এক দিন এগোচ্ছে তো পরদিনই ভেঙে পড়ছে- এ রকম একটা অবস্থা। শেষমেষ বিশাল অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে মালিক বনে যান তিনি। যদিও লাভের চেয়ে লোকসানের পরিমাণ বেশি, তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই মাস্কের। মানব ইতিহাসে প্রথমবার, প্রায় ২০০ বিলিয়ন ডলার হারান তিনি। বিশ্বের ধনীতম মানুষটি এবার বিশ্বের সবচেয়ে বেশি লোকসানকারীর তকমা পেলেন। তবে লোকসানের মূল কারণ কিন্তু টেসলার শেয়ার দরের পতন। বিপুল হারে কমেছে বৈদ্যুতিক গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান টেসলার শেয়ার। বিশেষজ্ঞরা বলেন, একটা সময় ছিল যখন সবাই বিশ্বাস করতেন যে ইলন মাস্ক বিজ্ঞান, প্রযুক্তির অগ্রগতির মাধ্যমে বিশ্বকে পাল্টে দিচ্ছেন। কিন্তু তাঁর টুইটার ফেজ-এর পর থেকে ইলনের নামের সঙ্গে রাজনীতি, বিতর্ক ইত্যাদি জড়িয়ে গেছে। ফলে আগের মতো চোখ বুজে ভরসা করছেন না অনেকেই। ফলে কমে শেয়ারের দর, হারান শীর্ষ ধনকুবেরের খেতাব।

 

তাঁর যত ব্যবসা

যাত্রা শুরুর গল্প

১৯৯৫ সাল, ইন্টারনেট তখন নতুন। খবরের কাগজের জন্য ইন্টারনেট সে সময় গাইড হিসেবে কাজ করবে, এমন সফটওয়্যার আবিষ্কার করলেন তরুণ উদ্ভাবক ইলন মাস্ক। যার নাম দেওয়া হলো জিপ টু। তাঁর ভাইকে নিয়ে সফটওয়্যার কোম্পানিটি দাঁড় করান মাস্ক। মাস্ক তখন কোম্পানির ৭ শতাংশ শেয়ারের মালিক। প্রথম কাজেই সফলতা পেলেন। তাঁর সফটওয়্যারটি নজরে পড়ল বিখ্যাত টেক কোম্পানি কমপ্যাকের। ১৯৯৯ সালে কোম্পানিটি বিক্রি করে তাঁর পকেটে ঢুকল প্রায় ২২ মিলিয়ন ডলার।

 

এরপর পেপ্যাল

মানি ট্রান্সফার কোম্পানির মাধ্যমে মুহূর্তের মধ্যে টাকা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পাঠানোর আইডিয়া প্রথম আনেন তিনি। বাস্তবায়নও করেছিলেন তিনি একই বছর (১৯৯৯ সাল) মানি ট্রান্সফার কোম্পানি এক্স ডটকম চালু করার মাধ্যমে; যা পরবর্তীকালে রূপ নেয় অনলাইন মানি ট্রানজেকশনের মাধ্যম পেপ্যালে। ২০০২ সালে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইবে পেপ্যালকে ১.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে কিনে নেয়। পেপ্যালের ১১ শতাংশ শেয়ারের মালিক ছিলেন মাস্ক, তাঁর অ্যাকাউন্টে জমা হয়েছিল ১৬৫ মিলিয়ন ডলার!

 

সীমানা পেরিয়ে মহাকাশ

রকেটের মাধ্যমে মহাকাশে পণ্য সরবরাহের চিন্তাটা ইলন মাস্কের মাথায় ছিল আগেই। রাশিয়ায় রকেট কিনতে গিয়ে ভাবলেন কম খরচে রকেট বানাবেন। ২০০২ সালে গঠন করলেন স্পেসএক্স। স্পেসএক্স থেকে ফ্যালকন-১ নামের রকেটটি উৎক্ষেপণ করতে গিয়ে বারবার ব্যর্থ হয়েছিলেন কিন্তু হাল ছাড়েননি। সম্প্রতি ফ্যালকন-১ এর সফল উৎক্ষেপণ হয়। ইলন মাস্ক নাম লেখালেন ইতিহাসে। মাত্র ৬০ জন কর্মী নিয়ে যাত্রা শুরু করা স্পেসএক্স কোম্পানিতে বর্তমানে প্রায় ৭ হাজারের বেশি কর্মী কাজ করছেন।

 

টেসলা দিয়ে শীর্ষস্থান

বিশ্বের জ্বালানি সংকট মোকাবিলায় ইলেকট্রনিক কারের মাঝেই ভবিষ্যৎ খুঁজে পেয়েছিলেন ব্যবসায়ী মাস্ক। তাই ২০০৪ সালে মার্টিন ইবারার্ট এবং মার্ক টারপেনিং-এর সঙ্গে চালু করেন টেসলা মোটরস। বছর দুয়েকের মাথায় প্রথম বৈদ্যুতিক গাড়ি নিয়ে আসে মাস্কের টেসলা মোটরস। পরে ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে পরিবেশবান্ধব গাড়ির জনপ্রিয়তা। ২০০৮ সালে টেসলার স্পোর্টস কার রোডস্টার বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতগামী গাড়ির খেতাব অর্জন করে। মাস্কের বিশ্বাস, বিশ্বের দ্রুতগামী গাড়ির খেতাব অর্জন করবে টেসলা।

 

দ্য বোরিং কোম্পানি

২০১২ সালে দৈনন্দিন হাইপার-লুপ প্রযুক্তির ব্যবহারে আগ্রহ দেখান ইলন মাস্ক। হাইপারলুপ-এর জন্য সুড়ঙ্গ খুঁড়তে তিনি ‘দ্য বোরিং কোম্পানি’ প্রতিষ্ঠা করেন। রাস্তায় গাড়ির জ্যামে বিরক্ত হয়ে এমন পরিকল্পনা করেন মাস্ক। তাঁর স্বপ্ন হচ্ছে কয়েকটি সুড়ঙ্গ তৈরি করা যেগুলো দিয়ে মানুষ ও গাড়ি যানজট ছাড়াই পার হয়ে যাবে। সুড়ঙ্গের ভিতর দিয়ে গাড়ি চলবে এমনটা নয়। বরং এটি থাকবে একটি পডের ওপর, ওই পড চলবে নেটওয়ার্কে। সম্প্রতি ঘণ্টায় ১ হাজার কি.মি. গতিতে চলা হাইপার-লুপের সফল পরীক্ষা হয়।

 

হাইপার-লুপ

২০১৩ সালে মাস্ক যাতায়াতের এক নতুন পদ্ধতির ঘোষণা দেন। নাম দেওয়া হয় হাইপার-লুপ। এর মাধ্যমে বড় শহরগুলোয় খুব সহজেই যাতায়াত সম্ভব হবে। প্রযুক্তিটি বাস্তবায়িত হলে তা হবে দ্রুতগতির (ঘণ্টায় ৬০০ মাইল)। এটি টিউব কেন্দ্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থা। টিউবটি একটি দেশের বিভিন্ন শহরে কিংবা কয়েকটি ভিন্ন দেশে যুক্ত থাকবে। যার ভিতরে থাকবে ক্যাপসুল আকৃতির যানবাহন। উদাহরণ হিসেবে মাস্ক বলেন, প্রযুক্তিটির মাধ্যমে নিউইয়র্ক থেকে লস অ্যাঞ্জেলেস যেতে সময় লাগবে মাত্র ৪৫ মিনিট।

 

প্রতিভাবান একজন

দক্ষিণ আফ্রিকার ছেলে

১৯৭১ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রিটোরিয়ায় ইলন মাস্কের জন্ম। বাবা দক্ষিণ আফ্রিকান ও কানাডিয়ান মায়ের সন্তান ইলনের পুরো নাম ‘ইলন রিভ মাস্ক’।

 

শেষ করেননি শিক্ষাজীবন

স্নাতকোত্তর শেষে পিএইচডির জন্য যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পান। কিন্তু অর্থ উপার্জনের নেশায় পিএচইডি অধরা থেকে যায়। বর্তমানে উদ্যোক্তা হিসেবে বিশ্বের তরুণদের আইকন তিনি।

 

প্রতিভাবান

মাত্র ১০ বছর বয়সেই কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ে পারদর্শিতা লাভ করেন। ১২ বছর বয়সে বেসিক প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ ব্যবহার করে ব্লাস্টার নামের একটি ভিডিও গেম তৈরি করেন, যা পরবর্তীতে ৫০০ ডলারে পিসি অ্যান্ড অফিস টেকনোলজি ম্যাগাজিনের কাছে বিক্রি করেছিলেন।

 

বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট

বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট মহাকাশে পাঠায় ইলন মাস্কের কোম্পানি স্পেসএক্স। বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটটি স্পেসএক্স-এর সবচেয়ে আধুনিক ফ্যালকন রকেটের মাধ্যমে ২০১৮ সালের মে মাসে মহাকাশে পাঠানো হয়।

 

বেতন

টেসলার সিইও হিসেবে বছরে বেতন নেন মাত্র এক ডলার। নিজের অংশীদারিত্ব থাকা বিভিন্ন কোম্পানি থেকে প্রাপ্ত লভ্যাংশসহ আরও কিছু সুবিধা পান মাস্ক। বছরে ১ ডলার বেতন সিলিকন ভ্যালির ট্রেন্ড।

 

বিতর্কিত চরিত্র

বিতর্কের জন্ম দিতে ভালোবাসেন মাস্ক। টুইটারে নানা বিতর্কিত টুইটও করেন। শুধু তাই নয়, নিজ প্রতিষ্ঠানের সহযোগীদের সঙ্গেও নানা সময় দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। ২০০৮ সালে কমেডিয়ান জো রোগান-এর সঙ্গে অংশ নেওয়া এক পডকাস্টে সরাসরি সম্প্রচারের সময় গাঁজা সেবন করে দারুণ বিতর্কের জন্ম দিয়েছিলেন।

 

সমালোচনা

জীবনে সফল হয়েছেন অথচ সমালোচনার শিকার হননি, এ রকম উদাহরণ খুঁজে বের করা আসলেই দুষ্কর। যেমনটি ঘটেছে ইলন মাস্কের ক্ষেত্রেও। স্কুলজীবন থেকেই তিনি অন্য শিক্ষার্থীদের চোখে ছিলেন তুচ্ছ। আবার সমালোচিত হন নিজের চিন্তাধারার জন্যও। এমনকি মাস্কের মঙ্গলগ্রহকে নিয়ে এত সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনাকেও অনেকে অহেতুক বলেছেন। যদিও মঙ্গলের স্বপ্ন কেবলই সময়ের ব্যাপার।

 

পাত্তা দেননি কভিড-১৯

করোনাভাইরাসকে একেবারেই পাত্তা দেননি এই প্রযুক্তি উদ্যোক্তা। ২০২০ সালের এপ্রিলে কভিড-১৯ নিয়ে আতঙ্কিত হওয়া বোকামি বলে সমালোচিত হন মাস্ক। যদিও পরে তিনি কভিড-১৯ এ আক্রান্ত হন। লকডাউনে ফ্যাক্টরি বন্ধ রাখার ঘোষণা উপেক্ষা করে নিজের কার্যক্রম চালিয়ে গেছেন।

সর্বশেষ খবর