বৃহস্পতিবার, ২৮ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা
১ হাজার বিলিয়ন ডলার সম্পত্তির মালিক হতে যাচ্ছেন ইলন মাস্ক

বিশ্বের সেরা ধনীর যত কথা

আবদুল কাদের

বিশ্বের সেরা ধনীর যত কথা

পৃথিবীর ইতিহাসে এখনো ট্রিলিয়নিয়ার হননি ইলন মাস্ক। তবে সে সময় বেশি দূরে নয়। বিশ্বের প্রথম ট্রিলিয়নিয়ার হওয়ার পথে হাঁটছেন বিশ্বের এ শীর্ষ বিলিয়নিয়ার। চলতি বছরের শুরুতেই শীর্ষ ধনকুবের বিল গেটস, জেফ বেজোসকে পেছনে ফেলে শীর্ষ ধনী হয়েছেন। রকেট নির্মাণ প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্সের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী তিনি। গড়েছেন টেসলা, পেপ্যালসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। তাঁর বিস্ময়কর পরিকল্পনা কতটা বাস্তবসম্মত সেসব নিয়ে তর্ক করেছিলেন প্রযুক্তিবিদরা। কেউ কেউ হেসেছেন যখন তিনি বলেন, একদিন মঙ্গলগ্রহে থাকবে মানুষ।  হাইপার লুক নিয়েও অনেকে ছিলেন সন্দিহান। তবুও একের পর এক সাফল্য ধরা দিয়েছে এ প্রযুক্তি ব্যবসায়ীর হাতে।  এসব বিদ্রƒপ পাত্তা না দিয়ে তিনি হয়ে উঠেছেন বিশ্বের সেরা ধনী।

 

এক হাজার বিলিয়ন ডলারের মালিক!

১৯১৬ সালে বিশ্বের প্রথম বিলিয়নিয়ারের স্বীকৃতি পেয়েছিলেন জন ডি রকফেলার। এরপর পেরিয়ে গেছে শত বছর। বিলিয়নিয়ারের তালিকায় যুক্ত হয়েছেন কয়েক হাজার মানুষ। করোনা সংকটের মধ্যেও হু হু করে বেড়েছে শীর্ষ ধনীদের সম্পদ। যদিও সেটি বিলিয়ন ডলারের ঘরেই সীমাবদ্ধ ছিল। তবে এবার বিশ্বের প্রথম ট্রিলিয়নিয়ার বা লাখো কোটি ডলার সম্পদের মালিক হতে যাচ্ছেন টেসলা এবং স্পেসএক্স কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইলন মাস্ক।

মরগ্যান স্ট্যানলির হিসাব অনুযায়ী, স্পেসএক্সের কল্যাণে বিশ্বের প্রথম ব্যক্তি হিসেবে মাস্কের মালিকানাধীন সম্পত্তির আর্থিক মূল্যমান ১৩ ডিজিটে পৌঁছাবে। প্রথমবারের মতো মহাকাশকেন্দ্রিক পর্যটন ও বেসরকারিভাবে মহাকাশ ভ্রমণের সেবা দিয়ে রেকর্ড গড়েছে স্পেসএক্স।

মরগান স্ট্যানলি বলছে, স্পেস কিংবা টেসলা দুটি কোম্পানিই বিশ্ববাজারে প্রতিষ্ঠিত। তবে বিনিয়োগ ব্যাংকটি বলছে, স্পেসএক্স বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল কোম্পানি। কোম্পানিটি স্টারশিপে বারবার ব্যবহার করা যায়- এমন রকেটগুলো দিয়ে ভবিষ্যতে মানুষকে চাঁদ এবং মঙ্গলে নিয়ে যাবে। ভবিষ্যতে এ কোম্পানির বাজারমূল্য হবে ২০ হাজার কোটি ডলার এবং চলতি মাসেই এ কোম্পানির বাজারমূল্য দাঁড়ায় ১০ হাজার কোটি ডলার। ইন্টারনেট ফার্ম বাইটড্যান্সের পর স্পেসএক্সই বিশ্বের সবচেয়ে উচ্চমূল্যের কোম্পানি।

মরগান স্ট্যানলির বিশ্লেষক অ্যাডাম জোনস বলেন, ‘মাস্কের বর্তমান সম্পদের বেশির ভাগই এসেছে টেসলা থেকে। তবে এবার তিনি মহাকাশ অনুসন্ধান ব্যবসা থেকে অনেক বেশি আয় করতে যাচ্ছেন। অ্যাডাম জোনস বলেন, ইলন মাস্ক প্রথম ট্রিলিয়নিয়ার হতে যাচ্ছেন। তবে টেসলা নয়, স্পেসএক্স  লাখো কোটি ডলারের এ সম্পদ গড়ে দেবে তাঁকে। স্পেসএক্স বিশ্বের যে কোনো শিল্পের মধ্যে সবচেয়ে মূল্যবান সংস্থা হবে, যা সময়ের ব্যাপার।’

ব্লুমবার্গের বিলিয়নিয়ার সূচক অনুযায়ী, বর্তমানে ইলন মাস্কের সম্পত্তির মূল্য ২৪ হাজার ১০০ কোটি ডলার। এ অর্থের প্রায় ১৭ শতাংশ আসে স্পেসএক্স থেকে। জোনাস লেখেন, এক স্পেসএক্স আসলে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সমাহার। এটি মহাকাশে অবকাঠামো নির্মাণ, পৃথিবী প্রদক্ষিণ, মহাবিশ্বের অচেনা অঞ্চলে ভ্রমণসহ অসংখ্য সম্ভাবনা খতিয়ে দেখছে। এর কল্যাণে তালিকায় যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন খাত। জোনাসের মতে, স্যাটেলাইটভিত্তিক যোগাযোগ ব্যবসা স্টারলিংক বর্তমানে স্পেসএক্সের সবচেয়ে বড় প্রকল্প। টেসলা আগের চেয়েও বেশি শক্তিশালী অবস্থানে পৌঁছে যাওয়ায় চলতি বছর মাস্কের ঝুলিতে যোগ হয় ৬ হাজার কোটি ডলারের বেশি সম্পত্তি। আর সম্প্রতি স্পেসএক্সের কিছু শেয়ার বিক্রি করেন তিনি, যার মূল্য ১০ হাজার কোটি ডলার। ব্লুমবার্গের তথ্য অনুযায়ী, মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার সঙ্গে সাম্প্রতিক চুক্তির মাধ্যমে আরও ১ হাজার ১০০ কোটি ডলার যুক্ত হয়েছে স্পেসএক্সের ঝুলিতে। বিশ্বের শীর্ষ ধনী হয়েও অগ্রযাত্রায় থেমে যাননি ইলন মাস্ক।  চলতি সপ্তাহেই নতুন রেকর্ড গড়েন বিশ্বের শীর্ষ এ ধনকুবের। বিশ্বের শীর্ষ ১০ ধনকুবেরের তালিকায় থাকা উল্লেখযোগ্য দুই ব্যক্তি বিল গেটস ও ওয়ারেন বাফেটের সম্পত্তির সমপরিমাণ ঝুলিতে পুরেছেন মাস্ক একাই।

 

কে এই ইলন মাস্ক

প্রযুক্তি ও ব্যবসার খোঁজখবর রাখেন; অথচ ইলন মাস্কের কথা জানেন না- এমন মানুষ বোধহয় কম। ইলন মাস্ক দক্ষিণ আফ্রিকার বংশোদ্ভূত আমেরিকান উদ্যোক্তা ও প্রযুক্তি ব্যবসায়ী; যিনি ১৯৯৯ সালে এক্স ডট কম (যা পরবর্তীতে পেপ্যাল নামে পরিচিতি পায়), ২০০২ সালে স্পেসএক্স এবং ২০০৩ সালে টেসলা মোটরস প্রতিষ্ঠা করেন। বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে ইলন মাস্ক তাঁর জীবনের প্রথম প্রতিষ্ঠান জিপ টু (এমন একটি সফটওয়্যার যা খবরের কাগজের জন্য ইন্টারনেট গাইড হিসেবে ব্যবহার করা হতো) বিক্রি করে ধনকুবের বনে যান। ২০১২ সালের মে মাসে তিনি খবরের কাগজের শিরোনামে ওঠে আসেন যখন তাঁর কোম্পানি স্পেসএক্স প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্রে অর্থের বিনিময়ে ভ্রমণে ইচ্ছুক যাত্রী প্রেরণ করে। ২০১৬ সালে সোলার সিটি কেনার মধ্য দিয়ে তিনি তাঁর অর্জনের পাল্লা আরও ভারী করেন। ট্রাম্প প্রশাসনের শুরুর দিনগুলোতে উপদেষ্টা হওয়ার প্রস্তাব গ্রহণ করে শিল্প ও বাণিজ্যের জগতে একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা হিসেবে নিজের অবস্থান পাকা করেন।

 

ইলন মাস্ক এত বিখ্যাত কেন?

ইলন মাস্ক, কঠোর পরিশ্রমী। বিশ্বের দ্বিতীয় ধনাঢ্য ব্যক্তি, যিনি বৈদ্যুতিক গাড়ি কোম্পানি টেসলা এবং স্পেসএক্সের মতো বিশাল কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী। সম্পদের হিসাবে ‘মাইক্রোসফট’ সংস্থার কর্ণধার বিল গেটসকে টপকে বিশ্বের ধনী ব্যক্তিদের তালিকায় দুই নম্বরে জায়গা করে নিয়েছেন তিনি। তাঁর প্রতিষ্ঠিত মার্কিন মহাকাশযান প্রস্তুতকারক এবং মহাকাশ যাত্রা সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান, যা প্রাইভেট স্পেস সেক্টরকে নিয়ে গেছে অনন্য মাত্রায়। ইলন মাস্কের স্পেসএক্স মানুষকে দেখিয়েছে ভিনগ্রহে ভ্রমণ ও বসবাস করার স্বপ্ন। স্পেসএক্স বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল কোম্পানি। কোম্পানিটি স্টারশিপের বারবার ব্যবহার করা যায় এমন রকেটগুলো দিয়ে ভবিষ্যতে মানুষের চাঁদ এবং মঙ্গলে নিয়ে যাবে। ইলন মাস্ক স্পেসএক্সের প্রায় ৪৮ শতাংশের মালিক। গত জানুয়ারিতে বিশ্বের শীর্ষ খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান অ্যামাজনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোসকে পেছনে ফেলে তিনি বিশ্বের শীর্ষ ধনীর মুকুট জিতেছিলেন। পাশাপাশি ইলন মাস্কের টেসলা মোটরসও ইলেকট্রিক গাড়ির জগতে এনেছে অভূতপূর্ব সাফল্য। মাত্র এক যুগে টেসলা বিশ্বের গাড়ির বাজারে এনেছে আমূল পরিবর্তন। তাদের তৈরি বিদ্যুৎচালিত গাড়ির চাহিদা ও বাজারে উল্লেখযোগ্য মাত্রার পরিবর্তন এসেছে এ দশকে। উষ্ণায়নের এ যুগে পরিবেশবান্ধব বৈদ্যুতিক গাড়ি তৈরি করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন তিনি। এ ছাড়া নিজের দুজন কাজিনকে সঙ্গে নিয়ে সোলার সিটি নামে একটি সোলার অ্যানার্জি কোম্পানিও প্রতিষ্ঠা করেছেন ইলন মাস্ক। জনপ্রিয় মানি টান্সফারিং সার্ভিস পেপ্যালের সহপ্রতিষ্ঠাতাও ছিলেন তিনি। পৃথিবীর সবচেয়ে দ্রুততর ট্রান্সপোর্টেশন ব্যবস্থা, হাইপারলুপের ওপর কাজ করছেন বিশ্বের এ দ্বিতীয় শীর্ষ ধনী। এ ছাড়াও মানুষের ব্রেইনকে কীভাবে একটি কম্পিউটারে সংরক্ষণ করা যায়, তা নিয়েও কাজ করে চলেছেন এ প্রযুক্তি ব্যবসায়ী।

 

 

ইলন মাস্কের আয়ের উৎস

বিশ্বের ধনকুবেরদের তালিকায় উত্থান অব্যাহত ইলন মাস্কের। এ মুহুর্তে তিনি বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ ধনী। ইলন মাস্কের মোট সম্পত্তির পরিমাণ ২১৯.৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এটি জেফ বেজোসের সম্পত্তির তুলনায় ২১.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বেশি। উল্লেখ্য, ইলন মাস্কের স্পেসএক্সের অন্যতম প্রতিযোগী হলো জেফ বেজোসের মহাকাশযান প্রতিষ্ঠান ব্লু অরিজিন। মাত্র দেড় বছরে তাঁর সম্পত্তির পরিমাণ ১৮১ বিলিয়ন বৃদ্ধি পেয়েছে। এত দ্রুত সম্পত্তি বৃদ্ধি বিশ্বের ইতিহাসে নজিরবিহীন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। ইলন মাস্কের দ্রুত সম্পদ বৃদ্ধির নেপথ্যে মূল ভূমিকা পালন করছে তাঁর প্রতিষ্ঠিত বৈদ্যুতিক গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান টেসলা এবং মহাকাশযান সংস্থা স্পেসএক্স। চলতি বছরের তৃতীয় প্রান্তিক জুলাই-সেপ্টেম্বরে কোম্পানিটি গাড়ি বিক্রির মাধ্যমে মোট আয়

করেছে ১৩ হাজার ৭৬০ কোটি মার্কিন ডলার। এ আয় গত বছরের একই সময়ের ৮ হাজার ৭৭০ কোটি ডলারের তুলনায় ৪ হাজার ৯৯০ কোটি ডলার বেশি। গত তিন মাসে টেসলার ১৬০ কোটি ডলারের নিট মুনাফা অর্জনের রেকর্ড করেছে। এ তিন মাসে কোম্পানিটির মোট বৈদ্যুতিক গাড়ি বিক্রি হয়েছে ২ লাখ ৪১ হাজার ৩৯১টি। রয়টার্সের এক খবরে বলা হয়েছে, টেসলা এখন বিশ্ববাজারে তাদের গাড়ির জন্য বিভিন্ন ধরনের নতুন ব্যাটারি বাজারজাতকরণের পরিকল্পনা করছে। ফলে ইলন মাস্কের প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি থেকে তাঁর আয় বাড়ছে উল্কাগতিতে। এ ছাড়া মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা স্পেসএক্সের তৈরি রকেট ব্যবহারে ব্যাপক আগ্রহী হয়ে উঠেছে। স্পেসএক্সের তৈরি রকেটে জ্বালানি খরচ কম আর দ্রুতগতির হওয়ায় নাসা ইলন মাস্কের রকেট নিয়ে মহাবিশ্বে তাদের গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। টেলসার মাধ্যমে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি হয়েছেন ইলন মাস্ক। তবে এবার তাঁকে ট্রিলিয়নিয়ার বানাবে স্পেসএক্স। এমন তথ্য দিয়েছে মার্কিন গবেষণা সংস্থাটি।

 

 

বৈচিত্র্যময় ব্যক্তিজীবন

জন্ম এবং ছেলেবেলা

ইলন মাস্কের জন্ম ১৯৭১ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রিটোরিয়ায়। বাবা ছিলেন বড় মাপের ইঞ্জিনিয়ার। মা ছিলেন জনপ্রিয় কানাডিয়ান মডেল। তাঁদের স্থাবর সম্পত্তির উন্নয়ন ও কেনাবেচার ব্যবসাও করতেন মাস্কের বাবা। মাত্র ১০ বছর বয়সে তাঁর মা-বাবার বিচ্ছেদ হয়ে যায়। সে নিয়ে এতটুকু মাথাব্যথা ছিল না তাঁর। বরং তখন তাঁর মধ্যে কম্পিউটার নিয়ে অনেক বেশি কৌত‚হল ছিল। ওই ১০ বছরেই শিখে ফেলেছিলেন প্রোগ্রামিং।

পড়াশোনায়ও পারদর্শী

ইলন মাস্কের আজ যে খ্যাতি, যে প্রতিপত্তি, তার ভিত গড়ে উঠেছিল তাঁর শৈশবেই। দক্ষিণ আফ্রিকায় উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে ১৯৮৯ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য ইলন মাস্ক কানাডায় চলে যান। ওই বছরই তিনি কানাডার নাগরিকত্ব পান। সেখানে ওন্টারিওর কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এরপর ক্যালিফোর্নিয়ার স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন পদার্থবিদ্যায় পিএইচডি করার জন্য। কিন্তু সেই পড়াশোনা মাঝপথেই থামিয়ে দেন। মাত্র দুই দিন বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলেন ইলন মাস্ক। তারপর নিজের প্রথম সফটওয়্যার কোম্পানি খোলেন।

 

দাম্পত্য জীবন

দুই স্ত্রী এবং এক প্রেমিকা থেকে মোট সাত সন্তানের বাবা হয়েছেন মাস্ক। দ্বিতীয় স্ত্রীকে বিয়ে করেছেন দুবার। কানাডিয়ান লেখিকা জাস্টিন উইলসনকে বিয়ে করেন ২০০০ সালে। এটাই ছিল মাস্কের দীর্ঘ আট বছরের বিবাহিত জীবন। তবে তা ২০০৮ সালে বিচ্ছেদের মাধ্যমে সমাপ্তি ঘটে। তাদের প্রথম সন্তান ১০ সপ্তাহ বয়সে মারা যায়। তবে সে ঘরে এখনো পাঁচ সন্তান রয়েছে। ২০১০ সালে বিয়ে করেন অভিনেত্রী তালুলাহ রেইলিকে। কিন্তু দুই বছর পর ভেঙে যায় সেই সংসার। যদিও ২০১৩ সালে আবার বিয়ে করেন রেইলিকে। ২০১৬ সালে আবার বিচ্ছেদ ঘটে দুজনের। ২০১৫ সালে অভিনেতা জনি ডেপের সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদের পর ২০১৭ সালে অ্যাম্বার হার্ডের জীবনে আসেন মাস্ক। তবে সে সম্পর্কেও ভাঙন ধরে। এরপর ২০১৮ সালে মাস্ক নতুন সম্পর্কে জড়ান সংগীতশিল্পী গ্রিমসের সঙ্গে। বিয়ে না করলেও তাদের ঘরে একটি ছেলে আছে। সেই ছেলের নাম রেখেছেন ঢ অঊ অ-১২ মাস্ক। নেট দুনিয়ায় অদ্ভুত এ নাম নিয়ে চলছে রসিকতা। কেউ বলছেন, ‘এ তো নাম নয়, যেন পাসওয়ার্ড!’ ‘নাকি ‘কোড নেম’? 

 

মিতব্যয়ী ও পরিশ্রমী

পৃথিবীর পরিশ্রমী ব্যক্তিদের তালিকায় অনায়াসেই জায়গা করে নেবেন ইলন মাস্ক। বাড়তি খরচ একদমই পছন্দ নয় তার। উচ্চ পরিবারের সন্তান হওয়া সত্ত্বেও হিসাব-নিকাশ করে চলতেন। কলেজের ফি এবং নিজের হাতখরচ মেটাতে নিজের রুম ও বন্ধুর রুমকে নাইট ক্লাব হিসেবে ভাড়া দিতেন। জীবনের প্রথম ব্যবসা শুরুর দিকে পুঁজি ছিল কম। ব্যবসা শুরু করার পর অফিসে ঘুমাতেন। ‘জিপ-২’ খোলার দিনগুলোয় করেছেন কঠোর পরিশ্রম। দিনের বেলায় ওয়েবসাইট চালু থাকত ও রাতে তিনি করতেন কোডিংয়ের কাজ।

 

যাত্রা শুরুর গল্প

১৯৯৫ সাল, ইন্টারনেট তখন নতুন। নীরবে বিপ্লব ঘটিয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর বুকে। খবরের কাগজের জন্য ইন্টারনেট সে সময় গাইড হিসেবে কাজ করবে, এমন সফটওয়্যার আবিষ্কার করলেন তরুণ উদ্ভাবক ইলন মাস্ক। যার নাম দেওয়া হলো জিপ-২। তাঁর ভাইকে নিয়ে সফটওয়্যার কোম্পানিটি দাঁড় করান মাস্ক। মাস্ক তখন কোম্পানির ৭ শতাংশ শেয়ারের মালিক। প্রথম কাজেই সফলতা পেলেন। তাঁর সফটওয়্যারটি নজরে পড়ল বিখ্যাত টেক কোম্পানি কমপ্যাকের। ১৯৯৯ সালে কোম্পানিটি বিক্রি করে তাঁর পকেটে ঢুকল প্রায় ২২ মিলিয়ন ডলার।

 

টেসলা দিয়ে শীর্ষস্থান

বিশ্বের জ্বালানি সংকট মোকাবিলায় ইলেকট্রনিক কারের মাঝেই ভবিষ্যৎ খুঁজে পেয়েছিলেন ব্যবসায়ী মাস্ক। তাই ২০০৪ সালে মার্টিন ইবারার্ট এবং মার্ক টারপেনিং-এর সঙ্গে চালু করেন টেসলা মোটরস। বছর দুয়েকের মাথায় প্রথম বৈদ্যুতিক গাড়ি নিয়ে আসে মাস্কের টেসলা মোটরস। পরে ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে পরিবেশবান্ধব গাড়ির জনপ্রিয়তা। ২০০৮ সালে টেসলার স্পোর্টস কার রোডস্টার বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতগামী গাড়ির খেতাব অর্জন করে। মাস্কের বিশ্বাস, বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতগামী গাড়ির খেতাব অর্জন করবে তার টেসলা মোটরস।

 

এরপর পেপ্যাল

মানি ট্রান্সফার কোম্পানির মাধ্যমে মুহুর্তের মধ্যে টাকা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পাঠানোর আইডিয়াটা সর্বপ্রথম এনেছিলেন ইলন মাস্ক। যার বাস্তবায়ন করেছিলেন একই বছর (১৯৯৯ সাল) মানি ট্রান্সফার কোম্পানি এক্স ডটকম চালু করার মাধ্যমে; যা পরবর্তীকালে রূপ নেয় অনলাইন মানি ট্রানজেকশনের মাধ্যম পেপ্যালে। ২০০২ সালে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইবে পেপ্যালকে ১.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে কিনে নেয়। পেপ্যালের ১১ শতাংশ শেয়ারের মালিক ছিলেন মাস্ক, তাঁর অ্যাকাউন্টে জমা হয়েছিল ১৬৫ মিলিয়ন ডলার!

 

দ্য বোরিং কোম্পানি

২০১২ সালে দৈনন্দিন হাইপার-লুপ প্রযুক্তির ব্যবহারে আগ্রহ দেখান ইলন মাস্ক। হাইপারলুপ-এর জন্য সুড়ঙ্গ খুঁড়তে তিনি ‘দ্য বোরিং কোম্পানি’ প্রতিষ্ঠা করেন। রাস্তায় গাড়ির জ্যামে বিরক্ত হয়ে এমন পরিকল্পনা করেছিলেন মাস্ক। তাঁর স্বপ্ন হচ্ছে কয়েকটি সুড়ঙ্গ তৈরি করা যেগুলো দিয়ে মানুষ ও গাড়ি যানজট ছাড়াই পার হয়ে যাবে। সুড়ঙ্গের ভিতর দিয়ে গাড়ি চলবে এমনটা নয়। বরং এটি একটি পডের ওপর থাকবে, ওই পড চলবে নেটওয়ার্কে। সম্প্রতি ঘণ্টায় ১ হাজার কি.মি. গতিতে চলা হাইপার-লুপের সফল পরীক্ষা হয়।

 

সীমানা পেরিয়ে মহাকাশ

রকেটের মাধ্যমে মহাকাশে পণ্য সরবরাহের চিন্তাটা ইলন মাস্কের মাথায় ছিল আগেই। রাশিয়ায় রকেট কিনতে গিয়ে ভাবলেন কম খরচে রকেট বানাবেন। ২০০২ সালে গঠন করলেন স্পেসএক্স। স্পেসএক্স থেকে ফ্যালকন-১ নামের রকেটটি উৎক্ষেপণ করতে গিয়ে বারবার ব্যর্থ হয়েছিলেন কিন্তু হাল ছাড়েননি। সম্প্রতি ফ্যালকন-১ এর সফল উৎক্ষেপণ হয়। ইলন মাস্ক নাম লেখালেন ইতিহাসে। মাত্র ৬০ জন কর্মী নিয়ে যাত্রা শুরু করা স্পেসএক্স কোম্পানিতে বর্তমানে প্রায় ৭ হাজারের বেশি কর্মী কাজ করছেন।

 

হাইপার-লুপ

২০১৩ সালে মাস্ক যাতায়াতের এক নতুন পদ্ধতির ঘোষণা দেন। যার নাম দেওয়া হয় হাইপার-লুপ। এর মাধ্যমে বড় শহরগুলোতে খুব সহজেই যাতায়াত সম্ভব হবে। প্রযুক্তিটি বাস্তবায়িত হলে তা হবে দ্রুতগতির (ঘণ্টায় ৬০০ মাইল)। এটি টিউব কেন্দ্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থা। টিউবটি একটি দেশের বিভিন্ন শহরে কিংবা কয়েকটি ভিন্ন দেশে যুক্ত থাকবে। যার ভিতরে থাকবে ক্যাপসুল আকৃতির যানবাহন। উদাহরণ হিসেবে মাস্ক বলেন, প্রযুক্তিটির মাধ্যমে নিউইয়র্ক থেকে লস অ্যাঞ্জেলেস যেতে সময় লাগবে মাত্র ৪৫ মিনিট।

 

 

দক্ষিণ আফ্রিকার ছেলে

১৯৭১ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেটোরিয়াতে ইলন মাস্কের জন্ম। বাবা দক্ষিণ আফ্রিকান ও কানাডিয়ান মায়ের সন্তান ইলনের পুরো নাম ‘ইলন রিভ মাস্ক’।

শেষ করেননি শিক্ষাজীবন

স্নাতকোত্তর শেষে পিএইচডির জন্য যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পান। কিন্তু অর্থ উপার্জনের নেশায় পিএচইডি অধরা থেকে যায়। বর্তমানে উদ্যোক্তা হিসেবে বিশ্বের তরুণদের আইকন তিনি।

 

প্রতিভাবান

মাত্র ১০ বছর বয়সেই কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ে পারদর্শিতা লাভ করেন। ১২ বছর বয়সে বেসিক প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ ব্যবহার করে ব্লাস্টার নামের একটি ভিডিও গেম তৈরি করেন, যা পরবর্তীতে ৫০০ ডলারে পিসি অ্যান্ড অফিস টেকনোলজি ম্যাগাজিনের কাছে বিক্রি করেছিলেন। 

 

বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট

বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট মহাকাশে পাঠায় ইলন মাস্কের কোম্পানি স্পেসএক্স। বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটটি স্পেসএক্স-এর সবচেয়ে আধুনিক ফ্যালকন রকেটের মাধ্যমে ২০১৮ সালের মে মাসে মহাকাশে পাঠানো হয়।

 

বেতন

টেসলার সিইও হিসেবে বছরে বেতন নেন মাত্র এক ডলার। নিজের অংশীদারিত্ব থাকা বিভিন্ন কোম্পানি থেকে প্রাপ্ত লভ্যাংশসহ আরও কিছু সুবিধা পান মাস্ক। বছরে ১ ডলার বেতন সিলিকন ভ্যালির ট্রেন্ড।

 

বিতর্কিত চরিত্র

বিতর্কের জন্ম দিতে ভালোবাসেন মাস্ক। টুইটারে নানা বিতর্কিত টুইটও করেন। শুধু তাই নয়, নিজ প্রতিষ্ঠানের সহযোগীদের সঙ্গেও নানা সময় দ্ব›েদ্ব জড়িয়ে পড়েন। ২০০৮ সালে কমেডিয়ান জো রোগানের সঙ্গে অংশ নেওয়া এক পডকাস্টে সরাসরি সম্প্রচারের সময় গাঁজা সেবন করে দারুণ বিতর্কের জন্ম দিয়েছিলেন।

 

সমালোচনা

জীবনে সফল হয়েছেন অথচ সমালোচনার শিকার হননি, এ রকম উদাহরণ খুঁজে বের করা আসলেই দুষ্কর। যেমনটি ঘটেছে ইলন মাস্কের ক্ষেত্রেও। স্কুলজীবন থেকেই তিনি অন্য শিক্ষার্থীদের চোখে ছিলেন তুচ্ছ। আবার বড় হয়ে সমালোচিত হয়েছেন নিজের চিন্তাধারার জন্যও। এমনকি মাস্কের মঙ্গলগ্রহকে নিয়ে এত সুদূরপ্রসারী ভাবনাকে অনেকে অহেতুক বলেছেন। যদিও বর্তমানে মঙ্গলের স্বপ্ন কেবলই সময়ের ব্যাপার।

 

পাত্তা দেননি কভিড-১৯

করোনাভাইরাসকে একেবারেই পাত্তা দেননি এ প্রযুক্তি উদ্যোক্তা। ২০২০ সালের এপ্রিলে কভিড-১৯ নিয়ে আতঙ্কিত হওয়া বোকামি বলে সমালোচিত হন মাস্ক। যদিও পরে তিনি কভিড-১৯ এ আক্রান্ত হন। লকডাউনে ফ্যাক্টরি বন্ধ রাখার ঘোষণা উপেক্ষা করে নিজের কার্যক্রম চালিয়ে গেছেন।

 

 

মিশন মার্স স্বপ্ন ছোঁয়া প্রজেক্ট

মঙ্গলগ্রহে বসতি হবে মানুষের। এমন স্বপ্ন দেখেন ইলন মাস্ক। যার ফলশ্রুতিতে তাঁর প্রতিষ্ঠিত মহাকাশযান সংস্থা স্পেসএক্স তৈরি করে ‘ফ্যালকন হেভি’ নামের এক মহাকাশযান; যা শুধু মিশন মার্সের জন্য তৈরি।

বিজনেস ইনসাইডার এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ২০২৪ সালের মধ্যে মানুষ মঙ্গলগ্রহে যাবে। ইলন মাস্ক বলেন, মঙ্গলযাত্রার জন্য একটি কার্গো ফ্লাইট প্রস্তুত রয়েছে; যা মানুষের জন্য উপযুক্ত। মাস্ক আরও বলেন, প্রতি ২৬ মাসে একবার পৃথিবী ও মঙ্গল গ্রহের মিলনস্থল তৈরি হয় অর্থাৎ ২০১৮ সালে একবার এবং ২০২০ সালে একবার এমন সময় তৈরি হবে। আর আমি মনে করি, পরিকল্পনা অনুযায়ী সব কিছু যদি ঠিকঠাক মতো হয় তবে ২০২৪ সালে আমরা মানুষ পাঠিয়ে ২০২৫ সালে পৌঁছে দিতে পারি।

উল্লেখ্য, ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে স্পেসএক্সের তৈরি রকেট ‘ফ্যালকন হেভি’-এর সফল উৎক্ষেপণ হয়। এর আগে স্পেসএক্স থেকে ‘ফ্যালকন ১’ রকেটটি উৎক্ষেপণ করতে গিয়ে ব্যর্থ হন ইলন মাস্ক, তবে বারবার ব্যর্থ হয়েও তিনি একবারের জন্যও হাল ছাড়েননি।

 

জানা অজানা...

ইলন মাস্কের বিশ্বাস, স্কুল কখনো মানুষকে জ্ঞানী করতে পারে না। এর জন্য প্রয়োজন সাধনা।

প্রযুক্তি বিশ্বের বিস্ময় ইলন মাস্কের অনুপ্রেরণীয় চরিত্র আয়রনম্যান মুভির টনি স্টার্ক। আয়রনম্যান টু মুভির কিছু অংশ স্পেসএক্সের ভিতরে দৃশ্যায়িত হয়।

আয়রনম্যান খ্যাত মাস্কের সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তিত্বের একজন হলেন মহৎ বিজ্ঞানী নিকোলা টেসলা।

যখন মাস্ক কলেজে ছিলেন, প্রতিদিন এক ডলার বেতনে হট ডগ ও কমলা খেয়ে জীবনধারণ করতেন।

মাস্কের বাবা-মায়ের ধারণা ছিল, ছেলে বুঝি বধির! কারণ, দূর থেকে ডাকলে তিনি সাড়া দিতেন না।

স্কুলে খুব বাজেভাবে সহপাঠীদের হয়রানির শিকার হতে হতো মাস্ককে। একবার তাকে একদল সহপাঠী সিঁড়ির ওপর থেকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল।

সহপাঠীদের দ্বারা হয়রানির পর ১৫ বছর বয়সে মাস্ক মার্শাল আর্ট (কারাতে, জুডো ও কুস্তি) শেখেন।

ছেলেবেলায় মাস্ক অন্ধকারকে প্রচন্ড ভয় পেতেন। কিন্তু বই পড়ে আবিষ্কার করেন, অন্ধকার হচ্ছে কেবল ফোটনের অনুপস্থিতি মাত্র।

ইলন মাস্ক বিশ্বাস করেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা হলো- মানবসভ্যতার সবচেয়ে বড় শত্র“।

মাস্ক মহাকাশযাত্রার ব্যয়কে ৯০% কমিয়ে আনেন। যা ছিল ১ বিলিয়ন ডলার, এখন খরচ ৬০ মিলিয়ন ডলার।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর