সোমবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

ইতিহাসের পাতায় আল-আকসা

আ ব দু ল কা দে র

ইতিহাসের পাতায় আল-আকসা

মুসলমানদের প্রথম কিবলা

আল-আকসা, মুসলমানদের তৃতীয় পবিত্রতম মসজিদ। এটি পৃথিবীর বরকতময় ও স্মৃতিবিজড়িত প্রাচীনতম মসজিদগুলোর একটি। মহান আল্লাহতায়ালা পৃথিবীতে যে তিনটি মসজিদে সালাত আদায় এবং প্রহরায় অঢেল সওয়াবের ঘোষণা দিয়েছেন, মসজিদুল আকসা তার মধ্যে অন্যতম। ঐহিতাসিক মসজিদটি আল-আকসা, মসজিদুল আকসা, বায়তুল মাকদিস কিংবা বায়তুল মুকাদ্দাস নামেও পরিচিত। বায়তুল মাকদিস মুসলমানদের প্রথম কিবলা। ইসলাম ধর্মের প্রচারক এবং নবী হজরত ইবরাহিম (আ.) পবিত্র কাবাঘর নির্মাণের ৪০ বছর পর, একই বংশের ঐশ্বর্য বনি ইসরাইলের প্রথম নবী হযরত ইয়াকুব (আ.) পবিত্র শহর জেরুজালেমে মসজিদুল আকসা নির্মাণ করেন। পরবর্তীকালে নবী দাউদ (আ.)-এর পুত্র সোলায়মান (আ.) পবিত্র মসজিদটি পুনর্নির্মাণ করেন। পবিত্র ধর্ম ইসলামের প্রাথমিক অবস্থায় মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) তাঁর সাহাবিদের নিয়ে বায়তুল মাকদিসের দিকে মুখ করেই সালাত আদায় করতেন। ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে মসজিদটি মুসলমানদের অধীনে আসে। ইসলামী সাম্রাজ্যের অধিপতি চার খলিফার অন্যতম খলিফা হজরত উমর (রা.) বর্তমান মসজিদের স্থানে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। পরবর্তীতে উমাইয়া খলিফা আবদুল মালিকের যুগে মসজিদটি পুনর্নির্র্মিত ও সম্প্রসারিত হয়। এই সংস্কার ৭০৫ খ্রিস্টাব্দে তাঁর পুত্র খলিফা প্রথম আল ওয়ালিদের শাসনামলে শেষ হয়। ৭৪৬ খ্রিস্টাব্দে ভূমিকম্পে মসজিদটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে আব্বাসীয় খলিফা আল মনসুর এর পুনর্নির্মাণ করেন। পরবর্তীতে তাঁর উত্তরসূরি আল মাহদি এর সংস্কার করেন। ১০৩৩ খ্রিস্টাব্দে আরেকটি ভূমিকম্পে মসজিদটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে ফাতেমীয় খলিফা আলী আজ-জাহির মসজিদটি পুনর্নির্মাণ করেন। আর সেই স্থাপনাটিই আজ অবধি টিকে আছে। পরবর্তীকালে বিভিন্ন শাসক মসজিদের সৌন্দর্য বর্ধনে কাজ করেছিলেন। ১০৯৯ খ্রিস্টাব্দে ক্রুসেডাররা জেরুজালেম দখল করার পর মসজিদটিকে প্রাসাদ এবং একই প্রাঙ্গণে অবস্থিত কুব্বাত আস সাখরাকে গির্জা হিসেবে ব্যবহার করত। সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবি জেরুজালেম জয় করার পর মসজিদটি আবার মুসলমানদের অধীনে আসে। এরপর এক শতাব্দী মসজিদুল আকসা মুসলমানদের অধীনে ছিল।


এখন ইহুদিবাদী ইসরায়েলের দখলে

ফিলিস্তিন, জেরুজালেম ও আল-আকসা একচ্ছত্রভাবেই ছিল মুসলমানদের দখলে। ১০৯৯ সালে খ্রিস্টান ক্রুসেডাররা মসজিদটি দখল করে তার ভিতরে পরিবর্তন করে। গির্জায় পরিণত করে এর একটি অংশকে। খ্রিস্টানদের দখলে ৮৮ বছর থাকার পর ১১৮৭ সালে গাজী সালাহউদ্দিন আইয়ুবি খ্রিস্টানদের হাত থেকে আল- আকসা উদ্ধার করে তাতে মুসলমানদের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু বিভিন্ন কৌশলে ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশের মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী ভৌগোলিক দিক থেকে অত্যন্ত কৌশলগত এ পবিত্র স্থান দখলের ষড়যন্ত্র অব্যাহত রাখে ইহুদি-খ্রিস্টানরা। যার ফলশ্রুতিতে ১৯৪৮ সালের ১৫ মে বেলফোর ঘোষণার মাধ্যমে ফিলিস্তিনে ইহুদিবাদী ইসরায়েলিরা অবৈধ ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। এ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা লাভের পর বায়তুল মুকাদ্দাস মুসলমানদের হাতছাড়া হয়ে যায়। সেই থেকে বায়তুল মুকাদ্দাস তাদের দখলে রয়েছে। ১৯৬৯ সালে তারা একবার আল-আকসা মসজিদে অগ্নিসংযোগও করেছিল। বর্তমানে এ মসজিদে প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত। ইসরায়েলের মুসলিম বাসিন্দা এবং পূর্ব জেরুজালেমে বসবাসরত ফিলিস্তিনিরা মসজিদুল আকসায় প্রবেশ ও নামাজ আদায় করতে পারে। আবার অনেক সময় বাধা দেওয়া হয়। এই বিধিনিষেধ সময় অসময়ে বদলায়। ফিলিস্তিনিদের জন্য এই বিধিনিষেধ অনেক বেশি কঠোর। ইসরায়েল সরকারের দাবি, নিরাপত্তার কারণে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। ঐতিহাসিকভাবেই এটি মুসলমানদের পবিত্র স্থান। মসজিদটির প্রবেশদ্বার ১১টি, যার মধ্যে ১০টি মুসলমানদের জন্য। মাত্র একটি প্রবেশদ্বার রয়েছে অমুসলিমদের প্রবেশের জন্য।


বারবার বর্বরোচিত হামলা

জেরুজালেমে জুমার দিনে ফজরের নামাজের উদ্দেশ্যে জড়ো হতে থাকেন ফিলিস্তিনের মুসলমানরা। আল-আকসা মসজিদে অবস্থানরত ফিলিস্তিনিদের ওপর আকস্মিক হামলা চালায় ইসরায়েলের নিরাপত্তা বাহিনী। গেল শুক্রবার অধিকৃত জেরুজালেমের আল-আকসায় সহিংসতায় অন্তত ১৫২ ফিলিস্তিনি আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয় চিকিৎসকরা। জানা গেছে, শুক্রবার ভোরের আগেই ইসরায়েলি পুলিশ মসজিদ প্রাঙ্গণে প্রবেশ করে। সে সময় হাজার হাজার মুসল্লি ফজর নামাজের জন্য মসজিদে জড়ো হয়েছিলেন। গণমাধ্যমে প্রচারিত একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলি পুলিশকে টিয়ার গ্যাস ও স্টান গ্রেনেড ছুড়তে দেখা যায়। প্রতিবাদী ফিলিস্তিনিদের তখন পুলিশকে লক্ষ্য করে ঢিল ছুড়তে দেখা যায়। ফিলিস্তিনি মুসলমানদের ওপর এমন হামলা এটাই প্রথম নয়।  বেলফোর ঘোষণার জের ধরে ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিন ভূখন্ডে বলপূর্বক প্রতিষ্ঠা করা হয় জায়নবাদী বা উগ্র ইহুদিবাদী রাষ্ট্র ইসরায়েল। আর এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠালগ্নে লাখ লাখ ফিলিস্তিনিকে তাদের পিতৃপুরুষের আবাসভূমি থেকে উচ্ছেদ ও বিতাড়ন করা হয় হত্যা, হামলা, ধর্ষণ ও লুটতরাজ চালিয়ে। লাখ লাখ ফিলিস্তিনি বা আরব হয়ে পড়ে উদ্বাস্তু ও শরণার্থী। অল্প কিছু যারা রয়ে যায় এবং পরবর্তী সময়ে যারা ফিরে আসার সুযোগ পায়, তারা হয়ে পড়ে নিজ ভূমে পরবাসী ও অবরুদ্ধ। আর সময়ে অসময়ে পবিত্র আল-আকসা মসজিদ প্রাঙ্গণে নিরীহ মুসল্লিদের ওপর উগ্রবাদী ইসরায়েলিরা চালায় বর্বরোচিত হামলা। যার ফলশ্রুতিতে অসংখ্যবার নিরীহ মুসলমানের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে ঐতিহাসিক বায়তুল মাকদিস। এর আগে ২০২১ সালের মে জেরুজালেমের পুরনো শহর এলাকায় জুমার নামাজের পর আল-আকসা মসজিদ প্রাঙ্গণে ফিলিস্তিনি বিক্ষোভকারী ও ইসরায়েলি নিরাপত্তাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। গণমাধ্যম সূত্র জানিয়েছিল, আল-আকসা মসজিদে জুমার নামাজ শেষ হওয়ার পর দাঙ্গা বাধে। ২০১৪ সালেও ফিলিস্তিনি মুসল্লিদের ওপর টিয়ার শেল ও রাবার বুলেট ছুড়েছিল ইসরায়েলি পুলিশ। ১৯৮৮ ও ১৯৯০ সালেও পবিত্র এই মসজিদে ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েলি বাহিনীর সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছিল। ইতিহাসবিদদের মতে, ১৯৪৮ সাল থেকে আল-আকসা মসজিদ প্রাঙ্গণে বারবারই ইসরায়েলি বাহিনীর হামলার শিকার হয়ে আসছে ফিলিস্তিনি নাগরিকরা। এ হামলা যে কেবল আল-আকসা প্রাঙ্গণেই সীমাবদ্ধ থাকে নয়, তা ছড়িয়ে পড়ে ফিলিস্তিনের শহরগুলোতেও।

 


মেরাজের স্মৃতিধন্য পবিত্র মসজিদ

এ পবিত্র মসজিদ থেকেই হজরত রসুলুল্লাহ (সা.) ঊর্ধ্বাকাশে তথা  মেরাজে গমন করেছিলেন। নবী করিম (সা.) মেরাজে গমনের সময় আল-আকসায় অতীতের সব নবী-রসুলের জামাতে  ইমাম হয়ে দুই রাকাত নামাজ আদায় করেন।

ইসরা বা মেরাজ, যা নবী করিম (সা.)-এর রাত্রিকালীন যাত্রা হিসেবে পরিচিত। যে যাত্রায় তিনি মহান আল্লাহর সাক্ষাৎ পান। ইসলামের ইতিহাস ও বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (স.)-এর জীবনে মেরাজ একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। পবিত্র ইসলাম ধর্ম প্রচারের কারণে বিপদে জর্জরিত, প্রিয় চাচা আবু তালিব ও প্রিয়তমা স্ত্রী হজরত খদিজা (রা.)-এর ইন্তেকালে শোকাভিভূত নবী করিম (সা.)-এর অশান্ত হৃদয়ে সান্ত¡নার শীতল পরশ বুলানোর নিমিত্তে এক অসাধ্য সাধন কাজের মাধ্যমে নবুয়তের সত্যতাকে সুনির্ধারিত করতে মহান আল্লাহতাআলা বিশ্বনবীকে একান্ত সান্নিধ্যে ডেকে নেন। সে সাক্ষাতের জন্য নবী করিম (সা.) যে স্থান থেকে মেরাজে যাত্রা করেন তা জেরুজালেমে অবস্থিত, মসজিদুল আকসা। নবী করিম (সা.) মেরাজ গমনের সময় আল- আকসায় অতীতের সব নবী-রসুলের জামাতে ইমাম হয়ে দুই রাকাত নামাজ আদায় করেন। পবিত্র কোরআনেও মেরাজ সম্পর্কে বলা হয়েছে। মহান আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘সব মহিমা তাঁর যিনি তাঁর বান্দাকে এক রাতে মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত পরিভ্রমণ করিয়েছিলেন, যার চারপাশকে আমি বরকতময় করেছি। (আর এই ভ্রমণ করানোর উদ্দেশ্য হচ্ছে) যাতে আমি আমার নিদর্শন তাঁকে প্রদর্শন করি।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ১)। ফিলিস্তিন প্রাকৃতিক নদ-নদী, ফল-ফসলের প্রাচুর্যতা এবং নবী-রসুলের স্মৃতিবিজড়িত স্থান হওয়ার কারণে পৃথক বৈশিষ্ট্যের দাবি রাখে। আর এসব গুণ-বৈশিষ্ট্যের প্রতি লক্ষ্য রেখে মহানবী (সা.) মসজিদুল হারাম, মসজিদে নববি ও মসজিদুল আকসার উদ্দেশ্যে সফরকে বিশেষ পুণ্যময় হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এ বার্তা পৃথিবীর অন্য কোনো মসজিদের ব্যাপারে আসেনি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর