সোমবার, ৫ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা

ভয়াবহ যত ট্রেন দুর্ঘটনা

ইতিহাস ঘাঁটলে মিলবে ভয়াবহ কয়েকটি ট্রেন দুর্ঘটনার তথ্য। কখনো যান্ত্রিক কারণে, কখনো মানুষের ভুলে ট্রেন দুর্ঘটনা নিয়ে আজকের রকমারি-

ভয়াবহ যত ট্রেন দুর্ঘটনা

২০ বছরের মধ্যে বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ভারতে

লন্ডনের ডেইলি মেইল, গত ২০ বছরের মধ্যে ভারতের ওড়িশার ট্রেন দুর্ঘটনাকে সবচেয়ে ভয়াবহ বলে উল্লেখ করেছে। সময় গত শুক্রবার, ২ জুন স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৭টা। ওড়িশার বালাসোর জেলার বাহানাগা বাজার এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে।  ভারতের সংবাদমাধ্যমের খবর, কলকাতা থেকে চেন্নাইগামী করমন্ডল এক্সপ্রেস ট্রেনটি ভুলবশত বালাসোরের বাহানাগা বাজার স্টেশনের লুপ লাইনে (বাড়তি লাইনে) প্রবেশ করে এবং লুপ লাইনের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একটি মালবাহী ট্রেনে আঘাত হানে। এর মাঝেই সংলগ্ন লাইনে চলে আসে বেঙ্গালুরু-হাওড়াগামী সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস নামের যাত্রীবাহী ট্রেনটি। করমন্ডল এক্সপ্রেসের আঘাতে মালবাহী ট্রেনের উল্টে যাওয়া বগি লাইনের মাঝে পড়ে থাকায় সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস ট্রেনটিও দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। করমন্ডল এক্সপ্রেস ট্রেনটি ঘণ্টায় ১২৮ কিলোমিটার গতিতে চলছিল। আর বেঙ্গালুরু-হাওড়া সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস ট্রেনের গতি ছিল ঘণ্টায় ১১৬ কিলোমিটার। দুই ট্রেনে প্রায় দুই হাজার যাত্রী ছিলেন। দুর্ঘটনার কবলে পড়া তৃতীয় মালবাহী ট্রেনটি সেখানে আগে থেকেই স্থির দাঁড়িয়ে ছিল। তদন্তে বের হয়ে এসেছে, ‘ইলেকট্রনিং ইন্টারলকিং সিস্টেম’-এ পরিবর্তনের কারণেই এ দুর্ঘটনাটি ঘটেছে। এই মারাত্মক সংঘর্ষের জেরে তিনটি ট্রেন মিলিয়ে মোট ১৭টি বগি লাইনচ্যুত হয়। দুর্ঘটনায় গতকাল পর্যন্ত প্রায় ৩০০ জন নিহত ও ১২০০ আহতের খবর পাওয়া যায়।

 

সুনামির কবলে ভেসে যায় ট্রেন

২৬ ডিসেম্বর, ২০০৪। ট্রেনের নাম শ্রীলঙ্কার সমুদ্রদেবী। যাত্রীসহ ট্রেনটি কলম্বোর ফোর্ট স্টেশন থেকে দক্ষিণের শহর গালে যাওয়ার উদ্দেশে রওনা দিয়েছিল। ক্রিসমাসের ছুটির সপ্তাহান্তের পাশাপাশি এটি ছিল পূর্ণিমার দিন; যখন বৌদ্ধরা মাসিক প্রার্থনা করেন এবং আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা করেন। তাই ট্রেনে থাকা বেশির ভাগ যাত্রী পরিবার, বন্ধু ও আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিলেন। পেরালিয়া গ্রামের কাছে এসে এক সময় ট্রেনটি সিগন্যালে থেমে যায়। সঙ্গে সঙ্গে ৬০ ফুট উঁচু হয়ে আসা সুনামির ঢেউ ঢুকে পড়ে ট্রেনের ভিতর। তারপর ট্রেনটি রেললাইন থেকে ছুড়ে ফেলে। ঢেউয়ের ধাক্কায় ট্রেনটি ঘুরতে থাকে।  এ দুর্ঘটনার ফলে ১৭০০ জন প্রাণ হারান বলে অনুমান করা হয়েছিল। মাত্র ৭০০-৮০০ জন ছাড়া বাকিদের লাশও খুঁজে পাওয়া যায়নি।

 

হঠাৎ ট্রেনের গতি বাড়িয়ে দেন চালক

১৯১৭ সালের ১২ ডিসেম্বর। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইতালিয়ান ফ্রন্টে লড়াই করা হাজারখানেক সৈন্য ট্রেনে ফ্রান্সে যাচ্ছিলেন। সে দিন দুটি ট্রেনের বগি একটি ইঞ্জিনের সঙ্গেই জুড়ে দেওয়া হয়েছিল। মন্ট ক্যানিস টানেল পাড়ি দিয়ে ট্রেনটি যখন মডেন স্টেশনে পৌঁছে, তখন এর সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয় আরও দুটি বগি। সব মিলিয়ে ট্রেনের বগির সংখ্যা দাঁড়ায় ১৯টি। ট্রেনটির পরবর্তী গন্তব্য চেম্বারি স্টেশন। ১৯ বগির ট্রেনটি প্রায় সাড়ে তিনশ মিটার দীর্ঘ ছিল। রাত সোয়া ১১টায় মডেন স্টেশন ছাড়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেনের গতি হঠাৎ বাড়িয়ে দেন চালক। ঘণ্টায় প্রায় ১৩৫ কিলোমিটার বেগে ছুটতে শুরু করে ট্রেন। একটি লোহার সেতু পেরনোর সময়েই দুর্ঘটনা ঘটে। ট্রেনের কয়েকটি কামরা লাইনচ্যুত হয়ে যায়। ট্রেনে সামরিক সরঞ্জাম ও গোলাবারুদও ছিল। ফলে প্রচন্ড বিস্ফোরণে আগুন ধরে যায়।

 

অটোমেটিক ট্রেন প্রটেকশন ব্যবস্থাটি অকেজো করে রাখা হয়েছিল

তাইওয়ানের সবচেয়ে ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনার একটি ঘটে ২০১৮ সালে। সে বছরের ২১ অক্টোবর ট্রেন দুর্ঘটনায় কমপক্ষে ২২ জন নিহত হন, গুরুতর আহত হন ১৭১। দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ইয়েলান অঞ্চলে ভয়াবহ এ দুর্ঘটনা ঘটে। ট্রেনটিতে মোট ৩৬৬ যাত্রী ছিলেন। ট্রেনটি লাইনচ্যুত হয়ে একটি পর্যটন এলাকায় ঢুকে যায়। দুর্ঘটনায় ট্রেনের ৪টি বগি উল্টে যায়। দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে জানা যায়, ট্রেনের চালক ‘মেইন এয়ার কম্প্রেসার’ নিয়ে অভিযোগ জানিয়েছিলেন। কিন্তু তার কথা সেভাবে আমলে নেওয়া হয়নি। উল্টো ট্রেনের এটিপি (অটোমেটিক ট্রেন প্রটেকশন) ব্যবস্থাটিও অকেজো করে রাখা হয়েছিল।

 

বাংলাদেশেও দুর্ঘটনা

বাংলাদেশের ইতিহাসে ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছিল ১৯৮৯ সালের ১৫ জানুয়ারি। টঙ্গীর কাছে মাজুখানে দুটি ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে ১৭০ যাত্রী নিহত এবং ৪০০ জন আহত হন। গত ৩০ বছরের হিসাবে ছোট-বড় অনেক দুর্ঘটনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-১৯৮৩ সালের ২২ মার্চ ঈশ্বরদীতে ট্রেন দুর্ঘটনা। সেতুর স্প্যান ভেঙে কয়েকটি বগি নিচে শুকনা জায়গায় পড়ে যায়। এ দুর্ঘটনায় ৬০ যাত্রী নিহত হন। ১৯৮৫ সালের ১৩ জানুয়ারি খুলনা থেকে পার্বতীপুরগামী সীমান্ত এক্সপ্রেসের কোচে আগুন ধরে ২৭ জন মারা যান। ১৯৮৬ সালের ১৫ মার্চ কুষ্টিয়ার ভেড়ামারার কাছে ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে নদীতে পড়ে ২৫ যাত্রী নিহত হন। ১৯৯৫ সালে ১৩ জানুয়ারি রাত সোয়া ৯টায় বাংলাদেশের গোয়ালন্দ থেকে পার্বতীপুরগামী ৫১১ নম্বর লোকাল ট্রেনটি হিলি রেলস্টেশনের ১ নম্বর লাইনে এসে দাঁড়ায়। এর কিছুক্ষণ পর সৈয়দপুর থেকে খুলনাগামী ৭৪৮ নম্বর আন্তঃনগর সীমান্ত এক্সপ্রেস ট্রেনটি একই লাইনে ঢুকে পড়ে। দুটি ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। গোয়ালন্দ লোকাল ট্রেনের ইঞ্জিনসহ দুটি বগি দুমড়ে-মুচড়ে আন্তঃনগর ট্রেনের উপর উঠে যায়। এ দুর্ঘটনায় দুটি ট্রেনের শতাধিক যাত্রীর মৃত্যু হয়। আহত হন দুই শতাধিক।

 

দেশে দেশে যত দুর্ঘটনা

 

স্পেনে ট্রেন দুর্ঘটনা : উত্তর-পশ্চিম স্পেনের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল গালিসিয়ায় ২০১৩ সালে ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনায় অন্তত ৭৮ জন নিহত হন। আহত হন ১৪০ জনেরও বেশি।

মেক্সিকোর গুয়াদালাজারা দুর্ঘটনা : ১৯১৫ সালের ২২ জানুয়ারি মেক্সিকোর গুয়াদালাজারা নামক জায়গায় ঘটে এ দুর্ঘটনা। প্রাণ যায় অন্তত ৬০০ মানুষের। ব্রেক ফেল থেকেই ঘটেছিল এ দুর্ঘটনা। অনেকে ট্রেন থেকে ঝাঁপিয়েও পড়েছিল।

রাশিয়ার উফা রেল দুর্ঘটনা : ১৯৮৯ সালে ৪ জুন রাশিয়ার উফা শহরে ঘটে এ দুর্ঘটনা। দুদিক থেকে দুটি ট্রেন একে অপরকে অতিক্রম করে যাচ্ছিল। ট্রেন লাইনের নিচ দিয়ে চলে গিয়েছিল একটি লিকুইফাইড পেট্রোলিয়াম গ্যাস বা লিকুইড পেট্রোলিয়াম গ্যাস পাইপলাইন। হঠাৎ বেড়ে গিয়েছিল সেই লাইনে গ্যাসের চাপ। আর তার ফলে লাইনটি লিক হয়ে গ্যাস বেরিয়ে পড়ে। সেই সময় উপর দিয়ে যাচ্ছিল ট্রেন। ফলে আগুন ধরে যায়। আর সেই আগুন এক ট্রেন থেকে আরেক ট্রেনে ছড়িয়ে পড়ে। এতে প্রচন্ড বিস্ফোরণ হয়েছিল। ঘটনাস্থল ও পরে হাসপাতাল মিলে মারা গিয়েছিলেন প্রায় ৬০০ মানুষ।

মিসরে ট্রেন দুর্ঘটনা : মিসরের রাজধানী কায়রোতে ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনার পর অগ্নিকান্ডে অন্তত ২৫ জন নিহত হন। আগুনে ঝলসে যান যাত্রীরা। উদ্ধার কাজের পরও বেশিরভাগের পরিচয় জানা সম্ভব হয়নি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর