রবিবার, ২৮ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

নতুন উদ্যম নতুন যাত্রা

হাসিনা-মোদি শীর্ষ বৈঠকে পাঁচ সমঝোতা স্মারক, ৮ উদ্বোধন, ১০ ঘোষণা

কূটনৈতিক প্রতিবেদক

নতুন উদ্যম নতুন যাত্রা

গতকাল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিসৌধ কমপ্লেক্সে বকুল চারা রোপণ করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানা -পিআইডি

নতুন উদ্যমে নতুন পথযাত্রা শুরু করতে যাচ্ছে প্রতিবেশী বাংলাদেশ ও ভারত। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শীর্ষ বৈঠকের সম্পর্কের ভবিষ্যৎ রূপরেখার ক্ষেত্রে এ ঘোষণাকেই সামনে রাখা হয়েছে। গতকাল দুই দেশের মধ্যে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, বাণিজ্য, তথ্য প্রযুক্তি ও খেলাধুলাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়াতে পাঁচটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ ও ভারত। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অবকাঠামো নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনসহ আটটি উদ্বোধন করেন দুই নেতা। পাশাপাশি ঢাকা-জলপাইগুড়ি মিতালি এক্সপ্রেস চালুসহ ১০টি ঘোষণা দেওয়া হয়েছে হাসিনা-মোদি শীর্ষ বৈঠকে। গতকাল সন্ধ্যায় বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে রাত ৯টায় ঢাকা ছেড়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী।

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে ৫০ বছরপূর্তি উপলক্ষে শুক্রবার বাংলাদেশে আসা নরেন্দ্র

মোদি গতকাল সফরের দ্বিতীয় দিন শনিবার বিকালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে যান। সেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁকে স্বাগত জানান। দুই সরকারপ্রধান প্রথমে কিছু সময় একান্তে বৈঠক করেন। পরে তাঁদের নেতৃত্বে শুরু হয় দুই দেশের প্রতিনিধিদলের দ্বিপক্ষীয় বৈঠক। দুই ঘণ্টার দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর দুই নেতার উপস্থিতিতে পাঁচটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। সমঝোতা স্মারকগুলো হলো- ১. দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, অভিযোজন ও প্রশমনের ক্ষেত্রে সহযোগিতা, ২. বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর (বিএনসিসি) এবং ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর অব ইন্ডিয়ার (আইএনসিসি) মধ্যে সহযোগিতা, ৩. বাণিজ্য বিকাশে অশুল্ক বাধা দূর করতে একটি সহযোগিতা ফ্রেমওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা করা, ৪. বাংলাদেশ-ভারত ডিজিটাল সার্ভিস অ্যান্ড এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড ট্রেনিং (বিজিএসটি) সেন্টারের জন্য তথ্যপ্রযুক্তি সরঞ্জাম, কোর্সওয়্যার ও রেফারেন্স বই সরবরাহ এবং প্রশিক্ষণ সহযোগিতা, ৫. রাজশাহী কলেজ মাঠের উন্নয়নে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন। পরে দুই নেতা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে আটটি প্রকল্পের উদ্বোধন করেন।

এগুলো হলো- মুক্তিযুদ্ধে মিত্রবাহিনীর শহীদদের স্মরণে আশুগঞ্জে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ, বঙ্গবন্ধু বাপু ডিজিটাল প্রদর্শনীর বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়া, কুষ্টিয়ার শিয়ালদহে অবকাঠামো উন্নয়ন, পাবনার ঈশ্বরদীতে রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ‘পাওয়ার ইভাকুয়েশন ফ্যাসিলিটিস’ অবকাঠামো নির্মাণ, তিনটি সীমান্ত হাট উদ্বোধন, বন্ধুত্বের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে স্মারক ডাকটিকিট উšে§াচন, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশকে ১০৯টি অ্যাম্বুলেন্স এবং ১২ লাখ ডোজ ভারতে তৈরি অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা কভিড ভ্যাকসিন উপহার। নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে অ্যাম্বুলেন্সের প্রতীকী চাবি ও ভ্যাকসিনের প্রতীকী বাক্স তুলে দেন। অন্যদিকে শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে রৌপ্য মুদ্রাসহ অন্যান্য স্মারক তুলে দেন নরেন্দ্র মোদির হাতে। 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে ১০টি ঘোষণা আসে। এর মধ্যে আছে ঢাকার সঙ্গে নিউ জলপাইগুড়ির ট্রেন সার্ভিস ‘মিতালী এক্সপ্রেস’, বাংলাদেশের ৫০ তরুণ উদ্যোক্তার ভারতে আমন্ত্রণ, ১ হাজার বাংলাদেশি ছাত্রছাত্রী সুবর্ণজয়ন্তী বৃত্তি, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু চেয়ার স্থাপন, সাতক্ষীরায় সাইক্লোন সেন্টার কাম কমিউনিটি সেন্টার স্থাপন, ওড়াকান্দিতে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন ও গার্লস স্কুলের উন্নয়ন, বাংলাদেশকে ভারতের স্বীকৃতি দেওয়ার দিন ৬ ডিসেম্বরকে মৈত্রী দিবস হিসেবে পালন, দুই দেশের সেরা ব্যবসায়ীদের ‘বেস্ট অব বাংলাদেশ-বেস্ট অব ইন্ডিয়া’ হিসেবে মিলন মেলার আয়োজন, ২০২২ সালে বাংলাদেশের এয়ার শোতে ভারতের অংশগ্রহণ এবং মুক্তিযুদ্ধে ভারতের বিমানবাহিনীর ব্যবহার্য জিনিসপত্র জাদুঘরে রাখতে বাংলাদেশকে উপহার দেওয়া।

বৈঠকের পর ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা বলেছেন, এটি মোদির অত্যন্ত ফলপ্রসূ ও গুরুত্বপূর্ণ সফর। বাংলাদেশের স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিববর্ষ-ঐতিহাসিক সব মাত্রাই ছিল এই সফরে। নরেন্দ্র মোদি ঢাকার বাইরে তিনটি ঐতিহাসিক স্থান সফর করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে বলেছেন, এই প্রথম কোনো বিদেশি সরকারপ্রধান টুঙ্গিপাড়ায় গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে সম্মান জানালেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ ও ভারতের সেরা বিষয়গুলো তুলে ধরার কথা বলেছেন। নরেন্দ্র মোদির সাতক্ষীরা ও গোপালগঞ্জ সফরের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনের ভোটের সমীকরণ আছে কি না জানতে চাইলে শ্রিংলা তা নাকচ করেন। তিনি বলেন, ২০১৫ সালে বাংলাদেশ সফরের সময়ই মোদি ওই স্থান দুটিতে যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। এবার কুষ্টিয়ায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠিবাড়ীতেও যাওয়ার আগ্রহ দেখিয়েছেন। বাংলাদেশ ও ভারত ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিকভাবে জড়িত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ত্রিপুরা সফরে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত সব স্থানে আগ্রহ দেখিয়ে গেছেন। নরেন্দ্র মোদির দুই স্থানে যাওয়াও তেমনি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৈঠকে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তির বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরেছেন। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী তাঁর দেশের আন্তরিক আগ্রহ ও অঙ্গীকারের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে নিয়ে তাঁরা কাজ করবেন।

২০২০ সালের মার্চে মুজিববর্ষের আয়োজনে মোদি উপস্থিত হওয়ার কথা থাকলেও করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে তা পিছিয়ে গিয়েছিল। মহামারী শুরুর পর গত এক বছরের মধ্যে সেই বাংলাদেশেই তিনি প্রথম সফরে এলেন। শুক্রবার বিকালে জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন নরেন্দ্র মোদি। সফরের দ্বিতীয় দিন গতকাল সকালে সাতক্ষীরার শ্যামনগরে যশোরেশ্বরী মন্দির পরিদর্শনে যান তিনি। সেখান থেকে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। পরে গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলায় মতুয়া সম্প্রদায়ের তীর্থস্থান ওড়াকান্দি মন্দির পরিদর্শন করে ঢাকায় ফেরেন মোদি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক শেষে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী।

রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ : উপহার হিসেবে বাংলাদেশকে ভারতের দেওয়া করোনাভাইরাসের টিকার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে রপ্তানির টিকাগুলোও যথাসময়ে আসবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। গত সন্ধ্যায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে গেলে তিনি এ প্রত্যাশার কথা তুলে ধরেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে উদ্ধৃত করে রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব জয়নাল আবেদীন বলেন, প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে ভারত সব সময় বিশ্বস্ত বন্ধু মনে করে। বাংলাদেশের উন্নয়ন-অগ্রগতিতে ভারত সব সময় পাশে থাকবে। করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ায় নরেন্দ্র মোদিকে ধন্যবাদ জানিয়ে রাষ্ট্রপতি বলেন, এই সফর বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ‘যুগান্তকারী মাইলফলক’ হিসেবে থাকবে। সন্ধ্যা ৭টায় মোদি বঙ্গভবনে পৌঁছালে আবদুল হামিদ তাঁকে ফুল দিয়ে অভ্যর্থনা জানান। পরে ক্রেডেনশিয়াল হলে বসে বৈঠক করেন তাঁরা। সাক্ষাৎ শেষে পরিদর্শন বইয়ে স্বাক্ষর করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর