অন্ধ রাজকন্যার কথা তোমরা সবাই জানো। চোখে দেখে না সে। তবে তীক্ষèবুদ্ধি প্রখর। এই রাজকন্যা একবার বাংলাদেশের সুন্দরবনে ঘুরতে এসেছে। তো সে গল্পটা শোনো।
সুন্দরবনে রাজকন্যার সঙ্গে প্রথম দেখা রয়েল বেঙ্গল টাইগারের।
রাজকন্যাকে দেখে বাঘমামা প্রশ্ন করল, ‘সবাই আমাকে ভয় পায় কিন্তু ‘তুমি পাচ্ছো না কেন?’
রাজকন্যা বলল, ‘তোমাকে ভয় পাবো! কিন্তু কেন? তোমাদের সঙ্গে পরিচিত হবো বলেই তো এলাম।’
বাঘ মামা মনে মনে বললো, ‘সবাই আমাদের দেখে ভয় পায় অথচ এই রাজকন্যা একদম পাচ্ছে না। অনেক সাহসী। সাহসীদের সঙ্গে তো বন্ধুত্ব করা যায়।’
‘কী ভাবছো? আমি কি তোমার বন্ধু হতে পারি?’
‘অবশ্যই পারো। কিন্তু তুমি তো অন্ধ রাজকন্যা। কীভাবে এলে?’
‘আমার কাছে একটা জাদুর আয়না আছে। সেই আয়নার অনেক শক্তি। ওই আয়নাটাই আমাকে এখানে আসতে সাহায্য করেছে। আজ পূর্ণিমা। তাই আমি সবকিছু দেখতে পাব। কিন্তু রাত কেটে সকাল হলেই আর কিছু দেখবো না।’
‘বাহ! তাহলে তো ভালো। কিছুক্ষণ পর সন্ধ্যা নামবে। এরপর রাতে পূর্ণিমার আলোয় বন হবে আলোকিত। তুমি আমাদের সবকিছু দেখতে পাবে।’
‘শুনেছি বাংলাদেশের সুন্দরবন উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় বন। এরকম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট কোথাও দেখা যায় না।’
‘একদম ঠিক শুনেছো।’
‘তোমার নামটাই জানা হলো না!
কী নাম তোমার’?
‘আমার নাম রয়েল বেঙ্গল টাইগার। আমি বাংলাদেশের জাতীয় পশু। সবাই আদর করে মামা ডাকে। জানো, আমি অনেক শক্তিমান।’
‘দারুণ! তাহলে তুমি তো ভাগ্যবান বাঘ মামা’।
‘আচ্ছা, তোমার নাম কী?’
‘আমার নাম আমায়া।’
‘খুব সুন্দর নাম।’
‘তোমাদের বনটা অনেক সুন্দর। পাখির ডাক খুব মিষ্টি।’
‘হুম। এখানে অনেক পাখি আছে। বুলবুলি, টুনটুনি, ঈগল, মাছরাঙা। চলো, আমরা সামনে হাঁটি।’
‘ঠিক আছে। আচ্ছা, এই বনের নাম সুন্দরবন কেন?’
‘সুন্দরবনে অনেক জাতের গাছ আছে। সবচেয়ে বেশি আছে সুন্দরী। অনেকে বলে সুন্দরী গাছ থেকে সুন্দরবনের নামকরণ হয়েছে।’
‘জানো, আমরা এখন সুন্দরী গাছের নিচে আছি।’
‘দারুণ!’
‘অন্ধ রাজকন্যা, তুমি অনেক সুন্দর। তোমাকে আমি সুন্দরী বলে ডাকতে পারি?’
‘হুম ডাকতে পারো।’
‘আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি?’
‘তোমাকে আমার বাসায় নিয়ে যাচ্ছি। সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিব।’
‘একটু পর রাত হলো। পূর্ণিমার আলোয় আলোকিত হলো চারপাশ।’
রাজকন্যা খুশি হয়ে বললো, ‘হাই বেঙ্গল টাইগার, তোমাকে দেখতে পাচ্ছি।’
বাঘমামার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করলো রাজকন্যা। বললো, ‘নাইস টু মিট উইথ ইউ’।
এবার বাঘমামা বললো, ‘রাজকন্যা, তুমি তো এখন অনেক খুশি। এ উপলক্ষে গিটারে সুর তুলে আমি একটা গান গাইছি।’
‘ঠিক আছে’।
‘সুন্দরবনে সুন্দরী অন্ধ রাজকন্যা।
দেখ পাখি, দেখ হাতি,
দেখ হরিণ, দেখ সবাই।
আজ সারা রাত ঘুরে বেড়াবো।
করব হৈ হৈ।
ঘুমাবো না। ঘুমাবো না।
কী মজা! কী মজা!
সুন্দরবনে আনন্দের বন্যা।’
বাঘমামার গানের সুরে সুরে সুন্দরী রাজকন্যা চমৎকার নাচল আর বলল, ‘বাহ! দারুণ কণ্ঠ তো তোমার!’
এদিকে গান শুনতে পেয়ে একসঙ্গে বনে হাজির হলো হাতি, হরিণ, বনবিড়াল, বানর, ঈগল ও শিয়াল। রাজকন্যাকে দেখে বিস্মিত হলো সবাই।
বাঘমামা বললো, ‘সুন্দরবনে বিখ্যাত অন্ধ রাজকন্যা এসেছে। সবাই স্বাগত জানাও।’
হাতিসহ সবাই একসঙ্গে বলল, ‘প্রিয় রাজকন্যা, সুন্দরবনে তোমাকে স্বাগত।’
‘তোমাদেরকেও শুভেচ্ছা।’
শিয়াল বলল, ‘আজ পূর্ণিমা। এ ছাড়া আমাদের বনে একজন বিশেষ অতিথি এসেছে। বাঘমামা, আমরা কি বনভোজনের আয়োজন করতে পারি?’
উত্তরে বাঘমামা বলল, ‘অবশ্যই, আমি অনুমতি দিলাম।’
শুরু হলো বনভোজনের আয়োজন। ঘণ্টা দুয়েক পর রাতের খাবার সবাই অনেক মজা করে খেল।
রাজকন্যা বলল, ‘খোলা আকাশের নিচে প্রথম ডিনার করলাম। অসাধারণ অভিজ্ঞতা হলো। সব খাবার সুস্বাদু। বেশি ভালো লেগেছে সুন্দরবনের মধু। সবাইকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।’
এরপর হাতি বলল, ‘আমায়া শোনো, আমাদের সুন্দরবন অনেক সুন্দর। নোনা পরিবেশের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন হিসেবে সুন্দরবন বিশ্বের সবচেয়ে বড় বনভূমি। ১৯৯৭ সালে সুন্দরবন ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। কিন্তু আমাদের একটা গোপন কষ্ট আছে।’
‘কী সেটা?’ রাজকন্যা জিজ্ঞাসা করলো।
‘আমাদের অনেক প্রাণী বিলুপ্ত। অনেক দুষ্টু লোক সুন্দরবনে ঢুকে আমাদের ক্ষতি করার চেষ্টা করে। অনেক গাছও কেটে ফেলছে।’
‘এটা সত্যি কষ্টের কথা। কষ্ট পেও না আমার প্রিয় হাতি। আমরা সবাই মিলে সুন্দরবনকে রক্ষা করব।’
চারপাশে তখন থমথমে পরিবেশ। কিছুক্ষণ পর শিয়াল বললো, ‘চলো, আমরা সেলফি তুলি।’
রাজকন্যা সবার সঙ্গে সেলফি তুললো। বাঘমামার সঙ্গে আলাদা করে নিল একটা বিশেষ সেলফি।
এদিকে বনবিড়াল রাজকন্যাকে সুন্দর একটা উপহার দিয়ে বললো, ‘এটা তোমার জন্য। এখানে একটা গিটার আছে। তোমার যখন মন চাইবে তখন তুমি বাজাবে।’
‘উপহারের জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ বনবিড়াল।’
শিয়াল রাজকন্যার কাছে এসে বলল, ‘প্রিয় অন্ধ রাজকন্যা, আমি তোমার জন্য কোনো উপহার আনিনি। আমি নিজেই তোমার উপহার হতে চাই। আমাকে তোমার সঙ্গে নেবে?’
শিয়ালের কথা শুনে সবাই হাসলো।
রাজকন্যা তখন বললো, ‘শিয়াল পন্ডিত এবং তোমাদের সবাইকে আমার রাজ্যে আমন্ত্রণ। যখন খুশি তোমরা চলে আসবে।’
সবাই একসঙ্গে বললো, ‘ঠিক আছে প্রিয় অন্ধরাজকন্যা’।
কিছুক্ষণ পর রাজকন্যা বললো, ‘একটু পর সকাল হবে। সবার ঘুম ভাঙার আগেই আমাকে রাজ্যে ফিরতে হবে। সবাইকে বিদায় জানাতে চাই। তোমাদের সঙ্গে দেখা করার জন্য আমি আবার বাংলাদেশে আসবো। অবশ্যই।’
এরপর সবার কাছ থেকে ধীরে ধীরে বিদায় নিল রাজকন্যা। এক এক করে সবার সঙ্গে সে হ্যান্ডশেক করল।
বিদায় দেওয়ার মুহূর্তে বাঘমামার অনেক মন খারাপ হলো। বাঘ মামা বললো, ‘প্রিয় সাহসী অন্ধ রাজকন্যা, আবার এসো। তোমার জন্য অপেক্ষা করবো।’
‘আমার নতুন বন্ধু বেঙ্গল টাইগার, তুমি ভালো থেকো। আবার দেখা হবে।’
এরপর অন্ধ রাজকন্যা সুন্দরবন থেকে তাঁর রাজ্যে ফিরে গেল।