বৃহস্পতিবার, ৯ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

ভয়াবহ যত বিস্ফোরণ

আবদুল কাদের

ভয়াবহ যত বিস্ফোরণ

২০২০ সালের আগস্ট- বিশ্ববাসী হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে দেখল বিশাল এক বিস্ফোরণ। যার নাম ‘বৈরুত এক্সপ্লোশন’। মুহূর্তে হতাহতের সংখ্যা দাঁড়িয়ে গেল হাজারের কোটায়। জোড়া বিস্ফোরণে ল-ভ- হয়ে যায় লেবাননের রাজধানীর বৈরুত বন্দর। এই বিস্ফোরণই কেবল বিশ্বকে কাঁপিয়ে তোলেনি। মানবসৃষ্ট অসংখ্য ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা রয়েছে- যা আক্ষরিক অর্থে নাড়িয়ে দিয়েছে সমগ্র বিশ্বকে। আর সেই তালিকাটিও নেহায়েত কম বড় নয়।  পারমাণবিক বোমা পরীক্ষা থেকে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট বিস্ফোরণ; সব বিপর্যয়েই ছিল মানুষের হাত।  এর বাইরেও আছে নানা কারণ। সেসব বিপর্যয়ের ঘটনা নিয়ে রকমারি

 

বৈরুত বিস্ফোরণ

লেবানন : ২০২০ সাল

তীব্র শব্দে রাজধানীসহ আশপাশের এলাকাগুলোয় ব্যাপক কম্পনের সৃষ্টি হয়েছিল।  একের পর এক বিস্ফোরণে বন্দরনগরী ল-ভ- হয়ে যায়।

২০২০ সালের ৪ আগস্ট; বিশ্ববাসী দেখেছিল এক ভয়াবহ বিস্ফোরণ। লেবাননের রাজধানী বৈরুতে ওই বিধ্বংসী বিস্ফোরণে দেখা গিয়েছিল মৃত্যুর মিছিল। হতাহতের সংখ্যা পেরোয় কয়েক হাজারে। তীব্র শব্দে রাজধানীসহ আশপাশের বিস্তীর্ণ এলাকায় কম্পনে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছিল। পরপর জোড়া বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে গোটা বন্দর। পুরো এলাকা ল-ভ- হয়ে যায়। বৈরুতের বন্দর এলাকায় এই বিস্ফোরণের কারণ ছিল অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট। প্রায় আড়াই হাজার টন অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট মজুদ ছিল সেখানে। বিস্ফোরণের কারণে কম্পন অনুভূত হয়েছিল ২৪০ কিলোমিটার দূরে সাইপ্রাস দ্বীপেও।

২০২০ সালের ৪ আগস্ট মঙ্গলবার স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৬টার দিকে ছোট এক বিস্ফোরণের পর বৈরুত বন্দরের পাশের একটি ভবনে আগুনের সূত্রপাত। এর কিছুক্ষণ পর দ্বিতীয় বিস্ফোরণ, মুহূর্তেই আশপাশে কয়েক ডজন ভবন ও স্থাপনা ধসে যায়। এই বিধ্বংসী বিস্ফোরণে বৈরুতের আকাশ কালো ধোঁয়ায় ছেয়ে যায়। যার অনেক ভিডিও ভাইরাল হয় ইন্টারনেটে। ভিডিওতে দেখা যায়, বৈরুতের বন্দর এলাকায় বিশালাকারের ধোঁয়ার কুন্ডলী, কিছুক্ষণের মধ্যে বিকট শব্দে উড়ে যায় গাড়ি এবং ভবন।

মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা জানিয়েছিল, এই বিস্ফোরণের ফলে ৩ দশমিক ৩ মাত্রার ভূকম্পন অনুভূত হয়েছিল। আর এতে ধসে যায় শত শত অবকাঠামো। রয়টার্স তাদের প্রতিবেদনে জানায়, বিস্ফোরণে বাড়িঘর এমনভাবে কেঁপে ওঠে যে, স্থানীয়রা ভেবেছিল ভূমিকম্প হচ্ছে। মুহূর্তেই রাজধানীজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক। বাড়িঘরের জানালার কাচ ও ব্যালকোনি ভেঙে আহত হন অনেকে। আহতদের চিকিৎসাসেবা দিতেও হিমশিম খেতে হয় স্থানীয় হাসপাতালগুলোকে। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে দেখা দেয় রক্ত সংকট। স্থানীয় গভর্নর মার্কিন সংবাদমাধ্যম স্কাই নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, প্রথম বিস্ফোরণের পর আগুন নেভানোর কাজে নিয়োজিত ফায়ার সার্ভিসের একটি ইউনিট দ্বিতীয় বিস্ফোরণে সম্পূর্ণ নিখোঁজ হয়ে যায়। বিস্ফোরণের ভয়াবহতায় এক নিমিষে যেন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় গোটা এলাকা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ভেঙে পড়ে ঘরবাড়ি, জানালা। রক্তাক্ত অবস্থায় মানুষকে ছোটাছুটি করতে দেখা যায় রাস্তায়। বিস্ফোরণের তীব্রতা এতই ভয়াবহ ছিল যে, বহুদূর পর্যন্ত শোনা যায় সেই শব্দ। আগুন ছড়িয়ে পড়ার পরই যুদ্ধকালীন তৎপরতায় শুরু হয় আগুন নেভানোর কাজ। আকাশ থেকেও চলে আগুন নেভানোর কাজ। স্থানীয় লোকজন বিস্ফোরণকে পরমাণু বিস্ফোরণ বলে মন্তব্য করে। দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বাড়িও ভেঙে চুরমার হয় বিস্ফোরণে। যদিও প্রাণে বেঁচে যান তিনি। কী করে এত বড় ধ্বংসযজ্ঞ ঘটল তার কারণ অনুসন্ধানের পর লেবাননের নিরাপত্তা প্রধান জানিয়েছিলেন, এটি একটি দুর্ঘটনা। আলজাজিরাও তাদের প্রতিবেদনে বলে, ভয়াবহ ওই বিস্ফোরণে রাজধানী বৈরুত থেকে ২০০ কিলোমিটার দূরে ভূমধ্যসাগরের অপর পাড়ের সাইপ্রাসেও ঘটনাস্থলের ১০ কিলোমিটার দূরের বাড়িগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

পারমাণবিক বিস্ফোরণ বাদ দিলে বৈরুতের ওই বিস্ফোরণ বিশ্বের অন্যতম প্রাণঘাতী বিস্ফোরণ। কিন্তু এই ঘটনার পর বিশ্ব যেভাবে নড়েচড়ে বসেছিল, তাতে ধারণা করা হয়েছিল এর সুরাহা হবে। কিন্তু এক বছর পর এসে দেখা যাচ্ছে, প্রত্যাশার বিপরীতে প্রাপ্তি শূন্য। কারণ, এই বিস্ফোরণের পর অনেকে কাজ হারিয়েছেন। এখনো দুর্দশার মধ্যে দিনাতিপাত করছেন বৈরুতবাসী।

 

জার বোম্বা

রাশিয়া : ১৯৬১ সাল

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন মেতে ওঠে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায়। যার অংশ হিসেবে ১৯৬১ সালের ৩০ অক্টোবর রাশিয়ার উত্তরে কোলা উপদ্বীপের ওলেনয়া এয়ারফিল্ডে ইউএসএসআর অর্থাৎ সোভিয়েত ইউনিয়ন তু-৯৫ আণবিক বোমার পরীক্ষা চালায়। ১৯৪৯ সালের ২৯ আগস্ট জো-১ পরমাণু বোমার পরীক্ষা চালায় সোভিয়েত ইউনিয়ন। ১৯৫৮ সালের মধ্যে দেশটি ৩৬টি পরমাণু বোমার পরীক্ষা চালায়। কিন্তু তু-৮৫ বা জার বোম্বার তুলনায় এ বোমাগুলো কিছুই নয়। জার বোম্বা এতই বড় ছিল যে, কোনো বিমানে তা আটানো ছিল কষ্টসাধ্য। বিশাল বোমাটি ছিল ৮ মিটার লম্বা, ২.৬ মিটার ব্যাস এবং ওজন ছিল ২৭ টন। হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে ব্যবহার করা লিটল বয় ও ফ্যাটম্যানের মতো প্রলয়ঙ্করী ছিল এই বোমা। বার্নেট সাগরের জনমানবহীন নোভইয়া জেমলিয়া দ্বীপপুঞ্জে এই বোমার পরীক্ষা করা হয়। প্যারাস্যুট দিয়ে যখন বোমাটি নামানো হয় তখন তা ১৩ হাজার ফুট নিচে নেমে বিস্ফোরিত হয়।  ওই হাইড্রোজেন বোমার শক্তি ছিল ৫০ হাজার কিলো টন। ঘটনাস্থল থেকে বোমারু বিমান ছিল মাত্র ৫০ কিলোমিটার দূরে। দুই পাইলট ভাগ্যের জোরে বেঁচে যান। প্রায় ৬৪ কিলোমিটার উঁচু মেঘের সৃষ্টি হয় যার বিস্তার ছিল ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত। বিস্ফোরণে সৃষ্ট মাশরুম আকৃতির মেঘ এভারেস্টের উচ্চতার সাতগুণ উচ্চতায় পৌঁছে যায়। এই মেঘের সামনের অংশ ৯৫ কিলোমিটার বিস্তৃত হয়। এটি ছিল লিটল বয় ও ফ্যাটম্যান থেকে দেড় হাজার গুণ বেশি শক্তিশালী। যার ফলে আশপাশের অঞ্চলে এই বিস্ফোরণের প্রভাব ছিল ধ্বংসাত্মক। টেস্ট সাইটের ৫৫ কিলোমিটার দূরে সেভারি দ্বীপের সমস্ত কাঠ এবং পাথরের বাড়ি এবং স্থাপনা ধূলিসাৎ হয়ে যায়। বোমা বিস্ফোরণের পর কয়েক ঘণ্টার জন্য স্থানীয় রেডিও যোগাযোগ সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে গিয়েছিল।

 

হ্যালিফ্যাক্স বিস্ফোরণ

কানাডা : ১৯১৭ সাল

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন কানাডার হ্যালিফ্যাক্স বন্দর উত্তর আমেরিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ নৌঘাঁটি হিসেবে বিবেচিত হতো। ১৯১৭ সালের ৬ ডিসেম্বর কানাডার পূর্বের আটলান্টিক প্রদেশের নোভা স্কোশিয়ার রাজধানী হ্যালিফ্যাক্সে ঘটেছিল স্মরণকালের ইতিহাসের ভয়াবহ মানবসৃষ্ট বিস্ফোরণ; যা ১৯৪৫ সালের আণবিক বোমা বিস্ফোরণের আগে ঘটিত বিশেষ উল্লেখযোগ্য বিপর্যয়রূপে ইতিহাসে আলোচিত হয়। সেদিন সকাল ৯টায় নরওয়ের জাহাজ এসএস ইমো প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বেলজিয়াম রিলিফ কমিশনের বিভিন্ন ত্রাণসামগ্রী নিয়ে হ্যালিফ্যাক্স বন্দরের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। একই সময়ে নিউইয়র্ক থেকে আগত ফ্রান্সের বাষ্পচালিত একটি জাহাজ এসএস মন্ট ব্লাঁ বন্দর অভিমুখে যাত্রা করলে এসএস ইমোর সঙ্গে বিরাট সংঘর্ষ হয়। মন্ট ব্লাঁ জাহাজটি ২ হাজার ৯৩৫ টন বিস্ফোরক বহন করছিল। বিস্ফোরক বহনকারী জাহাজের লাল পতাকার হুঁশিয়ারি উত্তোলন করার বিধান থাকলেও জাহাজটি তা করেনি। মন্ট ব্লাঁ জাহাজে দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়লে তা ব্যাপক শব্দে বিস্ফোরিত হয়। ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে বিশাল এক জলোচ্ছ্বাস তীরবর্তী বিস্তৃত অঞ্চলে আঘাত হানে। এ বিস্ফোরণে হ্যালিফ্যাক্সের সৈকত থেকে উত্তরে ৮০০ মিটার বিস্তৃত অঞ্চল ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর মধ্যে ছিল কানাডার ফার্স্ট নেশন মিকমা সেটেলমেন্টের টার্টেল কোভ অঞ্চল, আফ্রিকান নোভা স্কোটিয়ান সম্প্রদায়ের জন্য নির্ধারিত আফ্রিকভিল এলাকা, রেললাইন ও ডার্টমাউথ হারবারের অনেকাংশ। এই বিস্ফোরণে প্রায় ২ হাজার নিরীহ অধিবাসী নিহত হন। ৯ হাজার মানুষ আহত হন। ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলের ২৫ হাজারের বেশি অধিবাসী পর্যাপ্ত আশ্রয়ের অভাবে গৃহহীন হয়ে পড়েন। কানাডার সুপ্রিম কোর্ট ও লন্ডনের প্রিভি কাউন্সিল জুডিশিয়াল কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এ বিপর্যয়ের জন্য দুটি জাহাজই সমানভাবে দায়ী।

 

আরএএফ ফল্ড

ইংল্যান্ড : ১৯৪৪ সাল

আরএএফ ফল্ড মূলত একটি সামরিক দুর্ঘটনা; যা ঘটেছিল ইংল্যান্ডের স্টাফোর্ডশায়ারের একটি ভূগর্ভস্থ সামরিক স্টোরেজ ডিপোতে। সেখানে সংরক্ষিত ছিল সামরিক বাহিনীর অসংখ্য গোলাবারুদ। ১৯৪৪ সালের শেষ দিকে- ২৭ নভেম্বর সকাল সোয়া ১১টায় হঠাৎ এক বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে গোটা স্টাফোর্ডশায়ার; যা ছিল বিশ্বের বৃহত্তম অপরমাণু বিস্ফোরণ। ইংল্যান্ডের ইতিহাসে আরএএফ ফল্ড বিস্ফোরণই সবচেয়ে বৃহৎ সামরিক বিপর্যয়। সেদিন স্টাফোর্ডশায়ারের হ্যানবুরি গ্রামে ওই ভূগর্ভস্থ সামরিক স্টোরেজ ডিপোতে ভয়ানক বিস্ফোরণ ঘটে। সরকারি তথ্য মতে, আরএএফ ফল্ডে সংরক্ষিত থাকা ৩ হাজার ৫০০ থেকে ৪ হাজার টন অস্ত্র-গোলাবারুদ বিস্ফোরিত হয়। যেখানে সংরক্ষিত ছিল সামরিক বাহিনীর বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ। ভয়াবহ বিস্ফোরণ হলেও ভাগ্যক্রমে ক্ষয়ক্ষতি আর নিহতের পরিমাণ ছিল সীমিত। তবে বিস্ফোরণে আশপাশের এলাকা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সরকারি তথ্যমতে, বিস্ফোরণে স্টাফোর্ডশায়ারের আশপাশের খামারগুলো সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। এমনকি স্থানীয় একটি জলাশয়ের পানি পুরো এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। ফলে বন্যার সৃষ্টি হয়। সে সময়ের প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, বিকট বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে এবং আকাশজুড়ে ছিল বিশাল ধোঁয়ার কুন্ডলী; যা দেখতে অনেকটা মাশরুম আকৃতির। ভয়ানক বিস্ফোরণের পর হ্যানবুরি গ্রামে প্রায় ১২ একর এলাকাজুড়ে প্রায় ৪০০ ফুট (১২০ মিটার) গভীর গর্তের সৃষ্টি হয়। স্টাফোর্ডশায়ারের হ্যানবুরির পূর্বদিকে ফল্ডের ঠিক দক্ষিণে গর্তটি এখনো দৃশ্যমান। স্থানীয়দের কাছে এটি এখনো হ্যানবুরি ক্রেটার নামে পরিচিত। সেদিনের বিস্ফোরণে মৃত্যের সংখ্যা এখনো অজানা। তবে ধারণা করা হয়, বিস্ফোরণে সৃষ্ট বন্যায় ৭০ জন মানুষ মৃত্যুবরণ করেছিল। আহত হয় আরও কয়েক শ মানুষ।

 

টেক্সাস সিটি বিস্ফোরণ

যুক্তরাষ্ট্র : ১৯৪৭ সাল

বৈরুত বিস্ফোরণ ১৯৪৭ সালের টেক্সাস বিস্ফোরণের ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেয়। টেক্সাস স্টেট হিস্টোরিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (TSHA) অনুসারে, সে বছর ১৬ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস বন্দরের একটি মালবাহী ফরাসি জাহাজ এস এস গ্র্যান্ড ক্যাম্প অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট নিয়ে রওনা হচ্ছিল। ঠিক সেই সময় জাহাজেরই এক কর্মী খুব সম্ভবত ধূমপান শেষে জ্বলন্ত সিগারেটের অংশ হেলায় ছুড়ে ফেলেছিল কাগজের বস্তাবন্দি অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের স্তূপে। ফলাফল- ভয়াবহ বিস্ফোরণ। সেদিন বন্দরে কর্র্তব্যরত একজন কর্মীও প্রাণে বাঁচেননি। বিস্ফোরণে ৫৬০ জনের বেশি মৃত্যু হয় এবং অসংখ্য ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে যায়।

 

পেপকন বিস্ফোরণ

যুক্তরাষ্ট্র : ১৯৮৮ সাল

৩৫ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের লাস ভেগাস উপত্যকা দেখেছিল ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বিস্ফোরণ। বিশ্ব দরবারে ঘটনাটি পেপকন বিস্ফোরণ নামে পরিচিত। সময় তখন ১৯৮৮ সালের ৪ মে। অঞ্চলটির হেনডারসনের প্যাসিফিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড প্রোডাকশন করপোরেশন অব নেভাদার (পেপকন) প্ল্যান্টের একটি ভবনে আগুন লেগে যায়। মাত্র ৪ মিনিটের মধ্যে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং পর পর তিনটি ব্যাপক বিস্ফোরণ ঘটায়। সেদিন প্রায় ৯ মিলিয়ন পাউন্ড রকেটের জ্বালানি নির্গত হয়েছিল। এতে প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলারের জ্বালানির ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। নেভাদার দুর্ঘটনায় দুজনের মৃত্যু হয় এবং ৩৭২ জন আহত হন।

 

তিয়ানজিন বিস্ফোরণ

চীন : ২০১৫ সাল

২০১৫ সালের ১২ আগস্ট; সময় তখন রাত সাড়ে ১১টা। আকস্মিক জোরালো বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে চীনের উত্তরাঞ্চলের বন্দরনগরী তিয়ানজিন। সরকারি তথ্য অনুসারে, কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে দুটি শক্তিশালী বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণের তীব্রতা ছিল মাঝারি মাপের ভূমিকম্পের সমান। বিস্ফোরণের পর দাবানলে পরিণত হয় গোটা বন্দর। যেখানে ছিল গাড়ির কারখানা, বিমান নির্মাণ কারখান, বিভিন্ন ধরনের উৎপাদন শিল্পপ্রতিষ্ঠান এবং গবেষণা সংস্থার দফতর। গুদাম জ্বলে যায়। কালো ধোঁয়ার কুন্ডলী ঢেকে দেয় নগরী। সে দিনের দুর্ঘটনায় আহত হন হাজারের বেশি এবং প্রাণ হারান ১৭৩ জন। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল ১.১ বিলিয়ন ডলার।

 

সাইপ্রাস বিস্ফোরণ

সাইপ্রাস : ২০১১ সাল

২০১১ সালে ১১ জুলাইয়ের ভোরবেলা সাইপ্রাস দ্বীপের ইভানজেলোস ফ্লোরাকিস নৌঘাঁটিতে হঠাৎ এক বিস্ফোরণ ঘটে। যেখানে প্রচুর পরিমাণে সামরিক সরঞ্জাম সংরক্ষণ করা হয়েছিল। যার মধ্যে ছিল- গানপাউডার ও আর্টিলারিশেল। সরকারি তথ্য অনুসারে, নৌঘাঁটিতে ৯৮ কনটেইনার গানপাউডার ছিল। এদের মধ্যে দুই কনটেইনারে আগুন ধরে গেলে এ ভয়াবহ বিস্ফোরণ হয়। এ ঘটনায় পার্শ্ববর্তী একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই বিস্ফোরণে আশপাশ অঞ্চলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। প্রায় তিন কিলোমিটার দূরের একটি বাড়ি ও একটি রেস্টুরেন্টের দরজা-জানালা উড়ে যায়। ভয়াবহ নৌঘাঁটি বিস্ফোরণে ১৩ জন নিহত এবং ৬২ জন আহত হন।

 

বান্সফিলএড বিস্ফোরণ

ইংল্যান্ড : ২০০৫ সাল

সময়টা ২০০৫ সালের শেষ- ১১ ডিসেম্বর ইংল্যান্ডের বান্সফিলএড-এ বৃহত্তম ওয়েল বিস্ফোরণ হয়। বিস্ফোরণের মাত্রা ছিল ২.৪ এবং এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা ইউরোপে; যা মহাকাশ থেকেও দৃশ্যমান হয়। বান্সফিলএডের ওই বিস্ফোরণের বিকট শব্দ ১২৫ মাইল দূর থেকেও শোনা গিয়েছিল। বৃহত্তম ওই ওয়েল ডিপোর একটি ট্যাঙ্কারে আকস্মিক বিস্ফোরণ ঘটে এবং প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার লিটার পেট্রল জ্বলে যায়। আর মুহূর্তেই ডিপোটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। আশ্চর্যজনকভাবে ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থিত নেদারল্যান্ডস এবং ফ্রান্সে এর প্রভাবে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। তবে স্থানীয় বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে যায়।

 

সীতাকুন্ড বিস্ফোরণ

চট্টগ্রাম : ২০২২

২০২২ সালের ৪ জুন, সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত ১১টায় চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। আগুন লাগার পর সারা রাত থেমে থেমে বিস্ফোরণ হয়। বিস্ফোরণে ঘটনাস্থলের আশপাশের অন্তত চার বর্গকিলোমিটার এলাকা কেঁপে ওঠে। অনেকের ঘরের জানালার কাচ, দরজা ভেঙে যায়। বেশির ভাগ বাসার টেলিভিশন, রেফ্রিজারেটর ও বৈদ্যুতিক পাখা নষ্ট হয়ে যায়। কনটেইনার ডিপোতে ‘হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড’ নামের বিপুল পরিমাণ রাসায়নিক থাকায় আগুন ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। বিস্ফোরণে পুরো এলাকায় কেমিক্যালের বিষাক্ত ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ে। কনটেইনার ডিপোতে এত বড় দুর্ঘটনা আগে ঘটেনি। ঘটনার পর পরই আগুন নেভাতে ও আহতদের উদ্ধারে নামে ফায়ার সার্ভিস। হতাহতদের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করে সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ার এবং নিরাপত্তা দলও। ভয়াবহ ওই দুর্ঘটনায় অন্তত ৪৭ জন নিহত এবং প্রায় ৪৫০ জনের বেশি মানুষ আহত হয়েছে।

 

গুলিস্তান বিস্ফোরণ

ঢাকা : ২০২৩

সময় তখন ৪টা ৫০ মিনিট। সন্ধ্যা নামলে নেমে যেত দোকানের শাটার। ব্যস্ত নগরী প্রস্তুতি নিত পবিত্র শবেবরাতের। কিন্তু সন্ধ্যা নামার আগেই আচমকা বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে ঢাকার গুলিস্তান এলাকা। গুলিস্তানের সিদ্দিকবাজার এলাকা নিমিষেই পরিণত হয় ধ্বংসস্তূপে। দেয়াল ভেঙে এসে পড়ে রাস্তায়। বহু মানুষ উড়ে এসে রাস্তায় পড়েছেন। সড়কে থাকা বহু গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পার্শ্ববর্তী ভবনগুলোও। ভেঙে পড়েছে অনেক ভবনের কাচ। বাসযাত্রী থেকে শুরু করে পথচারী পর্যন্ত আশপাশে থাকা সবাই হতাহত হয়েছেন। তারপর থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে শুধুই আর্তনাদ আর অ্যাম্বুলেন্সের শব্দ। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, মৃতের সংখ্যা এখন পর্যন্ত ২০, আহত শতাধিক। বিস্ফোরণে আহতদের মধ্যে ঢামেক বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি রয়েছে ৩০ জন। বিস্ফোরণের কারণ এখনো স্পষ্ট নয়। র‌্যাব জানিয়েছে, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে- বিস্ফোরণ ভবনের বেজমেন্ট থেকে হয়েছে। গ্যাস জমে কিংবা অন্য কোনোভাবে বিস্ফোরণ ঘটেছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর