সোমবার, ৩ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা

আকাশেই হাওয়া ডি বি কুপার

তানভীর আহমেদ

আকাশেই হাওয়া ডি বি কুপার

কিছু রহস্য মানুষকে যুগের পর যুগ ধরে ভাবায়। রহস্যমানব ডি বি কুপার এমনই এক ব্যক্তি যার নাম শুনলে এখনো চোখ কপালে তোলেন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দারা। তার নিখোঁজ হওয়ার গল্প সিনেমা, রহস্য উপন্যাসের চেয়েও বেশি কিছু। তাকে খুঁজতে গিয়ে বিশ্ববিখ্যাত এফবিআই গোয়েন্দারাও ব্যর্থ।  একটি বোয়িং-৭২৭ বিমান হাইজ্যাক করার পর মাঝ আকাশে ২ লাখ ডলারসহ প্যারাসুট নিয়ে প্লেন থেকে ঝাঁপ দেন কুপার। এরপর কী হলো, কোথায় গেলেন তিনি, সে রহস্য আজও অজানা...

 

বিমান হাইজ্যাক

কুপারের হাতে ২ লাখ ডলার ও দুটি প্যারাসুট

কুপারের সুটকেসে বোমা দেখে ভয়ে কাঁপছিলেন বিমানবালা ফ্লোরেন্স। বিমানে থাকা আরেকজন বিমানবালা টিনা মাকলো একটি ইন্টারকম টেলিফোন নিয়ে কুপারের পাশে বসেন। বিমানচালক এবং কুপারের সঙ্গে কথাবার্তা চলছিল ইন্টারকম টেলিফোনের মাধ্যমে। খুব দ্রুতই খবর জানাজানি হয়ে যায়। আমেরিকার প্রশাসন যাত্রীদের কথা ভেবে কুপারের সব দাবি মেনে নেওয়ার বিষয়ে সম্মতি জানায়। আমেরিকার গোয়েন্দা বিভাগের লোকেরা ভেবেছিল, বিমান একবার মাটিতে পা রাখলে কুপারকে ধরা কোনো ব্যাপারই হবে না। প্রশাসন এবং কুপারের কথাবার্তা চলাকালীন সিয়াটল বিমানবন্দর এলাকাজুড়ে চক্কর খাচ্ছিল বিমানটি। বিমানের ভিতরের যাত্রীরা অবশ্য এসবের কিছুই জানেন না। তারা ভাবছিলেন ৪৫ মিনিটের ফ্লাই শেষে নিরাপদেই গন্তব্যে পৌঁছে যাবেন। এদিকে বিমানবন্দর এলাকায় বিমানটি চক্কর খাওয়ায় যাত্রীদের মধ্যে শোরগোল শুরু হয়। তখন তাদের জানানো হয়, যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বিমান অবতরণ সম্ভব হচ্ছে না। অন্যদিকে সিয়াটলের স্থানীয় ব্যাংক থেকে নগদ ২ লাখ ডলারের বন্দোবস্ত করা হয়। ওই ডলারের নম্বরও নিজেদের কাছে রাখছিল প্রশাসন। কুপারের দাবি মতো দুটি প্যারাসুটও পাঠানো হয়। ৫টা ৪৫ মিনিটে সিয়াটল বিমানবন্দরে বিমানটি অবতরণ করে। সঙ্গে সঙ্গেই কুপারের কাছে নগদ অর্থ এবং প্যারাসুট পৌঁছে দেওয়া হয়। সে সময় বিমানে জ্বালানিও ভরা হয়। এ অবস্থায় কুপার মুক্তি দেন ৩৫ যাত্রী এবং দুজন বিমানকর্মীকে। যাত্রীদের উদ্ধারই ছিল প্রশাসনের এক নম্বর চ্যালেঞ্জ।  যাত্রীরা নেমে যাওয়ার পরই বেঁকে বসেন কুপার। বলেন, ‘বিমানচালক এবং দুজন বিমানকর্মী বিমানেই থাকবে।’

 

কুপারের চিরকুট

‘ম্যাডাম, আমার কাছে বোমা আছে’

তারিখটা সাদামাটা। ১৯৭১ সালের ২৪ নভেম্বর। আমেরিকার নর্থ-ওয়েস্ট ওরিয়েন্ট এয়ালাইনসের ফ্লাইট-৩০৫ বোয়িং-৭২৭ বিমানটি পোর্টল্যান্ড থেকে সিয়াটলের উদ্দেশে রওনা দেবে। একে একে যাত্রী উঠছেন বিমানে। যাত্রী সারিতেই ছিলেন ড্যান কুপার। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। বেশ স্মার্ট দেখতে। চোখে সানগ্লাস, পরনে স্যুট। বিমানে উঠে নিজের সিটে বসলেন। ফ্লাইট টেক অফ করার আগে বিমানবালা এগিয়ে এলেন, ‘স্যার, ড্রিঙ্ক লাগবে?’ হাসিমুখে অর্ডার করলেন তিনি। পকেট থেকে সিগারেট বের করলেন। ঘড়িতে ২টা ১৮ মিনিট। বিমান আকাশে ডানা মেলল। এবার নিজেই বিমানবালাকে ডাকলেন কুপার। কাছে যেতেই একটি চিরকুট এগিয়ে দিলেন। বিমানবালা হাসিমুখে চিরকুটটি খুললেন। মুহূর্তেই তার চোখ আতঙ্কে বিস্ফোরিত হলো যেন। তবু মুখ থেকে একটা শব্দও বের করলেন না। শান্ত হয়ে কুপারের পাশের সিটে বসে পড়লেন সেই বিমানবালা। চিরকুটে লেখা ছিল, ‘ম্যাডাম, আমার কাছে বোমা আছে। আপনি আমার পাশে বসুন।’ পাশে বসতেই কুপার বিমানবালার পোশাকে নেমপ্লেট দেখলেন, নাম ফ্লোরেন্স সফনার। কুপার এবার নিজের কাছে থাকা সুটকেসটি খুলে দেখান। তাতে আটটি ডিনামাইট এবং একটি  ডেটোনেটর রাখা। ভয়ে দাঁতকপাটি লাগার দশা ফ্লোরেন্সের। বিপদকালীন পরিস্থিতির ট্রেনিং ছিল তার। মাথা ঠান্ডা করে পরিস্থিতির ভয়াবহতা বুঝে চুপ করে কুপারের কথা শুনছিলেন তিনি। বোমা দেখে তার বুঝতে বাকি রইল না, বিমান হাইজ্যাক হয়ে গেছে। কুপার শান্ত হয়ে ফ্লোরেন্সকে বললেন, ‘ভয় নেই। আমার তিনটি দাবি আছে। এসব পূরণ করে দিন। এ দুঃস্বপ্ন কেটে যাবে।’ সঙ্গে এও জানান, দাবি পূরণ না হলে বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দেবেন।

তার তিনটি দাবি

১। বিকাল ৫টার মধ্যে তাঁকে নগদ ২ লাখ ডলার দিতে হবে।

২। তাঁর জন্য বিমানে দুটি প্যারাসুট পাঠাতে হবে।

৩। সিয়াটল বিমানবন্দরে একটি জ্বালানি ভর্তি ট্রাকের বন্দোবস্ত করতে দিতে হবে। শেষে এটাও বললেন, কোনো চালাকির চেষ্টা হলে বিমানে বোমার বিস্ফোরণ ঘটাবেন তিনি।

 

উড়ন্ত বিমান থেকেই ঝাঁপ দেন

কুপারের হাতে টাকা ও প্যারাসুট। ককপিটে পৌঁছে পাইলটকে বললেন, ‘বিমান মেক্সিকো সিটিতে নিয়ে যাও।’ কিন্তু জ্বালানির অপ্রতুলতায় মেক্সিকো সিটি যাওয়া সম্ভব ছিল না। কুপার তার প্ল্যান মতোই সব করছিলেন। বিমান কতটা উচ্চতায়, কত গতিবেগে চলবে, সবই ঠিক করে দিচ্ছিলেন কুপার। রিনো অথবা ফিনিক্সে আবারও জ্বালানি ভরার জন্য বিমানচালককে নির্দেশ দেন তিনি। রিনোতে বিমান নামানোর বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়। এ সময় দুটি যুদ্ধবিমানকে ওই বিমানটির পেছনে ধাওয়া করতে পাঠায় আমেরিকা। এক সময় বিমানবালা টিনাকে ককপিটে যাওয়ার নির্দেশ দেন কুপার। রাতের অন্ধকারে বিমানটি নামানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন বিমানচালক। এ সময় ককপিটের দরজা খোলার সময় টিনা দেখেন কুপার নিজের কোমরে কিছু একটা বাঁধছেন।  এর পর দরজা বন্ধ করে ককপিটে ঢুকে যান টিনা। তাদের দাবি, ওই সময় কেউ না থাকার সুযোগ নিয়ে বিমানের সিঁড়ি খুলে উড়ন্ত বিমান থেকেই প্যারাসুট নিয়ে ঝাঁপ দেন কুপার।

 

৪৫ বছর পর কেস ক্লোজড

পড়ে রইল আটটি সিগারেট

বিমানবালা টিনা ডি বি কুপারকে শেষবারের মতো দেখেছিলেন। তার পর আর কেউ তার হদিস পায়নি। ৫২ বছর ধরে তিনি লাপাত্তা। তিন ঘণ্টা পর বিমান রিনো বিমানবন্দরে অবতরণ করে। গোয়েন্দারা বিমানে গিয়ে পেলেন একটি প্যারাসুট, একটি টাই এবং আটটি সিগারেট। বিমানকর্মী এবং যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে কুপারের একটি স্কেচ তৈরি করা হয়। তার ছবির সঙ্গে তাঁকে দেওয়া ডলারের নম্বর গণমাধ্যমে প্রচার করা হয়। তাকে ধরিয়ে দিতে পারলে মিলবে লোভনীয় পুরস্কার। এত কিছু করেও কুপারকে খুঁজে পাননি গোয়েন্দারা। তার খোঁজে নেমেছিল মার্কিন পুলিশ, এফবিআই গোয়েন্দা ও মার্কিন সেনা। যেখানে প্যারাসুট থেকে তিনি নামতে পারেন এমন এলাকায় চিরুনি তল্লাশি করেও খোঁজ পাওয়া যায়নি কুপারের। এমনকি সেনাবাহিনী নামিয়ে প্রতিটি এলাকায় তল্লাশি চালান মার্কিন গোয়েন্দারা। গোয়েন্দারা আরও ভেবেছিলেন কুপারের হাতে তুলে দেওয়া ডলার খরচ করলেই তাকে ধরা যাবে। কিন্তু এখানেও ব্যর্থ হতে হয় তাদের। ১৯৮০ সালে দক্ষিণ ওয়াশিংটনের কলম্বিয়া নদীর ধারে একটি বাচ্চা খেলা করছিল। সেই বাচ্চাটি বালি খুঁড়তে খুঁড়তে তিনটি ডলারের বান্ডিল পায়। ছেলের হাতে এত ডলার দেখে ঘাবড়ে যান তাঁর বাবা-মা। মোট ৫ হাজার ৮০০ ডলার পাওয়া গিয়েছিল ওই এলাকা থেকে। বাচ্চাটির মা-বাবা ওই ডলারের বান্ডিল তুলে দেন এফবিআইর হাতে। তারা তদন্ত করে জানতে পারেন, এই ডলারগুলো ৯ বছর আগে দেওয়া হয়েছিল ডি বি কুপারকে।  এটাই শেষ ক্লু। ১৯৭১ সালের ২৪ নভেম্বরের পর ড্যান কুপারকে আর কেউ দেখেনি। ২০১৬ সালের জুলাই মাসে ৪৫ বছর পর হাল ছাড়ে এফবিআই, বুঝতে পারে আর চেষ্টা করে লাভ নেই।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর